অপরূপ বর্ষাকাল
গ্রীষ্মের তীব্র দাবদাহে যখন প্রকৃতি জ্বলেপুড়ে একাকার, তখনই প্রকৃতিতে শীতল পরশ নিয়ে আসে বর্ষা। বর্ষাকালে প্রকৃতি যেন ফিরে পায় নবজীবন। বর্ষা আমাদের মনেও প্রশান্তি নিয়ে হাজির হয়। বর্ষার ছোঁয়ায় আমাদের মন উদাস হয়ে ওঠে।
বর্ষাকালে গ্রামবাংলার প্রকৃতি গাঢ় সবুজ হয়ে ওঠে। চারদিকে শুধু সবুজের সমারোহ। গ্রামবাংলার প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য সবচেয়ে বেশি ফুটে ওঠে বর্ষাকালে। আকাশে কালো মেঘ ও সূর্যের লুকোচুরি খেলা। টিনের চালে বৃষ্টির ঝুমঝুম শব্দ যে কাউকে উদাস করে। আবার রাতের অন্ধকারে ঝিঁঝি পোকার ডাক। কখনো ঝুম বৃষ্টি, আবার কখনো ঝিরিঝিরি বৃষ্টি।
এ ধরনের আবহাওয়া মানব মনে যেন তৈরি করে অপূর্ব এক রোমাঞ্চ। গ্রামের আশপাশের খাল-বিল, নদী-নালা এবং নিচু জায়গা পানিতে ভরে যায়। যেন দিগন্ত বিস্তৃত জলরাশি। তখন গ্রামগুলো ছোট ছোট দ্বীপের মতো দেখা যায়।
বর্ষাকালে বৃষ্টি কৃষিকাজের জন্য আশীর্বাদ হয়ে আসে। গ্রীষ্মের শুষ্ক মাটি বৃষ্টির পানিতে নরম হয়ে ফসল উৎপাদনে উপযোগী হয়ে ওঠে। তখন কৃষকেরা জমিতে কৃষিকাজে ব্যস্ত সময় পার করেন।
আবার কখনো দিনের কাজ শেষে তাঁরা গ্রামের বৈঠকঘরে অলস আড্ডায় মেতে ওঠে। গ্রামের মেয়েদের এ সময় কোনো কাজ থাকে না। তাই তাঁরা সবাই একসঙ্গে বসে সুই–সুতা দিয়ে নকশিকাঁথায় হরেক রকমের নকশা ফুটিয়ে তোলেন। ছোট ছেলেমেয়েরা কাগজের নৌকা বানিয়ে বর্ষার পানিতে খেলায় মেতে ওঠে।
শহরের জীবনে বর্ষা কিছুটা ভোগান্তি তৈরি করে। শহরে খাল-বিলের সংখ্যা কম, তাই তীব্র বৃষ্টি হলেই জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। তবুও গ্রীষ্মের উত্তপ্ত শহরে বৃষ্টির ফোঁটা মানুষের মনকে উৎফুল্ল করে। উত্তপ্ত শহর আস্তে আস্তে শীতল হয়ে ওঠে। শহরের যান্ত্রিকতায় গ্রামের মতো বর্ষাকাল উপভোগ করা না গেলেও বর্ষাকাল ঠিকই সৌন্দর্যের ডালি নিয়ে হাজির হয়। শহরের উঁচু কংক্রিটের ফাঁকে ফাঁকে ঘন কালো মেঘ ও সূর্যের লুকোচুরি খেলা অসাধারণ মনে হয়। এ সময় শহরের খাল ও লেকগুলো পানিতে ভরে যায়। পার্কগুলো সবুজে ছেয়ে যায়। এ যেন এক অপরূপ সৌন্দর্য।
