স্মৃতির মণিকোঠায় আমার মমতাময়ী মা
মা সবার কাছেই খুব প্রিয়। পৃথিবীর সব দেশের মানুষের কাছেই ভালোবাসার আরেক নাম মা। সবার মতো আমার মা-ও আমার কাছে প্রাণজুড়ানো অনুভূতির নাম। কিছুদিন ধরে আমার মাকে একটু বেশি বেশিই মনে পড়ছে। মাকে আমার সব সময়ই মনে পড়ে। আমার প্রার্থনায়–দোয়ায়ও মাকে প্রতিদিনই রাখি। মহান আল্লাহ তাআলার কাছে মায়ের জন্য রহমত আর শান্তি চেয়ে মোনাজাত করি। কিন্তু ইদানীং মা আমার সামনে ঘুরে ফিরে বারবার আসছেন। বারবার মনের পর্দায় মুখটা ভেসে উঠছে। কেন জানি না মাকে নিয়ে ভাবতে খুব ইচ্ছা করছে।
বাবা যখন মারা যান, তখন আমি ছোট। স্কুলে যাওয়া শুরু করিনি তখনো। বাবার কথা খুব একটা মনেও নেই। মা-ই আমাকে আদর–স্নেহ দিয়ে মানুষ করেছেন। ১১ ভাই–বোনের মধ্যে আমি সবার ছোট। গ্রামের মানুষেরা আমাকে তাই অনেকই ঠাট্টা করে ‘ডুলিঝাড়া পোলা’ (সর্বশেষ বাচ্চা) বলতেন। অবশ্য আমার এক ভাই ও এক বোন ছোট বেলায়ই মারা যান। তাঁদের আমি দেখিওনি। এই হিসাবে ৯ ভাই–বোনকে নিয়ে আমার মা-বাবার সংসার দেখেছি। ছেলেমেয়ে লালন-পালন করা যে কতটা কঠিন কাজ, বিশেষ করে আমার মায়ের যে কতটা সংগ্রাম করতে হয়েছে, তা ছোট বেলায় বুঝিনি। এখন আমার দুই সন্তানকে বড় করতে গিয়ে মায়ের কষ্টটা বেশ ভালোভাবেই অনুভব করতে পারছি।
মা ছিলেন অতি সাধারণ। মায়ের ব্যক্তিগত স্বাদ–আহ্লাদ বলে যে একটা জিনিস আছে, এটা কোনো দিনই মায়ের ক্ষেত্রে দেখিনি। আমাদের আবদার মেটানো, রান্নাবান্না আর আমাদের যন্ত্রণা সহ্য করতেই যেন মায়ের জন্ম হয়েছিল। এর বাইরে যে একটা জগৎ আছে, সেটা মাকে দেখে বোঝার উপায় ছিল না।
আমাদের গ্রামের নাম বাউশা। নেত্রকোনার মদন উপজেলার নায়েকপুর ইউনিয়নের প্রত্যন্ত অঞ্চলে। ছোট্ট বেলার কথা বলতে গেলে গ্রামটাই শুধু নয়, পুরো এলাকাটাই ছিল সুবিধাবঞ্চিত। তখন বিদ্যুৎ থাকার তো প্রশ্নই আসে না। গরমের রাতে অসহ্য গরমে যখন আমি ছটফট করতাম, তখন নিজের কথা না ভেবে মা সারা রাত হাতপাখা দিয়ে বাতাস করতেন। শুধু বাতাস করাই নয়, আমি যখনই জেগে উঠেছি দেখতাম মা একহাতে পাখা দিয়ে বাতাস করছেন, অন্য হাতে আমার মাথা, শরীর, মুখ, হাত-পায়ে হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। মা কখন ঘুমাতেন, আমি বুঝতে পারতাম না। শুধু ছোট্ট বেলায় নয়, যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তাম, এমনকি চাকরিতে ঢুকলাম তখনো বাড়িতে গেলে মা এই কাজটা