সমাজবিজ্ঞানী উবেরয়ের বিদায়
ভারতীয় সমাজবিজ্ঞানী ও দার্শনিক নৃবিজ্ঞানী জিতেন্দ্র পাল সিং উবেরয় সম্প্রতি ৯০ বছর বয়সে মারা গেছেন। তিনি ১৯৩৪ সালে ব্রিটিশ ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশের লাহোরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মোহন সিং দেয়ান ছিলেন পাঞ্জাবের সাহিত্য ও সংস্কৃতির পণ্ডিত ব্যক্তি। স্ত্রী অধ্যাপক প্যাট্রিসিয়া ওবেরয় তাঁর শুধু জীবনসঙ্গী নন, একাডেমিক সঙ্গীও ছিলেন। উবেরয় ১৯৫৫ সালে ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডন থেকে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ও টেলিকমিউনিকেশন বিষয়ে গ্র্যাজুয়েশন লাভ করেন। এ সময়ে সমাজবিজ্ঞানী বাসিল বার্নস্টেইনের সঙ্গে সাক্ষাৎ তাঁকে ইঞ্জিনিয়ারিং থেকে নৃবিজ্ঞানের প্রতি মনোযোগী হতে সহায়তা করে। পরবর্তীকালে তিনি অস্ট্রেলিয়ার মোনাস ইউনিভার্সিটি থেকে মাস্টার্স এবং ১৯৬৪ সালে অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির নৃবিজ্ঞান বিভাগ থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। অস্ট্রেলিয়ার মোনাস ইউনিভার্সিটিতে তাঁর শিক্ষকতা জীবন শুরু। সেখানে তিনি ১৯৬৩ থেকে ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত সামাজিক নৃবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞান বিষয়ে পাঠদান করেন।
‘নাগরিক সংবাদ’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]
ষাটের দশকের শেষ দিকে জিতেন্দ্র পাল সিং উবেরয় জন্মভূমির টানে ভারতে ফিরে আসেন এবং ১৯৬৮ সালে অধ্যাপক এম এন শ্রীনিবাসের আমন্ত্রণে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের দিল্লি স্কুল অব ইকোনমিকসের সমাজবিজ্ঞান বিভাগে যোগ দেন। সেখানে তিনি দীর্ঘ তিন দশক অধ্যাপনা করেন। উত্তর-ঔপনিবেশিক ভারতে সমাজবিজ্ঞান অধ্যয়নের জন্য একটি স্বতন্ত্র বিভাগ হিসেবে সমাজবিজ্ঞান প্রতিষ্ঠায় তাঁর ভূমিকা ছিল অনন্য। তিনি ১৯৭৭ থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত দিল্লি স্কুল অব ইকোনমিকসের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান হিসেবে গবেষণা ও শিক্ষার গুণগত মান দ্বারা বিভাগটিকে অন্যান্য বিভাগ থেকে আলাদা করার কৃতিত্ব অর্জন করেন। ওই বিভাগে তিনি ইউরোপীয় স্টাডিজ নামে একটি নতুন প্রোগ্রাম চালু করেন, যার লক্ষ্য ছিল ভারতীয় দৃষ্টিকোণ থেকে পশ্চিমা তত্ত্ব ও অনুশীলনকে অধ্যয়ন করা। অবসর গ্রহণ পর্যন্ত (১৯৯৯) তিনি সমাজবিজ্ঞান বিভাগে শিক্ষকতা ও নিরলস গবেষণা চালিয়ে গেছেন।
সেখানে তাঁর সহকর্মীদের মধ্যে আন্দ্রে বেঁদে, ভিনা দাস, অমিতাভ ঘোষ ও এ এম শাহ অন্যতম। সমাজবিজ্ঞানী অমিতা বাভিস্কার তাঁকে ছয় বছর বয়স থেকে চিনতেন। তিনি ১৯৮৬ ও ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত তাঁর ছাত্র এবং ১৯৯৪ সাল থেকে একই বিভাগে শিক্ষকতা শুরু করেন। তাঁর মতে, ‘দিল্লি স্কুল অব ইকোনমিকসের সমাজবিজ্ঞান বিভাগটি ছিল ভারতের গুরুত্বপূর্ণ বুদ্ধিজীবীদের তীর্থস্থান এবং আন্দ্রে বেঁদে ও উবেরয় ছিল তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে উঁচু মানের পণ্ডিত।’
