নারী শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তায় বিশেষ প্রশিক্ষণ
নওশাবা ইসলাম রাজধানী ঢাকার গ্রিন রোডের বাসা থেকে সপ্তাহে চার দিন তাঁর বিশ্ববিদ্যালয় ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশের (ইউল্যাব) যান। রাস্তায় চলাচল করতে গিয়ে মাঝেমধ্যে নানা ঝামেলার মুখোমুখি হতে হয় তাঁকে। সবচেয়ে বেশি নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন গণপরিবহনে চলাচল করতে গিয়ে। ‘মেয়েদের আলাদা কিছু সমস্যা আছে। যেমন মনে করেন, বাসে গায়ের সঙ্গে ঘেঁষে দাঁড়ানো, বাসে উঠতে গেলে হেলপার খারাপ ব্যবহার করে, চলতি পথে নানা কথা বলে—এ রকম অনেক ঘটনা ঘটে। নিজেই সাবধান হয়ে চলি,’ নওশাবার অসহায় স্বীকারোক্তি। নওশাবার মতো অনেকেই চলার পথে এমন সমস্যার মুখোমুখি হন। নওশাবা জানান, তিনি সাধারণত মুখ বুজেই নিজের পথে চলে যান, ‘রাস্তাঘাটে কী প্রতিবাদ করব? লোকজন বলবে মেয়েটাই খারাপ। এ জন্য কিছু না বলে মাথা নিচু করে চলে যাই।’
কথা হয় রাজধানীর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া নারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে। শিক্ষার্থীরা জানান, ঢাকা শহরে চলাচলেই সবচেয়ে নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন শিক্ষার্থীরা, বিশেষ করে নারী শিক্ষার্থীরা। তাঁদের মতে, রাস্তায় আর গণপরিবহনে যৌন নিপীড়ন হয় সবচেয়ে বেশি। ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির (ডিআইইউ) শিক্ষার্থী ইসরাত জাহান জানান, তিনি রাস্তায় হয়রানির শিকার হলে সাধারণত মুখ বুজেই নিজের পথে চলে যান।
একশনএইড বাংলাদেশ সাম্প্রতিক এক জরিপে বলছে, ৮৭ শতাংশ নারী বাস টার্মিনাল বা রেলস্টেশনের মতো জায়গায় হয়রানির শিকার হয়েছেন বলে জানিয়েছেন। ইসরাত জাহান বলেন, নিরাপত্তার ইস্যুতে প্রতিদিন শিক্ষার্থীদের মুখোমুখি হতে হয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও তারা কিন্তু অনেক কিছু গোপন করে যান। কারণ, তাঁদের ভেতরে কিছু আশঙ্কা কাজ করে। ‘বলে কোনো লাভ হবে না’—এমনটাই মনে করেন অনেকে। তাই বেশির ভাগ নারী বিষয়টি গোপন করেই রাখে। তিনি আরও বলেন, সবকিছুই নিরাপত্তার সঙ্গে সম্পর্কিত। শিক্ষাক্ষেত্র, কর্মস্থল, চলার পথে বা যানবাহনে তাঁরা কতটুকু নিরাপদ, তার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করে। নারীদের নিরাপত্তার সংস্কৃতি দেশে গড়ে ওঠেনি বলেই তাঁরা নানা ধরনের সহিংসতার শিকার হন বলে তাঁর বিশ্বাস।
অনেক সময় ক্লাস শেষ করতে সন্ধ্যা হয়ে যায় ইউল্যাবের শিক্ষার্থী তামান্না রহমানের, ‘আমার ক্লাস ও টিউশন শেষ করতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। সন্ধ্যা হলে ভয়টা বেড়ে যায় বহুগুণে। সে সময়টা আরও বেশি সচেতন থাকতে হয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের মা-বাবা একসময় শিখিয়েছে, রাস্তাঘাটে কেউ কিছু বললে কিছু না বলে চলে যাবা, তাহলে এটা আর আগে বাড়বে না। এটা শুধু আমাকেই না, দেশের প্রায় প্রতিটি নারীকেই এভাবে শেখানো হয়।’
তবে পরিবর্তন শুরু হয়েছে। বর্তমানে কিছুসংখ্যক নারীকে প্রতিবাদ করতে দেখা যাচ্ছে রাস্তাঘাটে। নারী নিরাপত্তার জন্য বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান আত্মরক্ষার কৌশল শেখানো কাজ করছে। সম্প্রতি নারী নিরাপত্তা ও ক্ষমতায়ন বিষয়ে বিশেষ প্রশিক্ষণ নিল ইউল্যাব ও ডিআইইউয়ের শতাধিক নারী শিক্ষার্থী। এ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে অংশগ্রহণকারীদের আরও সাহসী মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে চেষ্টা করছে আয়োজকেরা।
প্রশিক্ষণে মানবদেহের বিভিন্ন দিক তুলে ধরে বিভিন্ন ধরনের নিরাপত্তা কৌশল শেখানো হয়। কৌশলগুলোর মধ্যে রয়েছে বডি টুলস, বডি কন্ডিশনিং, স্ট্রাইকিং, কিক বক্সিং কম্বিনেশনস। এ ছাড়া প্রতিদিন সঙ্গে রাখা প্রয়োজন এমন বস্তু এবং নিজের আশপাশ দেখে কী ধরনের প্রস্তুতি নিতে হবে, সেগুলো সম্পর্কে পরামর্শ দেওয়া হয়।
বাংলাদেশের খালেদ মোশাররফ ট্রাস্ট ও ভারতের ইন্দ্রানি বালান ফাউন্ডেশন এ প্রশিক্ষণের আয়োজন করে। আয়োজন সম্পর্কে সাবেক সংসদ সদস্য ও খালেদ মোশাররফ ট্রাস্টের চেয়ারম্যান মাহজাবিন খালেদ বলেন, ‘বাংলাদেশে ৫২ শতাংশ ভোটার নারী। নারীরা এখন সব ক্ষেত্রে ভালো করছেন। আগামী প্রজন্মকে আরও সুন্দর বাংলাদেশ উপহার দিতে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে।’
মাহজাবিন খালেদ জানান, প্রথম পর্যায়ে যাঁদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে, তাঁদের মধ্য থেকে বাছাই করে কয়েকজনকে ভারতে উন্নত প্রশিক্ষণে পাঠানোর পরিকল্পনা আছে। যাতে তাঁরা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে গিয়েও একই প্রশিক্ষণ দিতে পারেন। আমরা আমাদের কাজকে সারা দেশে ছড়িয়ে দিতে চাই।’ তাঁর মতে, এ ছাড়া সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম শক্তিশালী হওয়ায় আজকাল প্রতিবাদ করার প্রবণতা বাড়ছে।