বাবা, তোমাকেই সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি আমি

আমার ছেলেবেলা কেটেছে গ্রামে। গ্রাম মানে সবুজের সমারোহ, পাখপাখালি, পুকুরে সাঁতার, ব্রিজের ওপর থেকে নদীর বুকে ঝাঁপিয়ে পড়া, ঝড়ের রাতে আম কুড়ানো, প্রখর রোদে লাটাই হাতে ঘুড়ি ওড়ানো—এসবই ছিল। কিন্তু প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার এ আনন্দঘন গ্রামীণ জীবনেরও ইতি ঘটে যায়। বাবা উপজেলা শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত একটি স্বনামধন্য বিদ্যাপীঠে ষষ্ঠ শ্রেণিতে আমাকে ভর্তি করে দেন।  

বাড়িতে বাবার কথার ওপর কেউ কথা বলে না। বাবা বেশির ভাগ সময় গম্ভীর মুখ করে থাকেন। আমি আর বোনও বাবাকে অনেক ভয় পাই। তবে খুনসুটি কিংবা কোনো আবদার করার ক্ষেত্রে আমাদের ভাবতে হয় না। কোনো কিছুর প্রয়োজন হলে আমরা নির্দ্বিধায় বাবাকে বলতে পারি। বাবা আমাদের কোনো আবদার অপূর্ণ রাখেন না। আমাদের ওপর জোর করে কিছু চাপিয়ে দেন না। ভাবনাচিন্তা করে নিজেদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ দেন। আর কখনো আমরা সিদ্ধান্ত নিতে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়লে বাবা ম্যাজিশিয়ানের মতো ম্যাজিক করে সমাধান দিয়ে দেন।

যাহোক, শহরের স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর নতুন জীবন, নতুন বন্ধু, নতুন শিক্ষকের সঙ্গে মানিয়ে চলতে চলতে হাঁপিয়ে উঠলাম। ফলে প্রথম পরীক্ষার ফল আশানুরূপ হলো না। বাড়ির সবাই খুব ভেঙে পড়লেন। স্কুলের কোনো একটা ট্রেনিং থাকায় বাবা তখন বাইরে ছিলেন। আমার সময় আর কাটে না। বাবা কি খুব বকবেন আমাকে? সই করবেন মার্কশিটে? ইত্যাদি ভাবতে ভাবতে নাজেহাল অবস্থা আমার। সেই সঙ্গে বাবা বলেছিলেন, পরীক্ষায় গড়ে ৮০ শতাংশ নম্বর পেলে নতুন সাইকেল কিনে দেবেন। আমি সাইকেল চালিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে স্কুলে যাব, এখানে-সেখানে ঘুরব। কিন্তু সেসবের কিছুই হবে না উপরন্তু বাবার কাছে বকুনি খেতে হবে, ভাবতেই আরও বেশি মন খারাপ হলো আমার।

বাবা, ট্রেনিং থেকে বাড়ি ফিরে আমার খারাপ রেজাল্ট করার কথা শুনলেন। কিন্তু আমাকে কিছু বললেন না। সন্ধ্যায় টিচার চলে যাওয়ার পর আমার পড়ার ঘরে এলেন বাবা। আমি চোরের মতো মাথা নিচু করে বসে আছি। বাবা আমার মাথায় হাত রাখলেন। ভয়ে নাকি অজানা অন্য কোনো কারণে ঠিক বলতে পারি নে, আমি বাবাকে জড়িয়ে ধরলাম। বাবা মার্কশিট দেখতে চাইলেন, আমি মার্কশিট বের করে বাবার হাতে দিলাম। বাবা, স্বাক্ষর করে মার্কশিটটা টেবিলের ওপর রেখে চলে গেলেন।

পরের দিন স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে উঠানে একটা চকচকে নতুন সাইকেল দেখতে পেলাম। মায়ের কাছে জানতে চাইলে মা বললেন, ‘বাবা আমার জন্য কিনে এনেছেন।’ সব চিন্তাভাবনা রেখে সাইকেল নিয়ে ঘুরতে বেরিয়ে পড়লাম আমি। কিন্তু বাড়ি ফিরতেই মনটা দুঃখে ভরে উঠল আমার। মাকে বলতে শুনলাম, ‘তোমার জন্য মোবাইলটা কিনলে পারতে। কত কাজে দরকার না এখন। খোকারে না হয় পরের মাসে কিনে দিতে সাইকেল। আমি বুঝিয়ে বললে ও বুঝত।’ উত্তরে বাবা কিছু বললেন না। আমি নিঃশব্দে সাইকেল রেখে ঘরে এলাম। দুচোখ জলে ভরে উঠল আমার। বাবাকে কিছু বলতে পারলাম না আমি।
জানি না, বাবাকে আমি ঠিক কতখানি ভালোবাসি! তবে আমার মনে হয়, জীবনে হাতে গোনা যে কয়েকজন মানুষের প্রতি আমাদের তীব্র ভালোবাসা থাকে, প্রকৃতির জটিল নিয়মে খুব সহজে আমরা তা উপলব্ধি করতে পারি না। বাবা, আমার কাছে সকালের সূর্য ও রাতের তারার মতো অভ্যস্ততার। তাঁর ব্যক্তিত্ব, সততা, দায়িত্বশীল আচরণ আমাকে মুগ্ধ করে। আমার মাঝেমধ্যে খুব ইচ্ছা হয় চিৎকার দিয়ে বলি, ‘বাবা, তুমিই আমার জীবনের ম্যাজিশিয়ান। তুমি আর মা ছাড়া কোনো সম্পদ নেই জীবনে, তোমরাই আমার বেঁচে থাকার একমাত্র সম্বল। খুব খুব বেশি ভালোবাসি বাবা, তোমাকে।’

  • লেখক: সৌমেন্দ্র গোস্বামী, সাংগঠনিক সম্পাদক, প্রথম আলো বন্ধুসভা, যশোর।