গোখাদ্যের অতিরিক্ত মূল্যবৃদ্ধি টেকসই দুগ্ধ উৎপাদনের অন্তরায়
বিশ্ব দুগ্ধ দিবস-২০২২ উপলক্ষে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহের ইন্টিগ্রেটেড ডেইরি রিসার্চ নেটওয়ার্কের (আইডিআরএন) পক্ষ থেকে গত বছরের (দুগ্ধ দিবস-২০২১ হতে দুগ্ধ দিবস-২০২২) একটি গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করা হয়েছে। সেখানে বাংলাদেশের টেকসই দুগ্ধ উৎপাদনে কী ধরনের পরিবর্তন হয়েছে, ওই পরিবর্তনের প্রধান নিয়ামকসমূহ ও বাংলাদেশে টেকসই দুগ্ধ উৎপাদনে করণীয় কী, তা বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে।
গবেষণায় দেখা যায়, গত এক বছরে বাংলাদেশে দুধের গড় দাম (ফরমাল ও ইনফরমাল) বেড়েছে ১১ দশমিক ৩ শতাংশ। অর্থাৎ এক বছরে বাংলাদেশে দুধের গড় মূল্যবৃদ্ধি বিশ্ববাজারের তুলনায় ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ কম। পক্ষান্তরে বাংলাদেশে যেখানে গোখাদ্যের দাম বেড়েছে ৫৪ শতাংশ, সেখানে বিশ্ববাজারে দাম বেড়েছে ২০ দশমিক ৬ শতাংশ। অর্থাৎ গত এক বছরে বাংলাদেশে বিশ্ববাজারের তুলনায় ৩০ দশমিক ৯ শতাংশ গোখাদ্যের দাম বেড়েছে। যেখানে খামারি পর্যায়ে দুধের দাম বেড়েছে ২০ শতাংশ (৪৯ দশমিক ৬ টাকা প্রতি কেজি হতে ৫৯ দশমিক ২৮ টাকা কেজি), কিন্তু ভোক্তা পর্যায়ে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২২ শতাংশ (৫৩ টাকা প্রতি কেজি হতে ৬৪ দশমিক ৫৪ টাকা কেজি)। অর্থাৎ খামারি পর্যায়ে দুধের দাম বাড়লে তা সরাসরি ভোক্তা পর্যায়েও বাড়ে।
আইডিআরএনের গবেষণায় গোখাদ্যের অতিরিক্ত মূল্যবৃদ্ধি টেকসই উৎপাদনের বড় বাধা হিসেবে মনে করা হচ্ছে। কিন্তু গোখাদ্যের মূল্যবৃদ্ধি কেন? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে দেখা যায়, গোখাদ্য হিসেবে সর্বাধিক ব্যবহৃত খাদ্য উপাদান হলো গমের ভুসি (যা গম হতে উপজাত হিসেবে পাওয়া যায়)। গমের ভুসির পাশাপাশি সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত খাদ্য উপাদান হলো ভুট্টা, শর্ষের খৈল, চালের কুঁড়া ও সয়াবিন মিল। আর এসব খাদ্যের উপাদান বেশির ভাগই আসে আমদানি করার মাধ্যমে। বিশ্বের যেসব দেশ থেকে এসব খাদ্য উপাদান আমদানি করা হয়, এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য দেশ হচ্ছে কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, ইউক্রেন, অস্ট্রেলিয়া ও ভারত। কোভিড-১৯–পরবর্তী সময়ে ও সাম্প্রতিক সময়ে ইউরোপে অতিরিক্ত শুকনা মৌসুম (ড্রাই ওয়েদার) হওয়ায় গোখাদ্য উপাদানের দাম এমনিতেই বিশ্ববাজারে চড়া, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ায় সেই মাত্রা আরও বেড়ে যায়। আমাদের গবেষণায় দেখা যায়, গোখাদ্য হিসেবে প্রধান উপাদানের মধ্যে ভুট্টার দাম বেড়েছে ৯০ শতাংশ। অর্থাৎ গত বিশ্ব দুগ্ধ দিবস হতে এই বিশ্ব দুগ্ধ দিবসে ভুট্টার দাম ২১ দশমিক ৪৪ হতে ৪০ দশমিক ৭৫ টাকা/কেজি হয়েছে। তারপরই রয়েছে গমের ভুসি, যা ৩৪ দশমিক ২ হতে বেড়ে ৫৫ দশমিক ৭৫ টাকা/কেজি হয়ে শতকরা হিসাবে যা ৬২ দশমিক ৯।
উল্লেখ্য, যে বাংলাদেশের প্রান্তিক বা খামারি পর্যায়ে শতভাগ দুধের খামারি গমের ভুসি ব্যবহার করেন। কাজেই আন্তর্জাতিক বাজারে গমের এই মূল্যবৃদ্ধি সরাসরি খামারি পর্যায়ে পড়েছে। এ ছাড়া শর্ষের খৈলের দাম বেড়েছে ৩৫ দশমিক ৩ শতাংশ, চালের কুঁড়ার দাম ৩০ দশমিক ৩ ও সয়াবিন মিল ৬৪ দশমিক ৫ শতাংশ বেড়েছে। বাংলাদেশের দুধের উৎপাদন খরচ বরাবরই বিশ্বের তুলনায় বেশি।
