আমার জীবনের অনেক কিছুরই শুরু বাবার মাধ্যমে

প্রতীকী ছবি

বাবাকে নিয়ে লিখতে বসেই ফিরে গেলাম ২০২০ সালের অক্টোবরে, সেই ভয়াবহ দিনগুলোতে।

১২ অক্টোবর মা, বাবা এবং আমি কোভিডের নমুনা জমা দিই। মা–বাবার পজিটিভ রেজাল্ট আসে ১৫ তারিখে এবং আমার ১৬ তারিখে। ১৬ তারিখ মায়ের তীব্র শ্বাসকষ্ট দেখা দিলে তাঁকে সিলেটের শহীদ শামসুদ্দিন আহমেদ হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি করি। ক্যানসারে আক্রান্ত বাবাকে কে দেখবে, এ জন্য মিষ্টি মাসি বললেন, ওনাকেও হাসপাতালে ভর্তি করাতে। গৌতমদা আর শুভম বাবাকে হাসপাতালে নিয়ে আসেন। বাবাকে ওয়ার্ডে রাখা হয়। ওয়ার্ডে বাবার পাশের বেডের একজন রোগী আমাকে কল দিতেন। বলতেন, ‘আপনার বাবাকে কিছু খাইয়ে যান, ওনার কাপড় পাল্টে দেন, ওনার ঠান্ডা লাগছে, একটা চাদর দিয়ে যান, ডাক্তার বা নার্স এসেছেন, আপনি আসেন।’ আমি বলতাম, ‘ভাই আপনি একটু খেয়াল রাখেন। আমি নিরুপায় মাকে নিয়ে।’ ওয়ার্ডে গেলে ওই ভদ্রলোক আমায় বলতেন, ‘আপনি আসায় আপনার বাবা খুশি।’

১৮ অক্টোবর সন্ধ্যার পর বাবাকে কেবিনে নিয়ে আসি। সেদিন আমার জন্মদিন ছিল। আমি ভাবছিলাম, এমন ভয়ংকর জন্মদিন কারও হয়?

দুই জায়গায় দুইজনকে রাখলে আমার পক্ষে সামলানো খুব কষ্টকর হচ্ছিল। তাই অবস্থা বিবেচনা করে পরের দিন বাবাকেও আইসিইউতে নেওয়া হয়। হাসপাতালে প্রতিদিন ইনজেকশন নিতে বাবার খুব কষ্ট হতো। নার্স ইনজেকশন দিতে গেলেই উনি চিৎকার করতেন। বলতেন, ‘আমি ব্যথা পাই, আর দিয়ো না, পরে দিয়ো।’ হাত-পা ধরে রেখে জোর করে দেওয়া হতো। স্যালাইন দিতেও ঝামেলা হতো খুব। ক্যানুলা করার শিরা পাওয়া যেত না বা পেলেও উনি বাধা দিতেন। কেমো দেওয়ার কারণেই কিনা জানি না, চিকিৎসা বা সেবার খাতিরে শরীরের কোথাও স্পর্শ করলেই উনি চিৎকার করতেন।

২৬ অক্টোবর দশমীর দিন ভোরে মা ইহলোক ত্যাগ করেন। মায়ের সৎকার শেষে শ্মশান থেকে হাসপাতালে গিয়ে বাবাকে ডিসচার্জ করে বাসায় নিয়ে আসি। ওনার প্রিয় খাবারের মধ্যে ছিল দুধ আর কলা। রাসেল ভাই আর আশরাফ ভাই ওনাকে খাইয়ে দিয়েছিলেন। কে জানত এটাই ছিল ওনার শেষ খাওয়া। রাতে ওনাকে আমি কিছু খাওয়াতে পারিনি। মৃত্যুর আগে শেষ তিন দিন উনি ডান দিকে ঘাড় কাত করে একদিকে তাকিয়ে থাকতেন আর কোনো কিছু চিবানোর মতো করে মুখ নাড়তেন।

বাবা ‘নিকুঞ্জ স্যার’ নামে পরিচিত ছিলেন, ছিলেন গণিতের শিক্ষক। অঙ্কের স্যারেরা খুব সহজেই কঠিন অঙ্ক মিলিয়ে দেন। তাই মায়ের মৃত্যুর পরদিন ২৭ তারিখ সকালে বাবাও আমায় ছেড়ে চলে গেলেন। বাবার মৃত্যুর কারণ কী? ক্যানসার? কোভিড? স্ট্রোক? নাকি মায়ের শোকে? এ এক রহস্য।

সাধারণত মেয়েরা নাকি চায় তার প্রেমিক বা বরের মধ্যে সেই সব গুণ থাকুক, যা তার বাবার মধ্যে আছে। বাবা, শব্দটার ভেতর কেমন যেন একটা নির্ভরশীলতা কাজ করে। মা আমাকে সব সময় বলতেন, ‘তুই যদি মনে করিস দুনিয়ার সব পুরুষ তোর বাবার মতো চরিত্রবান আর সৎ হবে, তাহলে পদে পদে ধাক্কা খাবি।’ মায়ের কথাটা দারুণ সত্যি।

