ছাত্ররাজনীতি: নিয়ন্ত্রণ হারানোর ভয়ে কি এরা এমন করে

একদিকে মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামের ক্রিকেটের টেস্ট খেলা, অন্যদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও হেলমেট পরিহিতদের বাঁশ, হকিস্টিক, রড, চাপাতির খেলা! দুটোরই চরম উত্তেজনায় কোনটা রেখে কোনটা দেখি। সর্বশেষ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই মগজ আটকে গেল। অনেক দিন পর ছাত্রদল মাঠে। ২৪ মে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ‘ঐতিহ্যবাহী’ রড, লাঠি, হকিস্টিক ও ইট-পাটকেলের যে ‘টেস্ট ম্যাচ’ হয়ে গেল। কিন্তু সে খেলায় কত মায়ের বুক যে খালি হবে, তার কী হবে? তবে সমস্যা হলো, কে কোনো দলের হয়ে লড়ছে আমজনতার চিনতে অসুবিধা হচ্ছে না।

কে না বুঝে, দেশের ছাত্ররাজনীতি জন্মই তো হয়েছে রাজনৈতিক দলের ‘ফাইটার উইং’ হিসেবে। এ সব ছাত্রছাত্রীদের যাঁরা রাজনৈতিক কারণে আজকে ‘লাঠিয়াল বাহিনী’ হিসেবে ব্যবহার করছেন। তাঁদের ছেলেমেয়েরা কিন্তু এ দেশে লেখাপড়া করে না। অথচ ক্ষমতা ও স্বার্থের মোহে প্রতিহিংসার যে বিষ ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে রোপণ করছেন, তার কারণে সুজলা-সুফলা, সোনার দেশটা ধ্বংস হয়ে যাবে। যাঁরা আজকে বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো জায়গায় পড়াশোনা করেও এ সাধারণ বিষয়ে জ্ঞান করতে পারেননি, তাঁদের পড়াশোনার দরকার নেই। বিশ্ববিদ্যালয় তো এখন পড়ার যায়গা নয়, রাজনৈতিক ক্যাম্পাস হয়ে গেছে।

মাঝেমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলো যেন ‘সন্ত্রাসের’ অভয়ারণ্য হয়ে ওঠে। শুধু তা–ই নয়, শিক্ষার্থীদের মেরে আধমরা অবস্থায় হাসপাতালে পাঠানো হচ্ছে, যা দুর্বল মনের অনেকেই দেখতে পারবেন না। কোনো প্রতিবাদের ভাষা সহিংস হতে পারে কী? ছাত্র নামধারী এসব শিক্ষার্থীদের আইনের আওতায় এনে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা গ্রহণ করা এখন সময়ের দাবি। না হলে ওরা শুধু নিজের দলকেই ডোবাবে না, দেশ ও জাতিকেও ডোবাবে। আমরা মনে করি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদ্যমান পরিস্থিতি শান্তি ও গণতন্ত্রের জন্য চরম অশনিসংকেত।

বিশ্বের নামীদামি বিশ্ববিদ্যালয়ে যেখানে ছাত্রদের মগজে থাকে নতুন কিছুর আবিষ্কারের নেশা; অথচ আমাদের শিক্ষার্থীরা থাকেন নেতাদের পেছনে। বিশ্ববিদ্যালয়ে নৈতিক শিক্ষা থাকলে দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা জাতির দেখতে হতো না। বিশ্ববিদ্যালয় গবেষক তৈরি করলে আমাদের সস্তা শ্রমিক হিসেবে বিদেশে যাওয়ার প্রয়োজন আছে কী? পদ্মা সেতু, মেট্টোরেল, বঙ্গবন্ধু টানেল, গভীর সমুদ্র বন্দর, এলএনজি টার্মিনাল, রামপাল ও মাতারবাড়ি বিদ্যুৎকেন্দ্র, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে বিদেশি প্রকৌশলী কেন? এমনকি আমাদের বাইং হাউসগুলোতেও ব্যাপকভাবে বিদেশি টেকনিশয়ান ও ইঞ্জিনিয়ারে ভরপুর! পোশাকশিল্প আমাদের গর্ব, এটা নাকি প্রধান রপ্তানি খাত; যদি বছরে ১০টি বিমান, হাজার খানেক গাড়ি বানাতে পারতাম তাহলে এর চেয়ে বেশি টাকা আসত।