করতেন। শেষ জীবনে মা দুই বছরের অধিক সময় বার্ধক্যজনিত কারণে শয্যাশায়ী ছিলেন। তখনো বাড়িতে গেলে আমি মায়ের সঙ্গেই থাকতাম। মায়ের পক্ষে তখন আমাকে আগের মতো হাতপাখা দিয়ে বাতাস করার অবস্থা ছিল না। অবশ্য তত দিনে বৈদ্যুতিক পাখার ব্যবস্থাও হয়ে গিয়েছিল। তবু বিদ্যুৎ চলে গেলে মায়ের চেষ্টার কোনো কমতি ছিল না। আগের মতো না পারলেও মাথায় মুখে হাত বুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতেন।
মায়ের কিছু দুর্বলতা ছিল। মা জোঁক খুব ভয় পেতেন। সাধারণ মানুষের চেয়ে অনেক বেশি ভয় পেতেন।
জোঁকের মতো অন্য কিছুকে এত ভয় পেতে আমি তাঁকে দেখিনি। তাই পানির কাছে গেলেই অনেকেই জোঁক আসছে বলে মাকে ভয় দেখাতেন। মাও ভীষণ ভয় পেতেন। এমন ভয় পেতেন যেন তাঁর আর রক্ষা নেই।
মা নৌকা দিয়ে কোথাও যেতে খুব ভয় পেতেন। বর্ষাকালে মামাবাড়ি যাওয়ার জন্য নৌকার কোনো বিকল্প ছিল না। আর আমাদের গ্রামের পশ্চিমে অবস্থিত জালিয়ার হাওরটা বেশ গভীর। বর্ষাকালে একটু বাতাস হলেই হাওরটা ভয়াবহ রূপ নিত। তখন ইঞ্জিনচালিত নৌকাও ছিল না। ফলে প্রায়ই নৌকাডুবি হতো। তাই মা নৌকায় উঠতেই চাইতেন না। কোনো বিশেষ প্রয়োজনে মামাবাড়ি যেতে হলে মাকে যে কতভাবে বুঝিয়ে–শুনিয়ে নৌকায় তুলতে হতো, তা ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন।
মা পুলিশ দেখে ভয় পেতেন। অবশ্য আগেকার দিনে পুলিশ এলেই গ্রামের সবাই কোনো কারণ ছাড়াই যে যার মতো ভয়ে পালাতেন। তবে আমার মনে যতদূর মনে পড়ে মা একটু বেশিই ভয় পেতেন। একটা উদাহরণ দেই। আমার চাচা নূর আহমেদ পুলিশের এসআই হয়েছিলেন। পরে এএসপি হয়ে অবসর নেন।
একদিন তিনি পুলিশের পোশাক পরে আমাদের বাড়িতে আসেন। পুলিশের পোশাক দেখেই মা ভয় পেয়ে ঘরে এসে লুকিয়ে পড়েন। পরে অবশ্য সবাই মিলে অনেক বুঝিয়ে–শুনিয়ে মাকে চাচার সামনে আনতে সক্ষম হন। ভুলটা ভাঙার পর মা বেশ লজ্জাও পান।
মা গরিব–দুঃখীদের প্রতি ছিলেন অত্যন্ত দয়ালু। কোনো অসহায় ব্যক্তি খাবার চেয়েছেন আর মা তাঁকে খালি হাতে ফিরিয়ে দিয়েছেন, এমনটা সচরাচর চোখে পড়েনি। চুয়াত্তর সালের একটা ঘটনা বলি। একদিন মা ভাত খেতে বসেছিলেন। দুর্বল এক বৃদ্ধা ভিক্ষুক এলেন। মাকে বললেন, ‘আমার পেটে আজ দানাপানি কিছুই পড়েনি। আমি আর চলতে পারছি না। দুটো ভাত দেন বোন।’ মা খাবার বৃদ্ধাকে দিয়ে দিলেন। বৃদ্ধা খাবার পেয়ে গোগ্রাসে বেহুঁশের মতো খেতে লাগলেন। আর সঙ্গে সঙ্গেই ভাত তাঁর গলায় আটকে গেল। বৃদ্ধা পড়ে গেলেন। তাঁর মরে যাওয়ার অবস্থা। বাড়ির সবাই তাঁর দিকে এগিয়ে গেলেন।