আসলেই আমার বাবার মতো এমন ভালো মানুষ আর দেখিনি। স্কুলে শিক্ষকতার পাশাপাশি, বই আর পত্রিকা পড়া, টিভিতে খবর আর খেলা দেখা এবং বাজার করা—এই ছিল আমার সহজ-সরল বাবার জীবন। মানুষজনকে বাসায় নিমন্ত্রণ দিয়ে খাওয়াতে খুব পছন্দ করতেন বাবা।

নতুন কুঁড়িতে গানের প্রতিযোগিতায় আমি যখন চূড়ান্ত পর্ব পর্যন্ত নির্বাচিত হলাম, বাবা ভীষণ খুশি হলেন। সেদিনই ঢাকার ইস্টার্ন প্লাজা থেকে ১ হাজার ৩০০ টাকা মূল্যের স্কার্ট কিনে দিলেন, সেটা ১৯৯৬ সালের কথা। জাতীয় শিশু পুরস্কার প্রতিযোগিতার সময় নিয়ে গেলেন কুমিল্লা। ময়নামতিসহ কয়েকটা জায়গা ঘুরেছিলাম সেবার। ছোটবেলায় ট্রেনে করে সিলেট থেকে ঢাকা যাওয়া–আসার পথে আখাউড়ায় ট্রেন থামালে বাবা কত খাবার কিনতেন, বিশেষ করে সাগর কলা। বাসে, ট্রেনে বা বিমানে কোথাও যেতে হলে বাবা অনেক আগেই রেডি হয়ে তাড়া দিতে থাকতেন। এমনকি বিয়েবাড়ির নিমন্ত্রণেও আগে চলে যেতেন।

মনে পড়ছে একসঙ্গে স্কুলে যাওয়ার স্মৃতি, যে স্কুলে (ব্লু বার্ড হাইস্কুল, সিলেট) আমি পড়েছি, সে স্কুলের শিক্ষক ছিলেন বাবা। বৈশাখী মেলা, রথের মেলা, বইমেলায়, শহীদ মিনারে বাবার হাত ধরেই যেতাম ছেলেবেলায়। রিকাবীবাজারস্থ অডিটরিয়ামে গিয়ে মঞ্চনাটক দেখতাম। সেবা প্রকাশনীর তিন গোয়েন্দা, ভারতীয় কমিকস বইগুলো কিনে দিতেন। কিনে দিতেন ছোটদের বিভিন্ন রূপকথার বই বা অনুবাদ বই, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপন্যাসসমগ্র উপহার দিয়েছিলেন ১৯৯৯–তে। এ রকম কত কত বই যে কিনে দিতেন। বই আর পত্রিকা পড়ার নেশাটা হয়েছিল বাবার কারণেই। লেখালেখি করার অভ্যাসটা হয়েছিল বাবার কারণেই।

২০০১ সালে কলকাতা গেলাম বাবার সঙ্গে। যদিও ত্রিপুরা বা আসাম যাওয়া হয়েছিল একেবারে ছোটবেলা থেকেই, তবে কলকাতা গেলাম সেবার প্রথমবার। যা দেখি ভালো লাগে—ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, সায়েন্স সিটি, নিকো পার্ক, পিয়ারলেস হাসপাতাল, বেলুড় মঠের রামকৃষ্ণ মিশন, দক্ষিণেশ্বরের কালীমন্দির, ট্রাম, মেট্রো, মাটির ভাড়ে চা, বিরিয়ানি, স্ট্রিট ফুড, ফুচকা...। এরপরে কলকাতা কতবার যাওয়া হয়েছে। কিন্তু বাবার সঙ্গে প্রথমবার যাওয়ার যে আনন্দ, তা আর কখনো পাইনি। আমার জীবনের অনেক কিছুরই শুরু বাবার মাধ্যমে।

১৯৯৬–তে মা একবার অসুস্থ হয়ে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন অনেক দিন। সে সময় অনুভব করতে পেরেছি মায়ের প্রতি বাবার গভীর ভালোবাসা।

বাবার অনেক শিক্ষার্থী দেশে–বিদেশে প্রতিষ্ঠিত, ভালো অবস্থানে আছেন। এটা ভাবতেই ভালো লাগে।

আমার মতো যাদের বাবা নেই, তারা বোঝে তারা কী হারিয়েছে। বাবা তোমায় অনেক ভালোবাসি। পৃথিবীর সব বাবাকে বাবা দিবসের শুভেচ্ছা। সব বাবা ভালো থাকুন।
‘ছেলেবেলার দিন ফেলে এসে
সবাই আমার মতো বড় হয়ে যায়,
জানি না কজনে আমার মতন
মিষ্টি সে পিছুডাক শুনতে যে পায়,
আয় খুকু আয়…
আয় খুকু আয়…’
লেখক: সম্পাদক, উইমেন ওয়ার্ডস (নারীবিষয়ক একটি অনলাইন পোর্টাল)।