৭ মার্চের ভাষণ শুনছেন বঙ্গবন্ধু

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র
ফাইল ছবি

বাংলা যেন এক নাবিকহীন জাহাজের মতো দিগ্‌ভ্রান্ত জনপদ। এখানে রাজনীতির নাম ষড়যন্ত্রনীতি। অন্ধকারে ঢেকে আছে চারদিক। স্বৈরশাসক গ্রাস করে নিতে চায় সবকিছু। এমন এক কঠিন পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণ দিতে বাধ্য হন। তখন বাঙালি জাতি ও বিশ্বের মানুষ অপেক্ষা করছে এক ঐতিহাসিক মুহূর্তের জন্য। কখন শোনা যাবে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ। পরদিন সকাল ৮টা ৩০ মিনিট। শুরু হয় ঐতিহাসিক ভাষণের বেতার সম্প্রচার। এভাবে ঢাকা বেতারকর্মীরা সেদিন কঠিন পরিস্থিতিতে দাবি আদায় করেছিলেন।

৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু ইতিহাসের এক বিশাল জনসভায় ভাষণ দেন। এটি ছিল এমন এক ভাষণ, যা বাংলার কোটি মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নেয়। তখন থেকে তিনি যা বলেন, তা-ই হয়। ৭ মার্চ তিনি বললেন, কেউ কাজে যাবেন না। কেউ কাজে গেলেন না। কোর্ট-কাচারি চলবে না। গাড়ি-ঘোড়া চলবে না। চলল না। সবাই তাঁর কথা শুনছেন। সত্তরের নির্বাচনে বিজয়ের পর থেকেই এ জনপদের মানুষ বঙ্গবন্ধুকে নেতা মনে করছেন।

পূর্ব বাংলায়, সে সময় ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, রংপুর, সিলেট, খুলনাসহ মোট ৬টি বেতার কেন্দ্র ছিল। ১৯৭১ সালের ৮ মার্চ। সকাল ৮টা ৩০ মিনিট। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ একযোগে প্রচারের উদ্যোগ নেওয়া হয়। ৮ মার্চ একই সঙ্গে একই সময় এই ৬টি বেতার কেন্দ্র থেকেই বঙ্গবন্ধুর ভাষণ প্রচারিত হয়। সেদিন বঙ্গবন্ধু কোথাও যাননি। তিনি ছিলেন ধানমন্ডির ৩২ নম্বর রোডের বাস ভবনে। তাঁর সঙ্গে ছিলেন ঢাকা কেন্দ্রের আঞ্চলিক পরিচালক আশরাফ-উজ-জামান। তাঁকে সঙ্গে নিয়ে বঙ্গবন্ধু সেদিন রেডিওতে ৭ মার্চের ভাষণ শোনেন।

তখন অসহযোগ আন্দোলন চলছিল। ২৫ মার্চ পর্যন্ত প্রতিদিন ৬টি বেতার থেকে ৭ মার্চের ভাষণ কখনো সম্পূর্ণ বা নির্বাচিত অংশ প্রচারিত হতো। পরবর্তী সময়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অধিবেশনেও এ ভাষণের সম্পূর্ণ অথবা নির্বাচিত অংশ প্রচারিত হতো। একটি ভয়ংকর স্বৈরাচারী সামরিক জান্তার অধীনে সেদিন এ দেশের বেতারকর্মীরা বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ প্রচারের দাবিতে অত্যন্ত সাহসী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। এ প্রথমবারের মতো সামরিক জান্তা বাঙালির দাবির কাছে নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয়। তাই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগেই পাকিস্তান সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে শুরু হয় বেতারের যুদ্ধ।

ইতিহাসের সাক্ষী চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র

সেদিন ছিল ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ। তখন বেলা ২টা ৩০ মিনিট। চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র থেকে প্রথম ঘোষিত হলো নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশের স্বাধীনতার। আওয়ামী লীগ নেতা এম এ হান্নান এ ঘোষণা দেন। চট্টগ্রাম একটি ঐতিহাসিক বেতার কেন্দ্র। ১৯৬৩ সালের ১ মার্চ এর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয়। স্বাধীনতাযুদ্ধে এ কেন্দ্রের রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ অবদান। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে এ কেন্দ্রের শিল্পীরা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখেন।