কেউ তাঁকে পানি খাওয়ালেন, কেউবা তাঁর মাথায় পানি দিলেন। অনেক্ষণ পর বৃদ্ধা চোখ খুললেন। বাড়ির সবাই তখন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। সবাই মাকে দোষারোপ করতে লাগলেন এই বলে যে ‘বৃদ্ধা মারা গেলে নিশ্চিত আমরা মার্ডার কেসে পড়তাম।’
ছোটবেলায় দেখেছি কার্তিক ও চৈত্র মাসে অভাব ছিল গ্রামের মানুষের নিত্যসঙ্গী। এ সময়টায় গ্রামের অধিকাংশ পরিবারকেই ভীষণ কষ্ট করে চলতে হতো। এ সময়টায় পরিবারেরও যে কষ্ট হতো না, এমনটা নয়। তবু মা গরিবদের প্রতি বেশ সদয় ছিলেন। প্রতিবেশী ও আত্মীয়স্বজনদের ভাতের কষ্ট দূর করতে মা যথাসাধ্য চেষ্টা করতেন। মা খেতে বসলে মার সামনে ভাবিরা ভাতের প্লেট এনে দিতেন। মা বলতেন, ‘বউ এত কম ভাত দিয়েছ কেন? আরও দাও।’ মায়ের প্লেটে বেশি করে ভাত দিতে হতো। প্লেট ভরে ভাত না দিলে মা খাওয়া শুরু করতেন না। এরপর অল্প কিছু খেয়েই মা থেমে যেতেন। বলতেন, ‘খাওয়া ভালো লাগছে না।’ আমরা বলতাম, ‘প্লেটটা নিয়ে যাব?’ মা তখন কোনো গরিব মানুষের নাম বলে তাঁকে খাবারটা দিয়ে আসার জন্য বলতেন। আমরা আশ্চর্য হতাম না। কারণ, এটা ছিলো মায়ের প্রায় নিত্যদিনের ঘটনা। আমরা তাই মায়ের কথামতো খাবার যথাস্থানে পৌঁছে দিতাম। এভাবে অনেক গরিব মানুষ মায়ের খাদ্য সাহায্য পেতেন।
একটা কথা আমি বলি। মা কোনো দিনই প্রকাশ্যে আমাকে বলেননি, তিনি আমাকে ভালোবাসেন। কিন্তু আমি তো এটা ভালোভাবেই জানি যে তিনি আমাকে এক পৃথিবীর চেয়েও বেশি ভালোবাসতেন। তাঁর অন্তরজুড়ে ছিলাম আমি আর আমার ভাইবোনেরা। মৃত্যুর আগপর্যন্ত তিনি আমাদের অসাধারণভাবে আগলে রাখার চেষ্টা করেছেন।
একাত্তরের একদিনের কথা। আমি তখন দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ি। হঠাৎ জানতে পারলাম দক্ষিণ দিক থেকে পাকিস্তানি বাহিনী এলাকার দিকে আসছে। আমাদের গ্রামের দক্ষিণ পাশের গ্রামগুলো থেকে শত শত মানুষ জান বাঁচানোর জন্য উত্তর দিকে ছুটছেন। তখন আমাদের গ্রামের লোকেরাও যে যেভাবে পারেন, পালাতে শুরু করলেন। আমরাও দৌড় শুরু করলাম উত্তর দিকে। আমরা সব ভাইয়েরা তখন একসঙ্গে ছিলাম না। যতদূর মনে পড়ে ছোট ভাই বাড়িতে না থাকায় তিনি আমাদের সঙ্গে ছিলেন না। তাই আমার মা দৌড়ান আর ভাইয়ের জন্য কান্নাকাটি করেন। কিন্তু কেউ আমার মাকে থামতে দেন না। তবে সবাই মাকে এই বলে সান্ত্বনা দেন যে তাঁর ছেলে হয়তো নিরাপদেই আছে কোথাও। কিন্তু মা কিছুতেই সান্ত্বনা পাচ্ছিলেন না। এরপরও সবার সঙ্গে তাঁকে দৌড়াতে হচ্ছিল।
