প্রক্সি পরীক্ষা বা বদলি পরীক্ষা চাকরি পরীক্ষায় আরেক আতঙ্ক

চাকরি পরীক্ষায় প্রতারণার নতুন একটি ব্যাপার চালু হয়েছে প্রক্সি পরীক্ষা বা বদলি পরীক্ষা। কিছুদিন আগে প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষার মৌখিক পরীক্ষায় কয়েক ছাত্রছাত্রীর হাতের লেখা ক্রসম্যাচিং করার সময় ধরা পড়ে। উঠে এসেছে অনেক চাঞ্চল্যকর তথ্য। দেখা গেছে, তাঁরা কেউই মূল পরীক্ষায় অংশ নেননি। বিভিন্ন অঙ্কের টাকার বিনিময়ে তাঁদের পরিবর্তে পরীক্ষা দিয়েছেন অন্যজন। যখন মৌখিক পরীক্ষায় হাতের লেখা যাচাই করা হয়, তখন মূল পরীক্ষার সঙ্গে না মিলার কারণে সন্দেহ হয়, অধিকতর জিজ্ঞাসাবাদে বের হয়ে আসে আসল রহস্য। শুধু প্রাইমারি নয়, এমন প্রক্সি পরীক্ষা বা বদলি পরীক্ষা দিয়ে সরকারি বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষায় প্রতারণা করছে একদল গ্রুপ।

পরীক্ষার হলে ছবি দেখে পরীক্ষার্থী যাচাই করা সব সময় সঠিকভাবে হয় না। ফলে ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে যান এই প্রতারকেরা। জানা গেছে, কিছু অসাধু ছাত্রছাত্রী প্রক্সি পরীক্ষা বা বদলি পরীক্ষা নিয়ে ব্যবসা শুরু করেছেন। তাঁরা বিভিন্ন মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে এসব পরীক্ষা দিয়ে থাকেন। এতে মেধাবীরা পিছিয়ে যাচ্ছেন। যাঁরা রাতের পর রাত কঠোর পরিশ্রম করছেন একটি চাকরি পাওয়ার আশায়, তাঁরা হচ্ছেন বঞ্চিত। অথচ অনেক মেধাশূন্য ছাত্রছাত্রী প্রক্সি পরীক্ষার কারণে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় যাচ্ছেন। একটি দেশ এগিয়ে যাওয়ার জন্য এটি একটি বড় অন্তরায়।

মেধাশূন্য জাতি একসময় বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় থাকলে দেশ মেধাশূন্য হতে বেশি দেরি লাগবে না, তাই এর সমাধান অচিরেই করতে হবে। ডিজিটাল বাংলাদেশ খালি মুখে মুখে না বলে এর যথাযথ প্রয়োগ ঘটানো এখন সময়ের দাবি। যেমন ধরুন, প্রক্সি পরীক্ষা থামানোর সমাধান হতে পারে ফিঙ্গারপ্রিন্ট ম্যাচিং। পরীক্ষার আবেদনের সময় সবার ফিঙ্গারপ্রিন্ট নিলে বা জাতীয় পরিচয়পত্রের সার্ভারের সঙ্গে কানেক্ট করে ফিঙ্গারপ্রিন্ট অপশনটি এনাবল করলে এ সমস্যার সমাধান হতে পারে। অথবা চাকরির আবেদনের সময় ফিঙ্গারপ্রিন্ট বাধ্যতামূলক করা যেতে পারে। এটির প্রয়োগ তেমন জটিল নয়।

অনেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে এর ব্যাপক ব্যবহার আমরা লক্ষ করছি। প্রতিটি পরীক্ষার রুমে ফিঙ্গারপ্রিন্ট ডিভাইস দিয়ে হাজিরা নিলে এ সমস্যার সমাধান হতে পারে কিংবা এর চেয়ে ভালো কোনো সমাধান থাকলে, সেটিও বাস্তবায়ন করা যেতে পারে। এ ছাড়া নিয়োগ পরীক্ষা নিয়ে আরও কিছু দুর্নীতির চিত্র আমরা দেখতে পাই। সেগুলোরও সমাধান করলে দেশ অনেক এগিয়ে যাবে।

চাকরি পরীক্ষায় যে সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে সমাধান করা দরকার—

১. প্রক্সি পরীক্ষা বা বদলি পরীক্ষা
২. প্রশ্নপত্র ফাঁস
৩. পরীক্ষাকেন্দ্রে অতিরিক্ত সুবিধা
৪. পরীক্ষার হলে বিভিন্ন ডিভাইসের ব্যবহার
৫. অসাধু চক্রের দৌরাত্ম্য
৬. একাধিক দালাল চক্র
৭. নিয়োগ বাণিজ্য
৮. আগে থেকেই প্রার্থী ঠিক করে রাখা
৯. একই দিনে একই সময়ে একাধিক পরীক্ষার শিডিউল

একজন মেধাবীকে একটি দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের প্রাথমিক হাতিয়ার ধরা হয়। এখানে যদি কেউ দুর্নীতি করে চাকরি করে, তাহলে আমরা মেধাশূন্য জাতি দেখতে বেশি দিন আর লাগবে না। নিয়োগ পরীক্ষার ব্যাপারে এর আগেও বিভিন্ন মামলা হয়েছে, কিন্তু এর কোনো সঠিক তদন্ত হয় না, নেওয়া হয় না কোনো পদক্ষেপ।

গত পাঁচ বছরে নিয়োগ প্রতারণার কারণে শতাধিক মামলা হয়েছে, আর রায় হয়েছে মাত্র চারটির। তেমন শক্তিশালী আইন না থাকায় এবং আইনের ফাঁকফোকরে বের হয়ে আসে আসল হোতারা। তাই আইন সংশোধন করে অপরাধীর কঠিন শাস্তি নিশ্চিত করা দরকার। শিক্ষার মান বাড়াতে স্বচ্ছ, দুর্নীতিমুক্ত ও নিরপেক্ষ একটি পরীক্ষা হোক, এটাই সবাই চায়। পরীক্ষাপদ্ধতির কিছু সংস্কার করে দ্রুত সব পরীক্ষা আয়োজন করা দরকার। শিক্ষার মান আরও কীভাবে বাড়ানো যায়, বিষয়টিও ভেবে দেখা দরকার। মেধাবীরাই একদিন আমাদের দেশ পরিচালনা করবে। তাই সঠিক, দক্ষ ও মানসম্মত প্রার্থী নির্বাচিত হলে আমাদের দেশটাই বদলে যাবে।

উপরিউক্ত সমস্যাগুলোর ব্যাপারে সরকারের জিরো টলারেন্স ঘোষণা করা দরকার। এখনই সঠিক সময় প্রক্সি পরীক্ষা বা বদলি পরীক্ষা ও অন্যান্য সমস্যাগুলোর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার। এ সমস্যাগুলোর সমাধান হলে তবেই মানসম্মত ভবিষ্যতের কান্ডারি আমরা পাব। আর যাঁরা এমন প্রক্সি পরীক্ষায় অংশ নিবেন বা অন্য কাউকে দিয়ে পরীক্ষা দেওয়াবেন, তাঁদের কঠোর শাস্তির আওতায় আনা দরকার, যাতে অন্য কেউ আর যেন এসব করতে সাহস না পান।

লেখক: আব্দুস সাত্তার, প্রযুক্তিবিদ