ওইখান দিয়েই পার হতাম উত্তাল পদ্মা!
আমরা সফল। রচিত হলো আরেকটি গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। স্বপ্ন হলো সত্যি। এবার বিশ্বের অন্যতম ভয়ংকর খরস্রোতা প্রমত্ত পদ্মার ওপর নির্মিত ‘পদ্মা সেতু’ নিয়ে মহাকাব্য লেখার পালা। জীবনের স্মরণীয় কিছু ঐতিহাসিক দিন ও মুহূর্ত থাকে, যা মনের মধ্যে বিশেষ অনুভূতি সঞ্চারিত করে; আর সেই কাহিনিকর ও মর্যাদার মুহূর্তটি তাৎপর্যের কারণেই চির–অমলিন থেকে যায়। তেমনই জাতির সাহস আর সামর্থ্যের প্রতীক, পদ্মা সেতুর উপক্রমণিকার প্রহর শেষে আজ শনিবার উদ্বোধনের মাধ্যমে বহুল প্রতীক্ষিত প্রমত্ত পদ্মা জয়ের গল্পের যবনিকাপাত হলো; যা গোটা জাতির জীবনে এক অনন্য উচ্চতা ও গৌরবের অনুভূতি। কারণ, দেশের অসচ্ছল, সুখ–স্বাচ্ছন্দ্যবঞ্চিত ও সাধারণ জনগণের কষ্টার্জিত প্রায় ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকার বিনিয়োগে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের নির্মিত পদ্মা সেতু। সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থে নির্মিত হওয়ায় দেশ হিসেবে সফলতা অর্জন করেছে বাংলাদেশ; যা দেশ ও জাতির জন্য এক অসামান্য সাফল্যের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এর সফল নির্মাণ ও উদ্বোধনের মাধ্যমে আমরা পৌঁছে গেছি গৌরবের অনন্য উচ্চতায়। দেশি-বিদেশি সব ষড়যন্ত্র মোকাবিলার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্ভীক সংকল্প বাস্তবায়ন করে বাংলাদেশকে মর্যাদার জায়গায় তুলে ধরেছেন। দেশকে বসিয়েছেন হিমালয়ের চূড়ায়।
‘আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে/ কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে?’ কবি কুসুমকুমারী দাশ আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দেখতে পেলে হয়তো তাঁর প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যেতেন। খ্যাতিমান মহাকাশবিজ্ঞানী ও ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি এ পি জে আবদুল কালাম বলতেন, ‘সেটা স্বপ্ন নয়, যা ঘুমিয়ে দেখ; বরং সেটাই স্বপ্ন, যা তোমাকে ঘুমাতে দেয় না।’ দুর্নীতির ভিত্তিহীন অভিযোগের জেরে ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন থেকে সরে দাঁড়ায় বিশ্বব্যাংক। বিশ্বব্যাংকের এ অন্যায় সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারেননি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বহুমাত্রিক রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র ও জটিল রকমের প্রাকৃতিক প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে দেশের অর্থেই সেতু নির্মাণের সংকল্প করেন শেখ হাসিনা।