মামার সঙ্গে মায়ের ছিল অকৃত্রিম ও সুন্দর সম্পর্ক। আমার দুই মামা। আমার খুব ছোট্ট বেলায় বড় মামা মারা যান। তাঁর কথা কিছুই মনে নেই। ছোট মামাকেই দেখেছি শুধু। ছোট মামা আমাকে খুব আদর করতেন। ছোট মামা মাকে যেমন মান্য করতেন, তেমন ভালোও বাসতেন। মামার বাড়ি ছিল আমাদের বাড়ি থেকে আড়াই মাইল দূরে। মামা প্রায়ই ফলমূল, পান–সুপারি ইত্যাদি যখন যেটা পছন্দমতো পেয়েছেন, সেটাই মায়ের জন্য নিয়ে বাড়িতে চলে আসতেন। মা-ও তাঁর জন্য এটা–সেটা নিয়ে কিছুদিন পরপরই মামাকে দেখতে চলে যেতেন। মা মারা গেছেন ২০১০ সালে। আর মামা মারা গেছেন আরও অনেক আগে। তাঁদের ভাইবোনের এই মধুর সম্পর্কটার কথা মনে হলে আমার এখনো খুব ভালো লাগে।
চাকরির কারণে আমি সব সময়ই বাড়ির বাইরে থেকেছি। মা থাকতেন গ্রামে। মাঝেমধ্যে মাকে আমার বাসায় আনলেও বেশি দিন থাকতে চাইতেন না। শহরের বাসায় বেশি মানুষজন নাই। সেই তুলনায় আমাদের একান্নভুক্ত বড় পরিবারের গ্রামের বাড়িতে সব সময় মানুষের গমগমে অবস্থা। মার তা-ই পছন্দ ছিল। বাড়ি যাওয়ার জন্য পাগল হয়ে যেতেন। বাড়িতে চলে যেতেন। বাড়িতে মায়ের আদর যত্নেরও কোনো অভাব হতো না। আমার ভাইয়েরা, বোনেরা, ভাবিরা, ভাইপো-ভাইজিরা, প্রতিবেশীরা সবাই মাকে খুব পছন্দ করতো। সবাই মায়ের দেখাশোনা করত। বড় ভাই যত দিন বেঁচে ছিলেন, মাকে একেবারেই আগলে রাখতেন। তিনি মারা যান মা মারা যাওয়ার আগে। তিনি মারা যাওয়ার পরও আমাদের বাড়ির অন্য সবাই মায়ের সেবাযত্নের ব্যাপারে বিশেষ খেয়াল রেখেছেন। বিশেষ করে মা যখন শয্যাশায়ী ছিলেন, তখন মেজ ভাই ও মেজ ভাবী মাকে অসাধারণ সেবাযত্ন করেছেন। এরপরও মা আমাকে খুব মিস করতেন। অসুখ বিসুখ একটা কিছু হলেই মা চাইতেন যে আমি তাঁর পাশে থাকি। কিন্তু সব সময়তো আমার পক্ষে যাওয়া সম্ভব হতো না। আর আমি না যাওয়া পর্যন্ত মা অবুঝের মতো ব্যাকুল হয়ে সবার কাছে জানতে চাইতেন আমি বাড়ি আসলাম কি না। অবশেষে আমি গেলে শান্ত হতেন। আমারও মাকে দেখতে পেরে খুব ভালো লাগত। কিন্তু আমার পক্ষে মায়ের কাছে বেশিদিন থাকা সম্ভব হতো না। মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে আসতাম। মা বিদায়ও দিতেন। কিন্তু আমার খারাপ লাগত। তবু না এসে কোনো উপায় ছিল না।