অনেকেই বলে থাকেন, দেশের ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব তৈরির জন্য শিক্ষার পাশাপাশি সুস্থ রাজনীতিচর্চা অপরিহার্য। তা না হলে দেশে নেতৃত্ব আসবে কোথা থেকে? কেউ কেউ বলেন, ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করলে দেশে জঙ্গি তৈরি হবে। কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ। অথচ হলি আর্টিজানে হামলায় তাঁরাই ছিলেন।

রাজনীতি শেখার জন্য কি শুধু বাংলাদেশের ছাত্রদের ছাত্ররাজনীতি করতে হয়? পৃথিবীর বহু বাঘা বাঘা নেতা, যাঁরা পৃথিবী দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন, তাঁদের রাজনীতি শিখতে ছাত্ররাজনীতি করতে হয়নি। মনে রাখতে হবে বিল ক্লিনটন, ভ্লাদিমির পুতিন, নরেন্দ মোদি, সি চিন পিং, কিম জন উং, মাহাথির মোহাম্মদ, লি কুয়ান, কেউ ছাত্ররাজনীতির মাধ্যমে বিশ্বনেতা হননি। কানাডার প্রেসিডেন্ট জাস্টিন ট্রুডোকে বলা হয় বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে মানবিক, স্মার্ট ও মেধাবী রাষ্ট্রনেতা।

তিনি কোনো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাত্ররাজনীতি করে আজ এ পর্যায়ে আসেননি। বারাক ওবামা আমেরিকার ইতিহাসে প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট, যিনি কোনো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাজনীতি করে প্রেসিডেন্ট হননি। জার্মানির সাবেক চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল ৩১ বছর বয়সে কোয়ান্টাম কেমিস্ট্রিতে পিএইচডি করেছেন। রাজনীতি শেখার জন্য তাকে কোথাও ভর্তি হতে হয়নি। রাজনীতি শেখার জন্য ছাত্র রাজনীতি করতে হয় না। সমাজের উন্নয়নে, দেশের কল্যাণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মান বৃদ্ধি, নিজেদের জ্ঞান বৃদ্ধি, খেলাধুলা, জ্ঞানার্জনের জন্য বিতর্ক প্রতিযোগিতা, যৌক্তিক দাবি-দাওয়া আদায়ের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রসংগঠন থাকতে পারে। সুতরাং নেতা তৈরির কারখানার জন্য ছাত্ররাজনীতি রাখতে হবে, এ ধরনের খোঁড়া যুক্তি আর চলে না।

রাজনৈতিক দলের আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে অথবা তাদের অঙ্গসংগঠন হয়ে কোনো ছাত্ররাজনীতি এদেশে থাকার প্রয়োজন নেই। ছাত্ররাজনীতি নামে কোনো ভাষা ও শব্দই থাকা উচিত নয়। বরং নাম হওয়া উচিত, ‘ছাত্রসংগঠন’। ছাত্রসংগঠন হতে পরে, শিক্ষক নিয়মিত ক্লাস নিচ্ছেন কি না, পরীক্ষা দেরিতে হচ্ছে কেন, রেজাল্ট সময়মতো প্রকাশ হচ্ছে কি না, শিক্ষক স্বল্পতা, বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় বাজেট বৃদ্ধি, গরিব ও মেধাবীদের বৃত্তি প্রদান ইত্যাদি শিক্ষার্থীদের স্বার্থসংবলিত বিষয়ে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে দাবি আদায় কিংবা আদায় না হলে আন্দোলনের মাধ্যমে তা আদায় করা ছাত্রসংগঠনের কাজ।

কিন্তু বাস্তবে কী হচ্ছে? ছাত্ররা লেখাপড়ার দিকটি উপেক্ষা করে ছাত্ররাজনীতির নামে দলীয় রাজনীতির লেজুড়বৃত্তি করছে। মূলত ছাত্ররাজনীতি হবে ত্যাগের। কিন্তু এখন ত্যাগের ধারা নয়, ভোগের ধারাই প্রধান হয়ে গেছে।