একজন সামাজিক নৃবিজ্ঞানী হিসেবে তিনি আফগানিস্তানের তাজিকদের নিয়ে মাঠপর্যায়ে নিবিড় গবেষণা করেন। তাঁর আগের লেখনির কেন্দ্রীয় বিষয় ছিল পারস্পরিক বিনিময় ও সংহতি। তাঁর লিখিত ছয়টি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থের মধ্যে পাঁচটি অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত। বাকি একটি বই ম্যানচেস্টার ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত। একসময় তিনি প্রচলিত চিন্তাধারা দ্বারা ভারতকে একটি সমাজ হিসেবে বোঝার চেষ্টা করেন। এ ছাড়া তিনি ভারতের বাইরের জগতে গভীর মনোযোগ দেন। প্রাথমিকভাবে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত তিনি ইউরোপীয় আধুনিকতা অধ্যয়নের দিকে মনোনিবেশ করেন। অর্থাৎ তিনি একজন ভারতীয় পণ্ডিতের দৃষ্টিকোণ থেকে নয় বরং বৈশ্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে তত্ত্বের আলোচনা ও বিশ্লেষণের ওপর জোর দেন। এ প্রসঙ্গে বাভিস্কার বলেন, উবেরায়ের মনোভাব ছিল, ‘আমি হয়তো ভারতীয় হতে পারি কিন্তু নৃবিজ্ঞানের শাস্ত্রীয় প্রশ্নগুলোর সমাধান বৈশ্বিকভাবে করা উচিত।’
গভীর পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, উবেরয়ের কাজ আধুনিকতাকে রাষ্ট্র, ধর্ম ও সমাজের মধ্যে বিভেদ হিসেবে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করে না। এর পরিবর্তে তিনি এটিকে তিনটি প্রত্যয়ের মধ্যে একটি চলমান দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়া হিসেবে উপলব্ধি করেন, যা শুধু ধর্ম বা রাষ্ট্র দ্বারা নয়, নাগরিক সমাজ দ্বারাও মধ্যস্থতা করে, যেখানে ব্যক্তিরা তাঁদের স্বার্থ এবং সমাজের পুনরুৎপাদন উভয়ের জন্য একত্র হয়। তাঁর থিসিস পরার্মশ দেয় যে মধ্যযুগ ও আধুনিক—উভয় সময়ই ভারতীয় ঐতিহ্য সর্বদা বহুত্ব ও বিভিন্ন ঐতিহ্যকে গ্রহণ করছে।
জিতেন্দ্র পাল সিং উবেরয়ের একটি অন্যতম বড় গুণ হলো তিনি যেকোনো বিষয়ের সমাজতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ দিতে পারতেন। এ প্রসঙ্গে তাঁর এক ছাত্র শিব বিশ্বনাথন বলেন, টমেটোর সমাজবিজ্ঞান নিয়েও তিনি ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলতে পারতেন। তিনি ছিলেন তাঁর শিক্ষার্থীদের অনুপ্রেরণার অন্যতম উৎস। তাঁকে প্রায়ই দেখা যেত দিল্লি ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করতে। এমনকি অবসর যাওয়ার পরও, তাঁদের সঙ্গে আলোচনায় লিপ্ত হতে দেখা যেত। তিনি ছিলেন একজন ক্যারিশম্যাটিক ব্যক্তিত্ব। কাজের স্বীকৃতি হিসেবে তিনি ১৯৫৮ সালে রয়াল অ্যানথ্রোপলজিক্যাল ইনস্টিটিউট কর্তৃক হোকার্প পুরস্কার পান। ২০১১ সালে ইন্ডিয়ান সোশিওলজিক্যাল সোসাইটি কর্তৃক আজীবন সম্মাননা পদক পান।
বলা হয় ভারতে শ্রীনিবাস পরবর্তী প্রজন্মের সমাজবিজ্ঞানীদের মধ্যে উবেরয় ছিলেন অন্যতম। তিনি ছিলেন এমন এক বরেণ্য সমাজচিন্তাবিদ, যাঁর জীবন ও চিন্তা ছিল একসূত্রে গাঁথা। এমন একজন সমাজবিজ্ঞানী হারিয়ে ভারতীয় উপমহাদেশ হারিয়েছে একজন সত্যিকার আর্ন্তজাতিক মানের সমাজ বিশ্লেষক ও গবেষককে। বিদগ্ধ এই পণ্ডিতের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।
খ ম রেজাউল করিম, সহযোগী অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, সরকারি মাইকেল মধুসূদন কলেজ, যশোর-৭৪০০