‘ঈদনিদ্রা’

সস্তা নেশা করে মাতাল হওয়া অনেকে বলে, পৃথিবীতে নাকি একই চেহারার সাতজন লোক আছে। যদি থেকেও থাকে, বিশ্বাস করুন, সেই সাতজনেরও শখ কখনো এক হবে না। মানুষের শখ প্রাণিজগতের চেয়েও বিচিত্র, মেয়েদের মনের চেয়েও পরিবর্তনশীল। যেমন স্কুলজীবনে ‘ইয়ুর হবি’ কম্পোজিশনে নিজের শখ ‘গার্ডেনিং’ লেখলেও আমার জীবনের একক এবং একমাত্র শখ ঘুমানো। ঘুমানোর জন্য আমার কোনো বিশেষ স্থান, কাল, পাত্রের প্রয়োজন হয় না। আমি যেখানে–সেখানে যেকোনো সময় ঘুমাতে পারি। একটা মানুষ ঘুমাচ্ছে, এতে কারও সমস্যা হওয়ার কথা নয়। কিন্তু আমার চারপাশের মানুষ আমার ওপরে ক্ষিপ্ত।

প্রথম যেবার চাকরির ইন্টারভিউ দিতে গেলাম, দেখলাম, রুমের বাইরে অনেক মানুষ। ভাবলাম, আমার ডাক আসতে দেরি আছে, একটু ঘুমিয়ে নিই। পাশের একজনকে বললাম, ‘ভাই, আপনার ফাইলটা দিয়ে একটু বাতাস করেন।’ লোকটা এমনভাবে আমার দিকে তাকাল যেন আমি তার কিডনি কয়েক দিনের জন্য ধার চেয়েছি। লোকটা বাতাস করেছে কি না, তা আর জানার সুযোগ হয়নি। আমি তলিয়ে গেলাম ঘুমের সমুদ্রে। ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখলাম গ্রিক উপাখ্যানের ‘হাইড্রা’ তার নয় হাতের এক হাত দিয়ে আমাকে কষে থাপ্পড় দিল। থাপ্পড় খেয়ে হককচিত হয়ে ঘুম থেকে উঠে দেখি, আমার প্রেমিকা শিরিন আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। কোমরে হাত দিয়ে, মুখে রাগ রাগ ভাব এনে আমার দিকে ভয়াল দৃষ্টিপাত করছে। আমি দাঁত কেলিয়ে হাসি দিয়ে বললাম,
—শিরিন, তোমাকে নায়িকা শাবানার মতো লাগছে।
—একটা কথা বলবে না। চুপ। আমাকে রাগালে এবার ডিপজলের মতো দেখাবে।

শিরিন আমাকে সজোরে থাপ্পড় দিল। বুঝতে পারলাম, প্রথম থাপ্পড়টাও হাইড্রা না, শিরিনই দিয়েছিল। আমার সেদিন ইন্টারভিউ দেওয়া হয়নি। আমার ঘুম ভাঙার আগেই ইন্টারভিউ শেষ হয়ে গিয়েছিল। শিরিন ঘণ্টাখানেক বকাবকি করতে করতে আমাকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে গেল। আমার চাকরির ব্যাপারে শিরিন আমার চেয়েও বেশি চিন্তিত। কারণ, ওর বাসায় বিয়ের প্রস্তাব আসছে। কোনোরকম একটা চাকরি হলেই বাবার কাছে আমাকে চেয়ে বসবে।

আমি চাকরি পেলাম না। শিরিনেরও বিয়ে ঠিক হয়ে গেল। ঈদুল ফিতরের পরের দিন বিয়ে। শিরিন কঠিন মুখ করে জানাল, আমাকে তার বাবার সঙ্গে দেখা করতে যেতে হবে। বলতে হবে তাকে ভালোবাসি, বিয়ে করতে চাই, না হলে বাঁচব না ইত্যাদি। আমি বাঘের খাঁচায় যেতে রাজি হলেও শিরিনের বাসায় যেতে রাজি ছিলাম না। কিন্তু বাঘিনীকে পেতে বাঘকে তো মানাতে হবেই, তাই যেতে বাধ্য হলাম।

