বেসরকারি শিক্ষকদের বেতন–ভাতার কালানুক্রমিক ইতিহাস ও বর্তমান চাহিদা
শুরুর দিক
পাকিস্তান আমলে বেসরকারি শিক্ষকেরা সরকারি কোষাগার থেকে মাসিক মাত্র পাঁচ টাকা ‘মাগগি–ভাতা’ (মহার্ঘ ভাতা) পেতেন। ১৯৫৭ ও ১৯৫৮ সালে বাড়িভাড়া বৃদ্ধির দাবিতে ব্যাপক শিক্ষক আন্দোলন হয়, যার ফলে ভাতার পরিমাণ ধাপে ধাপে বাড়িয়ে মাধ্যমিকের শিক্ষকদের ১৫ টাকা ও কলেজের শিক্ষকদের ২০ টাকা করা হয়।
আইয়ুব খানের আমল
ষাটের দশকে কলেজশিক্ষকেরা মাসিক ৩০ টাকা ও মাধ্যমিকের শিক্ষকেরা ২০ টাকা সরকারি অনুদান পেতেন। সব পদবি–নির্বিশেষে অনুদানের পরিমাণ একই ছিল।
স্বাধীনতা–পরবর্তী সময়
স্বাধীনতার পরও শিক্ষকদের ভাগ্যের বিশেষ উন্নতি হয়নি, তবে অনুদান কিছুটা বৃদ্ধি পেয়ে কলেজশিক্ষকেরা ৫০ টাকা ও স্কুলশিক্ষকেরা ৩০ টাকা পান।
১৯৭৭ সালের সংস্কার
এই বছর শিক্ষকদের আর্থিক সুবিধা প্রায় দ্বিগুণ করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, কলেজের অধ্যাপকেরা ২০০ টাকা ও মাধ্যমিক স্কুলের স্নাতকোত্তর শিক্ষকেরা ১১০ টাকা ভাতা পেতে শুরু করেন।
আশির দশক (১৯৮০–১৯৮৯): ভিত্তি প্রতিষ্ঠা
১৯৮০ সালে প্রথমবারের মতো বেসরকারি স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসার শিক্ষকদের জাতীয় বেতন স্কেলের অন্তর্ভুক্ত করা হয় এবং তাঁদের বেতনের ৫০ শতাংশ সরকারি তহবিল থেকে দেওয়ার ব্যবস্থা চালু হয়। এটি বেসরকারি শিক্ষকদের জন্য একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তন হিসেবে গণ্য হয়। ১৯৮২ সালে ১৫ শতাংশ মহার্ঘ ভাতা চালু হয়, যা ১৯৮৩ সালে শিক্ষকদের দাবির মুখে বেড়ে ৩০ শতাংশ হয়। ১৯৮৪ সালে এমপিও প্রথার সূচনা হয়। সরকারি অংশ সরাসরি ব্যাংকের মাধ্যমে দেওয়া শুরু হয়, যা স্কুল ম্যানেজিং কমিটির একচ্ছত্র আধিপত্য কমায় ও চাকরির নিরাপত্তা বাড়ায়। ১৯৮৬ সালে মেডিকেল ভাতা ৬০ টাকা থেকে ১০০ টাকায় উন্নীত করা হয় এবং সরকারি বেতনের অংশ ১০ শতাংশ বাড়িয়ে ৭০ শতাংশ করা হয়। শিক্ষক–কর্মচারীদের জন্য একটি কল্যাণ ট্রাস্ট গঠনের ঘোষণা দেওয়া হয়।
আন্দোলনের তীব্রতা ও অগ্রগতি (১৯৯০–১৯৯৯)
১৯৯৪ সালে ১০০ শতাংশ বেতন দাবিতে একটি শক্তিশালী আন্দোলন হয়, যাতে পাবলিক পরীক্ষা বর্জন ও হরতালের মতো কর্মসূচি অন্তর্ভুক্ত ছিল। এই আন্দোলনের ফলস্বরূপ, ১৯৯৪ সালে মেডিকেল ভাতা ১৫০ টাকায় উন্নীত করা হয় এবং টাইম স্কেল দেওয়া হয়। ১৯৯৫ সালে সরকারি বেতনের অংশ আরও ১০ শতাংশ বেড়ে ৮০ শতাংশ হয়। ১৯৯৬ সালে সরকার ক্ষমতায় আসার পর ১৯৯৭ সালে একটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়—বেসরকারি শিক্ষকদের