ঘূর্ণিঝড় মোখা: প্রস্তুতি বাঁচায় প্রাণ

ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে বঙ্গোপসাগর উত্তাল হয়ে পড়েছে
ফাইল ছবি

ইতিমধ্যে প্রবল ঘূর্ণিঝড় থেকে অতিপ্রবল ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নিয়েছে ঘূর্ণিঝড় মোখা। আজ শনিবার দুপুরে সচিবালয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সম্মেলনকক্ষে ঘূর্ণিঝড় নিয়ে আন্তমন্ত্রণালয় সভা শেষে প্রথম আলোকে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মো. এনামুর রহমান বলেছেন, আজ আন্তমন্ত্রণালয় সভায় ১০ নম্বর মহাবিপৎসংকেত দেওয়ার কথা জানানো হয়েছে। চট্টগ্রাম ও পায়রা সমুদ্রবন্দরকে ৮ নম্বর মহাবিপৎসংকেত দেখাতে বলা হয়েছে। সভায় আবহাওয়া অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে কক্সবাজারে ১০ নম্বর মহাবিপৎসংকেত দেওয়ার কথা জানানো হয়। বাংলাদেশের দক্ষিণ উপকূলে এগিয়ে আসছে অতিপ্রবল ঘূর্ণিঝড় মোখা। এর পরিপ্রেক্ষিতে কক্সবাজার সমুদ্রবন্দরে ১০ নম্বর মহাবিপৎসংকেত দেওয়া হয়েছে। চট্টগ্রাম ও পায়রা সমুদ্রবন্দরকে ৮ নম্বর মহাবিপৎসংকেত দেখাতে বলা হয়েছে। তবে মোংলা সমুদ্রবন্দরে ৪ নম্বর স্থানীয় হুঁশিয়ারি সংকেত বলবৎ রাখা হয়েছে।

ঘূর্ণিঝড়ের অভিমুখ ও বায়ুচাপের আধিক্য পর্যালোচনা বলছে, বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলীয় জেলাসমূহের ক্ষয়ক্ষতির সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। কক্সবাজার ও এর অদূরবর্তী নিম্নাঞ্চল স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে প্রায় ৮ থেকে ১২ ফুট উচ্চতায় প্লাবিত হতে পারে। ১৪ মে সন্ধ্যা ৬টার মধ্যে যেকোনো সময় এটি কক্সবাজার-উত্তর মিয়ানমার উপকূল অতিক্রম করবে, এমনটাই বলছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। এমতাবস্থায় উপকূলীয় অঞ্চলে নেওয়া হয়েছে ব্যাপক প্রস্তুতি। চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে আশপাশের এলাকাগুলোতে নেওয়া হয়েছে ব্যাপক প্রস্তুতি। প্রস্তুত রাখা হয়েছে আশ্রয়কেন্দ্র, শুকনা খাবার, নগদ অর্থ, প্রস্তুত রয়েছে রেড ক্রিসেন্টের প্রায় ২৭ হাজার স্বেচ্ছাসেবক।