মোগল সম্রাট শাহজাহান তাঁর স্ত্রী আরজুমান্দ বানুর (যিনি মমতাজ মহল নামে পরিচিত) ভালোবাসা ও স্মরণে ২২ বছর ধরে (১৬৩২-৫৩ সাল) ২০ হাজার শ্রমিকের অক্লান্ত পরিশ্রমে তৈরি করেছিলেন ঐতিহাসিক ‘তাজমহল’। তাহলে বিশ্বের অন্যতম ভয়ংকর খরস্রোতা প্রমত্ত নদী পদ্মার ওপর সেতুর বিশাল কর্মযজ্ঞ কতটা চ্যালেঞ্জের, তা বলে বা লিখে শেষ করার মতো নয়।
দিনের পর দিন পদ্মা সেতুর কল্পিত দুর্নীতি–সংবলিত মনগড়া গল্পকাহিনি কম হয়নি। সরকার কোনো পদক্ষেপ না নিলে মনে হবে সরকার দুর্নীতিবাজদের রক্ষা করতে চাচ্ছে। বাধ্য হয়ে সরকার কিছু পদক্ষেপ নিয়েছিল, যদিও দুর্নীতির কোনো প্রমাণ পায়নি। মন্ত্রী আবুল হোসেনকে ইস্তফা, সচিব মোশারফ হোসেন ভূঁইয়াকে বদলি, প্রকল্প পরিচালক রফিকুল ইসলামকে অপসারণ, দুদকের অনুসন্ধান টিম গঠন, পরে সাতজনের বিরুদ্ধে নিয়মিত মামলা, যে মামলায় সচিব মোশারফ হোসেন ভূঁইয়া গ্রেপ্তার হন ও জেল খাটেন। সর্বশেষ এসব কল্পিত গল্প উড়িয়ে দিয়ে পাঁচ বছরের বেশি সময়ের বিচারিক প্রক্রিয়া শেষে কানাডার আদালত বলেছেন, ‘এ মামলায় যেসব তথ্য দেওয়া হয়েছে, তা অনুমানভিত্তিক, গালগল্প এবং গুজবের বেশি কিছু নয়।’
আমাদের চিরচেনা পথ পদ্মাপারের মাওয়া-কাঁঠালবাড়ি ফেরিঘাটে উদাস বা ভাবুক হয়ে যাওয়ার মতো অবিশ্বাস্য যেসব দৃশ্য ও স্মৃতি রয়েছে, যা কখনো ভুলে যাওয়ার নয়।
আসলেই পদ্মা নদীর সঙ্গে ফেরি, লঞ্চ পারাপারে দীর্ঘ প্রতীক্ষা, অ্যাডভেঞ্চার—সবই আজ গল্প হয়ে থাকল পরবর্তী প্রজন্মের কাছে। ফেরিঘাটে একটু চা খাওয়া, তারপর আবার ভোঁ–দৌড়ে ফেরি বা লঞ্চে ওঠার মধ্যে একটা থ্রিল ছিল। আমরা সেটাকে দারুণ মিস করব। স্মৃতিতে অম্লান হয়ে থাকবে মাওয়া-কাঁঠালবাড়ি ফেরি, লঞ্চ ও স্পিডবোটে পারাপারের অন্য এক অভিযাত্রার স্মৃতি। গল্প হয়ে থাকবে, ঘুরেফিরে আসবে আমাদের দুঃখ, সুখ, বেদনার ও তিক্ত অভিজ্ঞতার নানা কাহিনি। আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বলব, ‘ওই তো, ওইখান দিয়েই আমরা পার হতাম প্রমত্ত পদ্মা নদী।’
ফেরিঘাটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা, কখনো দিনভর বসে থাকা স্মৃতি হয়ে থাকবে। শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা, কখনো ঘন কুয়াশা, কখনো প্রচণ্ড খরতাপে, কখনো ঝড়বৃষ্টির রাতে ঝুঁকিপূর্ণ পারাপারের মধ্যেও একটা অ্যাডভেঞ্চার ছিল। ফেরিঘাটে গরম-গরম ডিম সেদ্ধ, ঝালমুড়ি, চা–গরম, নারকেলের চিড়া ভাজা, ফেরিতে অথবা লঞ্চে ইলিশ মাছ, ভর্তা, যত পারো পেটচুক্তিতে ভাত খাওয়া সব হারিয়ে যাবে। দ্রুতগামী ট্রেনে বা বিলাসী গাড়িতে শাঁই শাঁই করে পদ্মা সেতু পার হওয়ার সময় এসব স্মৃতিরোমন্থন ও মনে এলে মনটা যে কারোরই খারাপ না হয়ে পারে না। এরপরও পদ্মা সেতু, এক্সপ্রেসওয়ে ও ভাঙ্গা ফ্লাইওভারপ্রাপ্তিতে দেশের দক্ষিণ–পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের স্বপ্নপূরণে সৌভাগ্যবান।
