ঈদে বাড়ি ফেরাটাই যেন উৎসব
ঈদ এলেই কানে বাজতে থাকে বাড়ি ফেরার গান—‘স্বপ্ন যাবে বাড়ি আমার’।
প্রয়োজনের তাগিদে আমরা শহরের নাগরিক হয়ে উঠি। এই ব্যস্ত শহরে, কংক্রিটের শহরে নিজেদের বন্দী করি। খুব সহজে আর বাড়ির ঠিকানায় ফিরতে পারি না।
পেছনে ফেলে আসি আপনজন, নিজের চেনা পথঘাট, বাড়ির উঠান, মা, মাটি। যাঁরা জীবিকার তাগিদে বাড়ি ছেড়েছেন, তাঁদের একমাত্র স্বপ্ন—ঈদে বাড়ি ফেরা, আপনজনের কাছে ফেরা।
ফেরার কথা মনে হলেই বেশ কিছুদিন আনন্দে কাটে, ঘোরে কাটে দিনগুলো।
দিন গুনতে থাকি। প্রতীক্ষায় থাকি ফেরার দিনের জন্য। কর্মব্যস্ততার জীবন থেকে ছুটি নিয়ে বাড়ি ফেরার অপেক্ষার দিকে তাকিয়ে থাকি।
আশপাশে লোকজনের বাড়ি ফেরার উত্তেজনা দেখি। তখন মনে হয়, আমিও বাড়ি ফিরছি তাঁদের সঙ্গে। বাস, ট্রেন, লঞ্চে—রংপুর, রাজশাহী, পঞ্চগড়, জামালপুর, খুলনা কিংবা বরিশালে।
আপনজনের টানে ছুটে যাই নিজের বাড়ি। উদ্দেশ্য, শুধু পরিবারের সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করা।
আমার ধারণা, এ দেশে একধরনের সংস্কৃতি হয়ে উঠেছে ঈদে বাড়ি ফেরা। ধর্ম–বর্ণ–জাতিনির্বিশেষে সবার প্রিয়জনদের কাছে ফেরার উপলক্ষ ঈদ।
শহর থেকে লাখ লাখ মানুষ গ্রামের পথে ছুটে যায়। কিন্তু এই শহর তো আর আমাদের অত সহজে ছাড়ে না।
আমরা যাঁরা রাজধানী থেকে বাড়ি ফিরি, তাঁদের একধরনের যুদ্ধ করে ফিরতে হয়।
বাড়ি ফেরা নিয়ে ঈদের সময় প্রতিবছরই ব্যাপক বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। বিশেষ করে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায় বাস কিংবা ট্রেনের টিকিট কাটা। টিকিট হাতে পেলে মনে হয় যেন বিশ্বজয় করে ফেলেছি।
ঈদে বাড়ি ফেরা নিয়ে আমি সব সময়ই খুব আবেগপ্রবণ। আমার ধারণা, শহরের ঈদ ফ্যাকাশে, রংহীন। শহরের বাতাসে ঈদের আমেজ নেই।
মফস্সল শহর অথবা গ্রামে ঈদের আমেজ আলাদা। তাই বাড়ি ফেরাটাই যেন উৎসব।
কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে রাতের ট্রেনে বাড়ি যাচ্ছি। প্ল্যাটফর্মে অসংখ্য অপরিচিত মানুষ। সবার যাত্রার একটি বিশেষ উপলক্ষ। সবার গন্তব্য নিজ বাড়ি।
চেহারায় ক্লান্তির ছাপ, তবু আনন্দের রেশ ভেসে ওঠে চোখেমুখে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ট্রেনের আগমনের ঘোষণা শোনা গেল। অপেক্ষার রেলগাড়ি সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়ছে, ট্রেনের দিকে ছুটে যাচ্ছে...।
কিছুক্ষণ পর নির্ধারিত সময় মেনে হুইসেল বাজিয়ে ট্রেন যাচ্ছে। আস্তে আস্তে শহরের ইটপাথরের বড় বড় দালান ছোট হয়ে আসছে। যান্ত্রিক ভিড়, কোলাহল কমে আসছে।
লাল-নীল আলো নিভে যাচ্ছে। অন্ধকারে ঢুকে যাচ্ছি যাতনার শহর পেছনে ফেলে। পরিবেশ ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে আসছে। আমরা বাড়ির পথ ধরে এগোচ্ছি।
ট্রেনের জানালা দিয়ে বয়ে যায় নদী, সেতু, মাঠ। নদীর পানিতে জ্যোৎস্নার আলো ভেসে উঠছে। হালকা মাঝারি বাতাস এসে গায়ে লাগছে।
শহরে বিদ্যুতের ঝলমলে আলোর বাইরে গিয়ে জ্যোৎস্না–রাতের দেখা মেলে। প্রকৃতির এই সৌন্দর্যের মধ্যে ঝিরিঝিরি বাতাস এসে চুল উড়িয়ে দিচ্ছে। জ্যোৎস্নার অপার্থিব সৌন্দর্য মনের ভেতর এক অদ্ভুত উচ্ছ্বাস দিয়ে যাচ্ছে।
এই ব্যস্ত শহর থেকে আবার গ্রামের সেই প্রিয় মানুষ, বিকেলের সেই খেলার মাঠ আর খেলার সাথিদের সংস্পর্শে ফিরে যাব, সে ভাবনাতেই মন ব্যাকুল হয়ে আছে। মা অপেক্ষা করছেন বারান্দায় দাঁড়িয়ে অথবা খাবার টেবিলে বসে।
আপনজনের টানে ছুটে যাচ্ছি।
দীর্ঘ যানজট ঠেলে, ক্লান্তি-অবসাদ সঙ্গে নিয়ে বাড়ি ফিরতে হয়। বাড়ির উঠানে পা রাখলেই মানুষ ভুলে যায়, কত দীর্ঘ পথ সে পাড়ি দিয়ে এসেছে।
সব ক্লান্তি নিমেষেই হারিয়ে যায়। মায়ের ছলছল চোখ বলে দেয়, অপেক্ষার প্রহর শেষ। সব পথ আমার চেনা।
এবারের ঈদেও হয়তো অনেকের বাড়ি ফেরা হবে না। অদ্ভুত এক শহর। ঈদ সবার জন্য উৎসব হলেও উপভোগ এক রকম নয়। এই শহর অনেককে আটকে রাখবে ট্রাফিক জ্যামের মতো। তাঁদের স্বপ্ন বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছাবে না।
আমার কাছে ঈদ মানেই বাড়ি ফেরা, পরিবার-পরিজনের টানে ফেরা। আমার শৈশবের কাছে ফেরা। সব শান্তি যেন বাড়ির উঠানেই।
সবার ঈদ নির্বিঘ্নে, নিরাপদে কাটুক।