অত্যন্ত দুঃখের বিষয় হলো মায়ের মৃত্যুর সময় আমি কাছে থাকতে পারলাম না। ২০১০ সালের মার্চ মাস। আমি তখন আমেরিকার নেব্রাস্কার রাজধানী লিংকন শহরের ইউনিভার্সিটি অব নেব্রাস্কায় ‘টিইএ’তে প্রশিক্ষণরত। খুব চমৎকার ও আনন্দঘন পরিবেশে অসাধারণ প্রশিক্ষণ চলছিল।
এই আনন্দের মধ্যেই আমার জীবনের অত্যন্ত বিয়োগান্তক ঘটনাটি ঘটে যায়। ২০ মার্চ আমাদের প্রশিক্ষণ শেষ হয়। এর আগেই ১৭ মার্চ আমার পরম শ্রদ্ধেয়া মা মৃত্যুবরণ করেন। সেদিন আমেরিকান সময় সন্ধ্যা ৬টা ৩০ মিনিটে ছিল আমাদের ফেয়ারওয়েল ডিনার পার্টি। এর আগেই আমেরিকান সময় বিকেল ৫টায় মায়ের মৃত্যু সংবাদ পাই। মায়ের অনুমতি নিয়েই আমেরিকায় গিয়েছিলাম। আমার মনটা বিষণ্নতায় ভরে উঠল। মার মৃত্যুতে আমি খুব কষ্ট পেলাম। তবুও নিজকে এই বলে সান্ত্বনা দিলাম যে মায়ের মৃত্যু তো আমি দেশে থাকলেও ফিরাতে পারতাম না। মহান আল্লাহ তাআলা যেন মাকে ওপারে ভালো রাখেন—এটাই আসল কথা।
সেদিন ডিনার পার্টিতে আমি আর যোগ দিইনি। হোটেলেই নামাজ, কোরআন তিলাওয়াত আর দোয়া–দরুদ পড়ে সময় কাটিয়েছি। প্রশিক্ষণার্থীরা সবাই আমাকে সমবেদনা জানালেন। কোর্স কো-অর্ডিনেটর মি. জো ম্যাকনাল্টি কয়েকবার ফোন করে সান্ত্বনা দেন। পার্টির মূল আয়োজক তিনি। ওই মুহূর্তে তাঁর পক্ষে আমার কাছে আসার অবস্থা ছিল না। আমাকে হোটেলে সঙ্গ দেওয়ার জন্য তিনি জর্ডানের নাগরিক মি. তারেককে আমার রুমে পাঠিয়ে দিলেন। মি. তারেক আমাদের প্রশিক্ষণ ও প্রশিক্ষণের সব অনুষ্ঠানে মি. বুকি নামের আর একজনের সঙ্গে কম্পিউটারে টেকনিক্যাল সাপোর্ট দিতেন। আমি জানতাম তাঁর অনুপস্থিতিতে ডিনার পার্টির অসুবিধা হবে। মি. তারেককে নিয়ে আমি আমার মায়ের জন্য কিছুক্ষণ দোয়া করি। এরপর তাঁকে এক রকম জোর করেই ডিনার পার্টিতে পাঠিয়ে দিই। পরে জানলাম সেদিন ডিনার পার্টি শুরু হয় আমার মায়ের জন্য দাঁড়িয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন আর প্রার্থনার মধ্য দিয়ে। এই পার্টিতে অংশ নেন ফ্যাকাল্টির ডিনসহ অন্য অধ্যাপকেরা, আমার মতো বিভিন্ন দেশ থেকে আগত শিক্ষকেরা, বিভিন্ন বিদ্যালয়ের সেসব শিক্ষকের সঙ্গে আমরা কাজ করেছি তাঁরা ও তাঁদের পরিবার এবং আমেরিকার যেসব পরিবারে আমরা অতিথি হয়ে একদিন কাটিয়েছিলাম, সেসব পরিবারের সদস্যরা।