স্বয়ংক্রিয়ভাবে জাতীয় বেতন স্কেলে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। বেতনের সরকারি অংশ সরাসরি শিক্ষকের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে দেওয়ার ব্যবস্থা চালু হয়, যা অনিয়ম দূর করে এবং শিক্ষকের মর্যাদা বৃদ্ধি করে। এই দশকে শিক্ষক সংগঠনগুলো একাধিক দলে বিভক্ত হয়ে পড়ে, যা আন্দোলনের একতাকে দুর্বল করে।
মাইলফলক অর্জন (২০০০–২০০৯)
২০০০ সালে একটি গোলটেবিল বৈঠকের মাধ্যমে সরকারি বেতনের অংশ ৯০ শতাংশে উন্নীত করা হয়। ২০০২ সালে আরও দুটি বড় অর্জন হয়—বেসরকারি শিক্ষক–কর্মচারীদের জন্য অবসর–সুবিধা (পেনশন) চালু করা হয়। উৎসব ভাতা চালু করা হয় (শিক্ষকদের ২৫ শতাংশ ও কর্মচারীদের ৫০ শতাংশ)। শিক্ষকদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৬ সালে সরকারি বেতনের অংশ ১০০ শতাংশ পূরণ করা হয়, যা একটি ঐতিহাসিক মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত হয়।
সমস্যা ও চূড়ান্ত দাবি (২০১০–বর্তমান)
২০১২–১৩ সালে বাড়িভাড়া ৩০০ টাকা ও মেডিকেল ভাতা ৩০০ টাকায় উন্নীত করা হয়। ২০১৫ সালে বেসরকারি শিক্ষক–কর্মচারীরা অষ্টম জাতীয় বেতন স্কেলে অন্তর্ভুক্ত হন। ২০১৬ সালে বাড়িভাড়া এক হাজার টাকা ও মেডিকেল ভাতা ৫০০ টাকায় উন্নীত করা হয়।
বর্তমান চাহিদা ও অসন্তোষ
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই সুবিধা বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে এমপিওভুক্ত শিক্ষক–কর্মচারীরা তাঁদের জাতীয় বেতন স্কেল অনুযায়ী সরকারি কোষাগার থেকে শতভাগ বেতন, বাড়িভাড়া, চিকিৎসা ও উৎসব ভাতার মতো অন্যান্য সুবিধাও পাচ্ছেন।
সংক্ষেপে, বেসরকারি শিক্ষকদের সরকারি সহায়তা পাকিস্তান আমলের মাসিক পাঁচ টাকা থেকে যাত্রা শুরু করে বর্তমানে পূর্ণ বেতন ও ভাতার ব্যবস্থায় উন্নীত হয়েছে, যার মধ্যে ১৯৮০ সালে বেতন স্কেলে অন্তর্ভুক্তি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক ছিল। বাংলাদেশে এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বর্তমানে প্রায় ৩০ হাজার। এসব প্রতিষ্ঠানে প্রায় ছয় লাখ শিক্ষক ও কর্মচারী কর্মরত রয়েছেন। ২০০৬ সাল থেকে তাঁদের বেতনের সম্পূর্ণ অর্থ সরকারি তহবিল থেকে দেওয়া হলেও তাঁরা বাড়িভাড়া ভাতা ও অন্যান্য সুযোগ–সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। অন্যদিকে সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা–কর্মচারীরা জাতীয় বেতন স্কেল ২০১৫ অনুসারে বাড়িভাড়া ভাতা পেয়ে থাকেন। শিক্ষা হলো রাষ্ট্রের সব নাগরিকের একটি মৌলিক