আমাদের সূর্যসন্তানেরা কি ভুল রাজনীতির খপ্পরে পড়ে দিনে-দিনে হারিয়ে যাবেন? আমরা বিশ্বাস করি, যাঁরাই এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন, তাঁরা কেউই কোনো প্রকার রাজনীতিতে যুক্ত হতে চাননি, তাঁদের পরিবার তো চায়ই না। আওয়ামী লীগ, বিএনপি বলে কথা নয়।

আমাদের সিস্টেম আজ তাঁদের রাজনীতি নামের গ্যাঁরাকলে ফেলে দেয়। চ্যালেঞ্জ করে বলা যায়, এখন পর্যন্ত কোনো খারাপ ছেলেকে রাজনীতি করে ভালো হয়ে যেতে কেউ দেখেছে কী? তবে ভালো ও মেধাবী সন্তানেরা যে খারাপ হয়েছে, তা লিখতে গেলে বড় একটি কেতাব হয়ে যাবে। যে ছাত্ররাজনীতি এ দেশের এক শিক্ষার্থীর (মেধাবী বললাম না, মেধাবী না হলেইবা কি) নির্মম মৃত্যু ঘটাতে পারে, সে রাজনীতি কোনো সুস্থ মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। পাঠকদের যাঁদের সন্তান রয়েছে, খুন হওয়া বুয়েট শিক্ষার্থী সাবেকুন নাহার সনি ও আবরার ফাহাদের জায়গায় নিজের সন্তানকে বসান, রাতের ঘুম থাকবে কী আপনার? দলীয় রাজনীতিতে সক্রীয় হয়ে মেধাবী ছাত্রগুলো কীভাবে বুয়েটে এসে অন্যকে খুনের কারণ হয়ে গেলেন? স্বাধীনতার পর কম হলেও ঢাবি, রাবি, চবি, জাবিতে, বাকৃবিতে অনেক শিক্ষার্থী নিজ সংগঠনের নেতা–কর্মী বা প্রতিপক্ষ ছাত্রসংগঠনের নেতা–কর্মীদের হাতে প্রাণ হারিয়েছেন।

অভিভাবকদের অনেকেই রাত-দিন কাঠোর পরিশ্রম, অন্যের কামলা খাটা ছাড়াও নিজের শেষ সম্বলটুকু বিক্রি করে হলেও সন্তানকে মানুষের মতো মানুষ করে গড়ে তোলার জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠান। কিন্তু সেই সন্তান কখনো অন্যকে খুন করে নিজে জেলে যাচ্ছে কিংবা অন্যের হাতে খুন হয়ে মা-বাবার ঘরের কতশত স্বপ্নের আলো নিভিয়ে দিচ্ছে। দলীয় রাজনীতির ছত্রছায়া বন্ধ হলে গেস্টরুম কালচার, গণরুম ও র‌্যাগিংয়ের নামে ভয়ংকর নিপীড়ন বন্ধ করা সম্ভব। র‌্যাগিংয়ের নামে নির্যাতনের ভয়ংকর চিত্র ছাত্র ও অভিভাবকদের মধ্যে তৈরি করেছে আতঙ্ক।

দুঃখ লাগে, ছাত্রসংগঠন বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে এত বড় অবদান রেখেছে সেই সংগঠনকে আজকে কী পরিমাণ দূষিত করে ফেলা হয়েছে। বাংলাদেশে ছাত্র রাজনীতির উজ্জ্বল ঐতিহ্য রয়েছে। ৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ৬৯-এর গণ–অভ্যুত্থান, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে ছাত্র–আন্দোলনের গৌরবজনক ভূমিকা রয়েছে।

কিন্তু ৯০-এর পর থেকেই শুরু হয়েছে ছাত্ররাজনীতির পচন। ছাত্ররাজনীতিকে পরিশুদ্ধ করার একমাত্র উপায় হচ্ছে ছাত্ররাজনীতিকে সম্পূর্ণভাবে মূল দল থেকে আলাদা করে দেওয়া। ছাত্রদের রাজনীতির হাতিয়ার বানিয়ে এ দেশের ঐতিহ্যবাহী ছাত্ররাজনীতির গৌরবের ধারাটিকে গলা টিপে হত্যা করছে। হত্যা করছে দেশাত্মবোধ, মানবিক মূল্যবোধকে।