পরের দিন খুব সকালেই আমাকে সমবেদনা জানাতে হোটেলে চলে আসেন কোর্স কো-অর্ডিনেটর মি. জো ম্যাকনাল্টি। বাকি দিনগুলোতে আমাকে যিনি চোখে চোখে রাখার চেষ্টা করেছেন, যা আমি প্রতিনিয়তই বুঝতে পারতাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকেরা যাঁরা আমাদের প্রশিক্ষক ছিলেন, সবাই আমাকে সমবেদনা জানিয়ে মায়ের আত্মার শান্তি কামনা করেন। আমাকে সমবেদনা জানিয়েছেন ঢাকাস্থ আমেরিকান সেন্টার থেকে মিস তাহনিয়া শাহিদ, ফ্লোরিডা থেকে আমার মামা জহিরুল ইসলাম, নিউজার্সি থেকে মি. বিশ্বজিৎ রায় (নেত্রকোনার আঞ্জুমান স্কুলের আমার সাবেক সহকর্মী) এবং অন্য অনেকেই। সমাপনী অনুষ্ঠানে (যেখানে বিভিন্ন অঙ্গরাজ্য থেকে প্রশিক্ষণ শেষ করে প্রশিক্ষণার্থীরা আবার একসঙ্গে মিলিত হন) আইরেক্সের পক্ষ থেকেও আমার মায়ের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করা হয় এবং আইরেক্সের কর্মকর্তারা ব্যক্তিগতভাবে আমাকে সমবেদনা জানান। এভাবেই কেটেছে যুক্তরাষ্ট্রে আমার শেষ কয়েকটা দিন।
মায়ের মৃত্যুর পর পেরিয়ে গেছে এক যুগেরও বেশি সময়। মাকে নিয়ে স্মৃতির কোনো শেষ নাই। সব লেখতে গেলে লেখাটা শেষ করা যাবে না। সব মায়েরা এমনই হন। তাঁদের নিয়ে কত গান, কত কবিতা, কত উপন্যাস যে লেখা হয়েছে তাঁর কোন শেষ নাই। প্রার্থনা করি সবার অন্তরে মায়েরা বেঁচে থাকুন পথ চলার প্রেরণা আর আলোর দিশারি হয়ে।
আমার মা ছিলেন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাবিহীন সাদাসিধে একজন মানুষ। ধর্মীয় শিক্ষাও যে মার খুব ছিল এমনটা বলা যাবে না। পবিত্র কোরআন শরিফ পাঠ করতেন ও নামাজ পড়তেন। ধর্মীয় কাজে তাঁর আন্তরিকতার যে কোনো অভাব ছিল না—এটা আমি জোর দিয়েই বলতে পারি। তিনি কাউকে কোনো বিষয়ে আঘাত দিয়েছেন, এমনটাও আমি দেখিনি। নিজে কম খেয়েছেন, কম পরেছেন। কিন্তু আমাদের কোনো বিষয়ে কোনো কমতি হোক, মা এটা কোনো দিনই চাননি। মা আজ আমাদের মধ্যে নেই।
পরপারে কেমন আছেন, জানি না। পরম দয়ালু মহান আল্লাহ তাআলার কাছে প্রার্থনা করি, ‘আল্লাহ গো, আমার মা একেবারেই একজন সরল–সহজ মানুষ ছিলেন। আপনার কোনো প্রশ্নের উত্তর মা দিতে পারবেন না কি না, জানি না। কিন্তু আপনার ভান্ডারে দয়ার তো কোনো অভাব নেই। আপনি আপনার সীমাহীন রহমতের গুণে মায়ের সরলতার দিকে তাকিয়ে, মায়ের ভালো কাজগুলোর দিকে তাকিয়ে তাঁকে জান্নাতুল ফেরদাউস দিয়ে দিন। আমার মায়ের মতো পৃথিবীর অন্য মাদেরও আপনি সাহায্য করুন। আমিন।’
মো. মোতাহার হোসেন, সাবেক প্রধান শিক্ষক, মোহনগঞ্জ পাইলট সরকারি উচ্চবিদ্যালয়, মোহনগঞ্জ, নেত্রকোনা