এর চেয়ে আর কী পাওয়ার আছে? আর কত আনন্দ হতে পারে! দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের উৎপাদিত কৃষি ও শিল্পজাত পণ্য সহজে ও দ্রুততম সময়ে ঢাকা ও দেশের অন্যান্য অঞ্চলে পরিবহনের সুযোগ সৃষ্টি হবে। এতে কৃষকেরা তাঁদের পণ্যের ন্যায্যমূল্য পাবেন। কৃষি উৎপাদন বাড়বে। এ অঞ্চলে গ্যাস, বিদ্যুৎ ও অপটিক্যাল ফাইবার যাবে। ফলে নতুন নতুন শিল্পকারখানা তৈরি হবে। বাণিজ্যকেন্দ্র বৃদ্ধি পাবে। মানুষের কর্মসংস্থান বাড়বে। মোংলা বন্দর ও পায়রা বন্দর দিয়ে পণ্য আনা-নেওয়া সহজ হবে। বন্দরকেন্দ্রিক শিল্প ও বাণিজ্যকেন্দ্র তৈরি হবে। অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে উঠবে। পদ্মা সেতু এশিয়ান হাইওয়ে এবং ট্রান্স-এশিয়ান রেলওয়ে নেটওয়ার্কের সঙ্গে সংযুক্ত থেকে আঞ্চলিক বাণিজ্য ও সহযোগিতা বৃদ্ধিতে অবদান রাখবে। মোদ্দা কথা, পদ্মা সেতু বাংলাদেশের সক্ষমতা, বিশ্বাস আর অর্জনের এক অনন্য বার্তা।
পদ্মা সেতু শুধু একটি স্থাপনা নয়; এটি এখন বাঙালি জাতি তথা বাংলাদেশের গর্ব, আত্মমর্যাদা ও অহংকারের প্রতীক। এই সেতু নির্মাণের ফলে দেশের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ নদীবেষ্টিত ভূখণ্ড সরাসরি রাজধানীর সঙ্গে সংযুক্ত হলো। পদ্মা সেতু যেমন দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের প্রায় পাঁচ কোটি মানুষের জীবনে অর্থনৈতিক সুবাতাস বয়ে আনবে, তেমনি কমপক্ষে ১ দশমিক ৫ শতাংশ জাতীয় আয় বৃদ্ধিও নিশ্চিত করবে। ফলে লাভবান হবে পুরো দেশের মানুষ। প্রসার হবে ব্যবসা-বাণিজ্য ও পর্যটনের।
বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমাদের কেউ দাবায়ে রাখতে পারবে না।’ তাঁর কন্যা সে কথাই প্রমাণ করেছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদ্মা সেতু নির্মাণের বিশাল চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছেন এবং জয়ী হয়েছেন। তিনি ইস্পাত কঠিন মনোবল নিয়ে এ দেশের সার্বিক উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির চাকাকে অধিকতর সচল রাখতে বিরামহীন কর্মযজ্ঞ সম্পন্ন করে চলেছেন। দেশ ও দেশের মানুষের জন্য তিনি সম্ভাব্য সব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে যাচ্ছেন। সুনিপুণ দক্ষতার সঙ্গে একের পর এক মেগা প্রজেক্ট বাস্তবায়ন করছেন।
একই সঙ্গে এটি শেখ হাসিনার দৃঢ় মনোবল, সাহসিকতা ও সক্ষমতার পরিচায়ক। পদ্মা সেতু ছাড়াও এ বছরই আরও দুটি মেগা প্রজেক্ট প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধন করবেন। তা হলো কর্ণফুলী নদীর নিচ দিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল এবং এমআরটি-৬ প্রকল্পের আওতায় মেট্রোরেল।