শিরিন জানে আমি স্কুলজীবনে ‘মাইসেলফ’ প্যারাগ্রাফও দেখে দেখে লিখতাম। তাই সে আমাকে আগে থেকে শিখিয়ে দিল কীভাবে কী বলতে হবে। আমি কথাগুলো অক্ষরে অক্ষরে মুখস্থ করতে করতে মুখে ফেনা তুলে ফেলেছিলাম। কিছুতেই ভুল করা যাবে না, জীবন–মৃত্যুর মতো ব্যাপার। মনে রাখতে হবে, শিরিনের বাবা খুব ধার্মিক লোক। সব কথায় খোদার প্রশংসায় ‘আলহামদুলিল্লাহ’ শুনতে পছন্দ করেন।

আল্লাহর নাম জপতে জপতে শিরিনদের অ্যাপার্টমেন্টে প্রবেশ করেই আরামে বললাম, ‘আহহ’। এসিটা একদম আমার দিকেই যেন তাকিয়ে ছিল। অনেক দিন এটির বাতাস খাই না। মনে হচ্ছিল মেঝেতেই গা এলিয়ে দিই। সোফায় বসে বাতাস খেয়ে ‘আহহ’ করতে করতে ঘুমিয়ে পড়লাম।

এর মাঝে শিরিনের পরিবারের লোকজন সামনে এসে বসে আছে। শিরিন ইতস্তত হয়ে আমাকে ডাকছে। হুট করে এক গ্লাস পানি ঢেলে দিল আমার মুখে। ঘুম ভেঙে আমি লজ্জায় কারও দিকে তাকাতে পারছিলাম না। ইতস্ততভাবে সালাম দিলাম। অপ্রস্তুতভাবে দ্রুত উপুড় হয়ে একে একে সবার পা ছুঁয়ে সালাম করতে থাকলাম। এমন সময় কাজের মেয়ে হালিমা নাশতা নিয়ে তাদের সমান্তরালে এসে দাঁড়াল। আমি তাকেও সালাম করে ফেললাম। সে, ‘ও আল্লাহ! কুতকুতি লাগে।’ বলে লাফিয়ে উঠল। গরম চা পড়ল আমার পিঠে। ইশ! এদিকে আমার চামড়া জ্বলে গেল আর সেদিকে শিরিনের ছোট বোন পাশে দাঁড়িয়ে খিলখিল করে হাসছে। রাগে খিটমিট করতে করতে কোনোমতে গোসল করে, শিরিনের বাবার পাঞ্জাবি পরে সামনে এসে বসলাম। সবাই বিরক্ত হয়ে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। কোনোমতে হাসি হাসি মুখ করে বললাম,
—আঙ্কেল, কেমন আছেন?