আইডিআরএনের গবেষণায় আরও দেখা যায়, গোখাদ্যের অতিরিক্ত মূল্যবৃদ্ধির কারণে কৃষক পর্যায়ে দুধের খরচ বেড়েছে ২২ দশমিক ৯৭ শতাংশ। ২০২১ সালের জুন মাসে প্রতি কেজি দুধের উৎপাদন খরচ ছিল ৩৭ টাকা, সেটি ২০২২ সালের মে মাসে দাঁড়িয়েছে ৪৫ দশমিক ৫ টাকা/কেজি।
যেখানে বাংলাদেশের খামারি দুধ উৎপাদনের খরচের ক্ষেত্রে বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতা করতে পারেন না, সেখানে দুধের উৎপাদন খরচের এই অতিরিক্ত মূল্যবৃদ্ধির কারণে দুগ্ধ খামারিদের লাভের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
আইডিআরএনের গবেষণায় দুধের দাম ও গোখাদ্যের দামের অনুপাত নির্ণয়ের মাধ্যমে দুগ্ধ খামারিদের লাভ ও ক্ষতির হিসাব করা হয়ে থাকে। গত এক বছরে দেখা যায়, বাংলাদেশের দুগ্ধ খামারিদের দুধের দাম ও গোখাদ্যের দামের অনুপাত ১ দশমিক ৪৮ (এখানে উল্লেখ্য, এই অনুপাত ১ দশমিক ৫ হলে লাভজনক হিসাবে বিবেচিত হয়) হতে কমে গত মে মাসে ১ দশমিক ০৭–এ নেমে এসেছে। অথচ বিশ্ববাজারে গোখাদ্যের দাম বাড়া সত্ত্বেও এই অনুপাত ১ দশমিক ৩৮ (জুন/২০২১) হতে বেড়ে ১ দশমিক ৫১ (মে/২০২২) হয়েছে।
এ সমস্যার সমাধানকল্পে আইডিআরএনের বিশেষজ্ঞরা কিছু পরামর্শ দিয়েছেন, যেমন, খামারিরা উচ্চমূল্যের গমের ভুসি ও অন্যান্য দামি উপাদানের বিকল্প হিসেবে হাতের কাছে পাওয়া যায়, এমন সস্তা উপাদান ব্যবহার করতে পারেন। তবে তা করতে গেলে দুধের গাভির পুষ্টিগত চাহিদা আদর্শ খাদ্যতালিকা অনুসারে নির্ণয় করে সুষম খাদ্য সরবরাহ করতে হবে, যাতে খাদ্যের অপচয় কম হয় ও গাভির উৎপাদন না কমে। এ ক্ষেত্রে গমের ভুসির পরিবর্তে কচি নেপিয়ারের ও ভুট্টার ঘাস (৩০ দিন বা তার কম বয়সী) ও লিগুমিনাস খাবার দিতে পারলে বর্তমান সমস্যা কমানো সম্ভব। তা ছাড়া সাধারণ খড় ব্যবহারের পরিবর্তে ইউরিয়াযুক্ত খড় ও বেইল খড় ব্যবহার করা যেতে পারে। দুধের উৎপাদন খরচ কমানোর দিকে বেশি মনোযোগ দিতে হবে। আর তা করতে হলে যাঁরা দুধের উৎপাদন খরচ নির্ণয়ে সহযোগিতা করতে পারেন, খামারিরা তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে পারেন।
সরকারিভাবে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি সহযোগিতা করা যেতে পারে। সরকার গোখাদ্যের উপাদান আমদানিতে বড় আমদানিকারকদের কিছু ভর্তুকি দিতে পারে, যাতে ওই খাদ্য উপাদানগুলোর প্রাপ্যতা বাড়ে।
গোখাদ্য উপাদানের বাজার ব্যবস্থাপনা, সরবরাহ পদ্ধতি ও এর সঙ্গে জড়িত স্টেকহোল্ডারদের মধ্যে সমন্বয় করে ভালো মানের উদ্যোক্তা তৈরি করার পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে। দেশীয় ও বিশ্বের শিক্ষা গবেষণা ও উন্নয়ন সহযোগী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে একযোগে কাজ করতে পারলে খামারিদের সব সময় বাস্তবমুখী সমাধান দেওয়া সম্ভব হবে, যা খামারিদের লাভবান হতে সাহায্য করবে এবং সব বাধা অতিক্রম করে বাংলাদেশে টেকসই দুগ্ধ উৎপাদন আরও বেগবান হবে।
*লেখক: মোহাম্মদ মহি উদ্দিন, সহযোগী অধ্যাপক, প্রাণীপুষ্টি বিভাগ, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