ঘূর্ণিঝড়ের পুর্বাভাস পাওয়ার পর প্রস্তুতি

পূর্বপ্রস্তুতির অংশ হিসেবে দুর্যোগসংক্রান্ত বার্তা নিয়মিতভাবে জানা এবং স্থানীয় রেড ক্রিসেন্ট ও সিপিপি স্বেচ্ছাসেবকদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা। স্বেচ্ছাসেবকদের সহযোগিতায় নিরাপদ আশ্রয়ে কখন যাবেন এবং আবাসস্থল থেকে নিরাপদ আশ্রয়ের দূরত্ব এবং কীভাবে যাবেন, তা জেনে রাখা। শুকনা খাবার যেমন, মুড়ি, বিস্কুট, চিড়া, প্রয়োজনীয় ওষুধ, ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রী (হাত ধোয়ার সাবান, খাবার স্যালাইন, পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট, ডিগনিটি কিট, মাস্ক) সঙ্গে রাখা। যেহেতু ঘূর্ণিঝড়ে বিদ্যুৎ বিভ্রাট খুবই পরিচিত, মোবাইলসহ ইলেকট্রনিক ডিভাইস চার্জ দিয়ে রাখা। জেলে নৌকা বন্দরে ভেড়ানো এবং সব সময় সঙ্গে রেডিও রাখা। আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার আগে প্রয়োজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র (জাতীয় পরিচয়পত্র, দলিল, শিক্ষাগত যোগ্যতা সনদ) পলিথিনে মুড়ে শরীরের সঙ্গে বেঁধে নেওয়া অথবা উঁচু স্থানে পুঁতে রাখা। গবাদিপশুকে উঁচু জায়গায় রাখা। ঘূর্ণিঝড়ের ঠিক পরেই এলাকায় যে দুর্ভোগ তৈরি হয়, তার মধ্যে সুপেয় খাবার পানির সংকট অন্যতম। তাই বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করার জন্য ঢাকনাসহ মাটির বড় পাত্র বা মুখবন্ধ ড্রামের ব্যবস্থা করা। বাড়ি ছেড়ে আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার আগে অবশ্যই বৈদ্যুতিক সুইচ বন্ধ আছে কি না, যাচাই করে যাওয়া। বাড়ির আশপাশে গাছের বড় ডালপালা থাকলে কেটে রাখা, যাতে তা বাড়ির ক্ষতি না করে।

ঘূর্ণিঝড়-পরবর্তী করণীয়

ঘূর্ণিঝড়ের অব্যবহিত পরই যে কাজটি গুরুত্বপূর্ণ তা হলো, উপদ্রুত এলাকায় আটকে পড়া মানুষ উদ্ধার করা এবং যোগাযোগব্যবস্থা সচল করা, যাতে উদ্ধারকর্মীসহ ত্রাণ কার্যক্রমে আসা মানুষের যাতায়াত সহজ হয়। আশ্রয়কেন্দ্র থেকে নিজের বাড়িতে ফেরত আসতে মানুষকে সহযোগিতা করা। ঘরবাড়ি ঝড়ে ভেঙে যাওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের প্রতি সহযোগিতামূলক আচরণ প্রদর্শন করা, প্রয়োজনে মানসিক সহায়তার ব্যবস্থা করা। বৃষ্টির পানি ধরে রাখা এবং পুকুর-নদীর পানি ফুটিয়ে পান করা। দীর্ঘমেয়াদি পুনর্বাসন পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ঘরের আশপাশে সবজি চাষ করা, যাতে পরিবার পুষ্টি ঘাটতিতে না পড়ে।

দুর্যোগকালীন সরকারি-বেসরকারি সংস্থা এবং সরকারের বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে সমন্বয় করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ সমন্বয় সম্পদের সুষ্ঠু বণ্টন যেমন নিশ্চিত করবে, ঠিক তেমনি অপচয় রোধ করবে। ফলে উপদ্রুত অঞ্চলের মানুষ এর সুফল পাবেন। ত্রাণ বণ্টন কাজে নিয়োজিতদের ত্রাণ প্রদানের ক্ষেত্রে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং যারা দুর্যোগে বেশি নাজুক পরিস্থিতিতে থাকে অর্থাৎ নারী, শিশু, পরিবারের প্রবীণ সদস্য, শারীরিকভাবে অক্ষম ব্যক্তিদের প্রতি আলাদা নজর দিতে হবে। ত্রাণ নিতে গিয়ে নারীরা যাতে কোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনার সম্মুখীন না হন, এ বিষয়ে স্থানীয় আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কার্যকরী ভূমিকা রাখতে হবে। সর্বোপরি ঘূর্ণিঝড়ে আতঙ্কিত না হয়ে ঠান্ডা মাথায় পরিস্থিতি মোকাবিলা করা ও প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিলে দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি অনেকাংশে হ্রাস করা সম্ভব হবে।  

লেখক: মনিরা শারমিন, স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা প্রোগ্রাম, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় ও লেখক এবং প্রাক্তন শিক্ষার্থী, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়