অধিকার, আর এই শিক্ষাব্যবস্থার মূল চালিকা শক্তি হলেন শিক্ষকসমাজ। যাঁদের সম্মানজনকভাবে ‘মানুষ গড়ার কারিগর’ আখ্যা দেওয়া হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার ৫৪ বছর পরও বেসরকারি খাতের শিক্ষকদের তাঁদের ন্যূনতম জীবিকার দাবি ও অধিকার নিশ্চিত করতে বারবার আন্দোলনের পথ বেছে নিতে হয়েছে। তাঁদের প্রাপ্য অধিকাংশই তাঁরা আন্দোলনের মাধ্যমেই অর্জন করতে সক্ষম হয়েছেন। যদিও বেসরকারি স্কুল ও কলেজের শিক্ষকদের শতভাগ বেতন–ভাতা সরকার কর্তৃক প্রদান করা হচ্ছে, তবুও অন্যান্য সুবিধার ক্ষেত্রে তাঁদের সঙ্গে বৈষম্য এখনো অব্যাহত রয়েছে। দেশে প্রায় ২৫ হাজার বেসরকারি স্কুল ও কলেজ রয়েছে, যেখানে প্রায় পাঁচ লাখ শিক্ষক ও কর্মচারী কর্মরত। এগুলোর মধ্যে সরকারি প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা হাজারেরও কম। এ পরিসংখ্যানটি ইঙ্গিত করে যে দেশের প্রায় ৯৫ শতাংশ শিক্ষার্থীই বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই তাদের শিক্ষা গ্রহণ করে থাকে।
নাগরিক সংবাদে জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই–মেইল: [email protected]
গত ৩০ সেপ্টেম্বর অর্থ মন্ত্রণালয় এক প্রজ্ঞাপন জারি করে এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের জন্য মাসিক বাড়িভাড়া ভাতা মাত্র ৫০০ টাকা নির্ধারণ করে। এই সিদ্ধান্ত বর্তমান বাজারদর ও জীবনযাত্রার ব্যয়ের তুলনায় একেবারেই অসংগতিপূর্ণ। এটিকে শিক্ষক সম্প্রদায়ের প্রতি একটি অবমাননাকর সিদ্ধান্ত হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। অন্য সরকারি চাকরিজীবীরা তাঁদের বেতনের অনুপাতে বাড়িভাড়া ভাতা ও অন্যান্য সুবিধা ভোগ করলেও এমপিওভুক্ত শিক্ষকেরা এই মৌলিক সুবিধা থেকে সম্পূর্ণরূপে বঞ্চিত। এটি একটি সুস্পষ্ট বৈষম্য। দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষক ও কর্মচারীরা শান্তিপূর্ণ আন্দোলন ও দাবি জানিয়ে এলেও তাঁদের ন্যায্য অধিকার প্রদানে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি।
চাকরির শর্তাবলি ও মৌলিক অধিকার হিসেবে অন্য সরকারি কর্মচারীদের মতো এমপিওভুক্ত শিক্ষকেরাও বেতনের আনুপাতিক হারে বাড়িভাড়া ভাতা প্রাপ্য। বর্তমান সময়ে যখন দেশ জাতীয় নির্বাচনের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মুখোমুখি, তখন শিক্ষকদেরকে তাঁদের অধিকারের দাবিতে রাস্তায় নেমে আন্দোলন করতে বাধ্য করা—এটি একটি অস্থিতিশীল ও অস্বস্তিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করবে। বেসরকারি স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্ত শিক্ষক–কর্মচারীরা তাঁদের মূল বেতনের ২০ শতাংশ হারে বাড়িভাড়া ভাতা বৃদ্ধিসহ তিন দফা দাবিতে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন চালিয়ে আসছেন। এই দাবি বাস্তবায়নের আহ্বান জানিয়ে তাঁরা জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে অবস্থান কর্মসূচি শুরু করেন।