বর্ষাকালে ফুলের সৌন্দর্য আমাদের করে তোলে বিমোহিত। বর্ষার যে ফুলগুলো আমাদের আকৃষ্ট করে, তা হলো—শাপলা, কদম, কেয়া, কৃষ্ণচূড়া, কলাবতী, পদ্ম, দোলনচাঁপা, চন্দ্রপ্রভা, ঘাসফুল, পানাফুল, কলমি ফুল, কচুফুল, ঝিঙেফুল, কুমড়াফুল, হেলেঞ্চাফুল, কেশরদাম, পানিমরিচ, পাতা শেওলা, কাঁচকলা, পাটফুল, বনতুলসী, নলখাগড়া, ফণীমনসা, উলটকম্বল, কেওড়া, গোলপাতা, শিয়ালকাঁটা, কেন্দার, কামিনী, রঙ্গন, অলকানন্দ, বকুল এবং এ ছাড়া নানা রঙের অর্কিড। বর্ষা ঋতু যেন ফুলের জননী।
আবহমানকাল ধরেই আমাদের প্রকৃতিকে বর্ষার ফুল স্বতন্ত্র সৌন্দর্য বিলিয়ে দিয়ে আসছে উদারতায়। বৃষ্টিস্নাত বর্ষার ফুলের উজ্জ্বল উপস্থিতি আমাদের মন রাঙিয়ে আসছে। কাজ শেষে সন্ধ্যায় প্রিয়জনের জন্য একগুচ্ছ কদমফুল হাতে বাসায় ফেরা। প্রিয়জনের মন রাঙাতে এর চেয়ে বেশি আর কী চাই!
বর্ষা প্রিয়জনের শূন্যতাকে দ্বিগুণ করে। বর্ষাকে নিয়ে লেখা হয়েছে অনেক প্রেম ও বিরহের গল্প, কবিতা ও গান। বাদলের ধারায় বেদনার্ত হয়ে ওঠে মন। ঝরে বেদনাশ্রু। প্রিয় কিছু হারানোর বেদনা বর্ষা এলেই খুব বেশি মনে পড়ে। মহাকবি কালিদাস ‘মেঘদূত’ কবিতায় পর্বতের ওপারে নির্বাসিত শূন্য ও একাকী জীবনে বর্ষার ‘মেঘ’কে দূত করে পাঠিয়েছেন প্রিয়ার কাছে। রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতায় বর্ষার কথা এসেছে বহুবার। কবি বলেছেন—
‘এই জল ভালো লাগে; বৃষ্টির রূপালি জল কত দিন এসে
ধুয়েছে আমার দেহ- বুলায়ে দিয়েছে চুল-চোখের উপরে
তার শান-স্নিগ্ধ হাত রেখে কত খেলিয়াছে, আবেগের ভরে
ঠোঁটে এসে চুমো দিয়ে চলে গেছে কুমারীর মতো ভালোবেসে।’
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের প্রিয় ঋতু ছিল বর্ষা। কবি তাঁর অসংখ্য কবিতা, গান ও সাহিত্যে বর্ষার সৌন্দর্য বর্ণনা করেছেন। তিনি লিখেছেন—
‘বজ্রমানিক দিয়ে গাঁথা, আষাঢ় তোমার মালা।
তোমার শ্যামল শোভার বুকে বিদ্যুতেরই জ্বালা।।
তোমার মন্ত্রবলে পাষাণ গলে, ফসল ফলে।
মরু বহে আনে তোমার পায়ে ফুলের ডালা।’
কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের বর্ষাকাল ছিল অত্যন্ত প্রিয়। তাঁর অসংখ্য গান ও গল্পে বর্ষার প্রসঙ্গ এসেছে বহুবার। তিনি তাঁর প্রিয়তমাকে অন্য কোনো ঋতুতে নয়, বর্ষা ঋতুতেই আসতে বলেছেন—
‘যদি মন কাঁদে
তুমি চলে এসো, চলে এসো
এক বরষায়।
শেষে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলতে চাই—
‘নীল নবঘনে আষাঢ় গগনে তিল ঠাঁই আর নাহি রে।
ওগো, আজ তোরা যাস নে ঘরের বাহিরে।’
লেখক: রাসেল ইসলাম, শিক্ষার্থী, সরকারি তিতুমীর কলেজ