ওর বাবা করুণকণ্ঠে বলল,
—ভালো নেই, বাবা। শরীরটা ভালো যাচ্ছে না আজকাল।
—আলহামদুলিল্লাহ।
তারপর যা ঘটল, আমি কোনোভাবেই মেনে নিতে পারলাম না। শিরিনের পুরো পরিবার আমাকে বাসা থেকে বের করে দিল। খুব রাগ হয়েছিল। ইচ্ছে করেছিল আমির খানের মতো ওদের দরজায় মূত্রবিসর্জন করে আসি।
ঘটনাপ্রবাহের সর্বসাকল্যে বিবেচনা করে একটাই সিদ্ধান্ত নিয়েছে শিরিন, সে আমাকে নিয়ে পালাবে। এ নিয়ে আমি মনে মনে বেজায় উত্তেজিত। উত্তেজনায় এক বেলা করে বেশি ঘুম হচ্ছে। যেহেতু ঈদের পরের দিন বিয়ে, তাই আমাকে পালাতে হবে ঈদের দিন ভোরে। সবাই যখন সেমাই নিয়ে ব্যস্ত থাকবে, আমি তখন থাকব সিলেটের বাসে। যা করার করতে হবে ভোর পাঁচটায়। কারণ, প্রতিবছর ঈদের আগের রাতেই দারোয়ানকে ঈদের নামাজ পড়ার জন্য ছুটি দেওয়া হয়। একটু সকাল হলে শিরিনের বড় চাচা সেখানে বসে ফিতরা বিতরণ করেন। আর নামাজের পর দারোয়ান আবার এসে পড়ে। দারোয়ানকে বলা আছে, শিরিনকে যেন বাইরে যেতে দেওয়া না হয়। তাই যা করার করতে হবে ভোরের আলো ফোটার আগে, যে সময়টায় দারোয়ান থাকবে না তখন।
দেখতে দেখতে চাঁদরাত এসে পড়েছে। চারদিকে বাজি ফুটছে, উৎসবমুখর পরিবেশ।

ছোট বোনকে বললাম হাতে মেহেদি লাগিয়ে দিতে। কাল আমার বিয়ে। ব্যাগ গোছালাম। মনের আকাশে রংধনু উঠেছে, সব রঙিন লাগছে। এমন সময় দেখি টিভির সামনে সবাই গালে হাত দিয়ে বসে আছে। দেশের কোথাও নাকি শাওয়াল মাসের চাঁদ দেখা যায়নি। কাল ঈদ হবে না। প্রচণ্ড মন খারাপ হলো। খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। বিয়েটা একদিন পেছাল এই কষ্টে মনে হচ্ছে ঘুম বেশি হবে।
সকালে নিজেকে আবিষ্কার করলাম ভিজা বিছানায়। মা ঘুম থেকে ওঠানোর জন্য সেই প্রাচীন ‘জলনিক্ষেপ’ পদ্ধতি প্রয়োগ করেছে। রেগেমেগে বলছে,
—‘নবাবজাদা ওঠ। ৮টা বাজে। নামাজে যা।’ আমি অবাক হয়ে বললাম,
—ফজরের ওয়াক্ত সেই কখন শেষ। আটটায় কিসের নামাজ!
—‘ঈদের নামাজ গর্ধভ।’ বলেই মা চলে গেল। হতবিহ্বল হয়ে জানতে চাইলাম,
—চাঁদ না দেখে কিসের ঈদ!
পরিবেশের গোলমেলে অবস্থা নিরূপণের জন্য খবর পড়া জরুরি। তাই মোবাইল ফোন হাতে নিলাম। দেখলাম, শিরিনের ১৪৮টা মিসড কল। কল ব্যাক করলাম। ফোন সুইচড অফ। সারা দিন কিছুতেই তার সঙ্গে যোগাযোগ করা গেল না। পরদিন তার বিয়ে হলো।

পরিশিষ্ট
সেদিন আমি ঘুমিয়ে যাওয়ার পর রাত ১২টায় চাঁদ দেখা কমিটি নিশ্চিত করে যে চাঁদ দেখা গেছে। বছরে তাদের একটিই কাজ। সেটি যদি ঠিকমতো করতে পারত, তাহলে আজ আমি সানন্দে বিবাহিত থাকতাম।
ছোটবেলায় আম্মু বলত, আমার ছেলেকে ‘একটা চাঁদের মতো বউ’ এনে দেব। কিন্তু গত ঈদের ঘটনার পর থেকে কেউ এই অভিশাপ দিলে বলি, ‘না থাক। এত কনফিউজিং বউ আমার লাগবে না।’

লেখক: মো. মিনহাজ উদ্দিন ফাহিম, শিক্ষার্থী, ২য় বর্ষ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়