বেসরকারি শিক্ষকেরা শিক্ষাব্যবস্থার পূর্ণ জাতীয়করণ চান। সরকারি শিক্ষকদের মতো ৫ শতাংশ বার্ষিক বেতন বৃদ্ধি, বেসিকের ৪০ শতাংশ হারে বাড়িভাড়া, ১০০ শতাংশ উৎসব ভাতা ও অনেক সুযোগ–সুবিধা এখনো পান না। বাড়িভাড়া ও মেডিকেল ভাতাকে ‘অসম্মানজনক’ মনে করা হয় এবং বেসিক বেতনের শতকরা হারে এগুলো চালুর দাবি অব্যাহত রয়েছে। আজ শিক্ষকদেরকে বলা হচ্ছে, এটা সম্মানের পেশা, কিন্তু শিক্ষকদের প্রতি-উত্তর হলো—‘সম্মান ধুয়ে কি পানি খাব, যদি বেঁচে থাকার মতো বেতন–ভাতা না পাই।’
অনেকের মতে, বেসরকারি শিক্ষকেরা এখন সুযোগ মনে করতেছে যে বেসিকের হারে যদি বাড়িভাড়া পান, তাহলে নতুন পে স্কেলে অনেক টাকা বাড়িভাড়া পাবে। কারণ, নতুন পে স্কেল অতি আসন্ন। আবার অন্যদিকে সরকারের চিন্তা থাকতে পারে যে পাঁচ লাখ শিক্ষক–কর্মচারীদেরকে যদি বেসিকের ২০ শতাংশ হারে প্রদান করি, তাহলে দেখতে মনে হবে ২ হাজার ৫০০ থেকে ৩ হাজার ৫০০ টাকা বাড়তি গুনতে হচ্ছে, কিন্তু বাস্তবিকে বিশাল অঙ্ক হবে এবং এ জন্য কত টাকা দরকার, যা অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে সম্মতি পাওয়া যাবে কি না বা নতুন যে সরকার আসতেছে, তাদের রাজনৈতিক দলের সাপোর্ট পাওয়া যাবে কি না—এগুলো নিয়ে সন্দেহ আছে। যদিও এখন প্রায় সব রাজনৈতিক দল ২০ শতাংশ বাড়িভাড়া ও জাতীয়করণের পক্ষে। যতটুকু বোঝা যায়, এ মুহূর্তে সরকার কোনো পার্সেন্টে না–ও যেতে পারে, হয়তো থোক বরাদ্দ হতে পারে।
এত জটিল সমীকরণের পরেও বেসরকারি শিক্ষকেরাও মানুষ, তাঁদের ভালোভাবে বাঁচার অধিকার আছে, চারটা ডাল–ভাত খাওয়ার অধিকার আছে, সুস্থ থাকার অধিকার আছে। সম্মানের সঙ্গে বেঁচে থাকার অধিকার আছে। রাষ্ট্রযন্ত্র যেন এবার তাঁদের আকুল আকুতিগুলো শোনে। শিক্ষক জাতি যেন মাথা উঁচু করে বাস করতে পারে। আমরা সবাই যেমন কোনো না কোনো মায়ের সন্তান, ঠিক তেমনি কোনো না কোনো শিক্ষকের ছাত্র। আমাদের শিক্ষকেরা রাস্তায় থাকলে, অভাব অভিযোগ করলে, চাকরি ও জীবন নিয়ে লজ্জিত বোধ করলে, আমরা পুরো বাঙালি জাতিই লজ্জিত হই। তাই আমাদের প্রত্যাশা, অতি দ্রুত এ সমস্যার সমাধান হোক।
*লেখক: ফয়সাল হাবিব, প্রভাষক, ব্যবস্থাপনা বিভাগ, বাঞ্ছারামপুর সরকারি ডিগ্রি কলেজ