একাত্তরের ২৫ মার্চ গণহত্যার পর বদলে যায় বাংলার দৃশ্যপট। চারদিকে ভয়ংকর নীরবতা। সে সময় চট্টগ্রাম বেতারের লেখক শিল্পী ছিলেন বেলাল মোহাম্মদ। তিনি থাকতেন এনায়েত বাজার বাটালী রোডের মুশতারী লজে। এটি ডা. শফি ও তাঁর স্ত্রী বেগম মুশতারী শফীর বাসভবন। মুশতারী শফী তখন বান্ধবী পত্রিকার সম্পাদক। বেলাল মোহাম্মদ এ পত্রিকার পরিচালক। তাঁরা দুজনে তখন বেতার কেন্দ্র নিয়ে পরামর্শ করেছিলেন। পরে তাঁদের সঙ্গে যুক্ত হন চট্টগ্রাম বেতারের অনুষ্ঠান প্রযোজক আবদুল্লাহ আল ফারুক ও চট্টগ্রাম ফটিকছড়ি কলেজের সহ-অধ্যক্ষ আবুল কাশেম সন্দ্বীপ।

সবাই ভাবছিলেন কিছু একটা করা দরকার। হঠাৎ কলকাতার আকাশবাণী থেকে ঘোষণা শুনতে পান পূর্ব বাংলায় যুদ্ধ শুরু হয়েছে। সেই সঙ্গে গান, ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি...।’ প্রায় সবার চোখে পানি এসে যায়। তখন থেকেই তাঁরা বেতার কেন্দ্র চালুর উদ্যোগ নেন।

কারণ, স্বাধীনতার পক্ষে কাজ করতে হবে। ব্যাপক জনমত গড়তে হবে দেশ-বিদেশে। সবাইকে করতে হবে উদ্বুদ্ধ। সে সময় যোগাযোগব্যবস্থা ছিল সেকেলে। একটি ছোট শহরেও কাগজ পৌঁছাতে দিন লেগে যেত। তাই বেতারই মানুষের কাছে দ্রুত খবর পৌঁছানোর একমাত্র মাধ্যম। তাঁরা চট্টগ্রাম বেতারকে কাজে লাগানোর চিন্তা করেন। এ বেতার কেন্দ্র ছিল আগ্রাবাদ বাণিজ্যিক এলাকায়। কিন্তু এখানে নিরাপত্তার ঝুঁকি রয়েছে। সে সময় সৈয়দ আবদুল কাহ্‌হার ছিলেন এ কেন্দ্রের সহকারী আঞ্চলিক পরিচালক। বেলাল মোহাম্মদরা তাঁর সঙ্গে কথা বলেন। জনাব কাহ্হার বললেন যে আগ্রাবাদ বেতার কেন্দ্র থেকে সম্প্রচার সম্ভব নয়। কারণ, যেকোনো সময় এ কেন্দ্রের পতন হতে পারে। তার ওপর চট্টগ্রাম বন্দরে রয়েছে পাকিস্তানি যুদ্ধজাহাজ সোয়াত ও বাবর। এখান থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকা প্রয়োজন। হঠাৎ যুদ্ধজাহাজ থেকে শেলিং হতে পারে। এ কথার পর ভাবনায় পড়ে গেলেন তাঁরা।

এদিকে ২৬ মার্চ। খুব ভোর। চট্টগ্রামের প্রধান সড়কে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা মাইকে প্রচারিত হয়। সে সময় স্থানীয় ডাক্তার আনোয়ার আলী ছিলেন আওয়ামী লীগের কর্মী। তিনিসহ অনেকে বঙ্গবন্ধুর ‘স্বাধীনতা’ ঘোষণার লিফলেট হাতে পান। এটি ছিল একটি ইংরেজি সাইক্লোস্টাইল কপি। এর অনুবাদ করে অনেকগুলো কপি করা হয়। আওয়ামী লীগ নেতা এম এ হান্নানও এর একটি কপি পান। দেখেন, এটি বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা। আর দেরি না করে সঙ্গে সঙ্গে চলে যান আগ্রাবাদ বেতার কেন্দ্রে। কয়েকজন বেতারকর্মীর সহযোগিতায় প্রথম এ কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচার করেন। তখন সময় বেলা ২টা ২০ মিনিট। আর এভাবেই চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে রইল।

**আশফাকুজ্জামান, লেখক, ও সংগঠক