আলো ব্যবহার করে বেতার যোগাযোগ: একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ

আলোভিত্তিক ওয়্যারলেস সংযোগ অসংখ্য বেতার যোগাযোগপ্রযুক্তির ক্ষেত্রে একটি সম্ভাব্য উদ্ভাবন হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে

ইন্টারনেট সংযোগের মাধ্যম হিসেবে কৃত্রিম আলো ব্যবহারের স্বপ্ন ইতিমধ্যে বাস্তবে পরিণত হতে শুরু করেছে। অদূর ভবিষ্যতে বাড়িতে স্থাপিত কৃত্রিম আলো একাধিক ডিভাইসকে ইন্টারনেটের সঙ্গে সংযুক্ত করবে। কাজ করবে বেতার অ্যানটেনা হিসেবে। আলোর নিচে দাঁড়িয়ে আপনি ইউটিউবে স্ট্রিম করতে পারবেন নিরবচ্ছিন্নভাবে।

আলোভিত্তিক ওয়্যারলেস সংযোগ অসংখ্য বেতার যোগাযোগপ্রযুক্তির ক্ষেত্রে একটি সম্ভাব্য উদ্ভাবন হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। বস্তুত, যোগাযোগের জন্য আলো ব্যবহার করা নতুন কোনো ধারণা নয়। এটি হাজার হাজার বছর আগের ধারণা, যখন মানুষ দূর থেকে দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য ধোঁয়ার সংকেত ব্যবহার করত।

ইতিহাসে দৃশ্যমান আলোর মাধ্যমে যোগাযোগ (ভিজিবল লাইট কমিউনিকেশন—ভিএলসি) প্রথম প্রদর্শন করেছিলেন আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেল। যখন সূর্যালোক ব্যবহার করে কয়েক মিটার দূরত্বে মডিউলেটেড স্পিচ সিগন্যাল পাঠানোর জন্য ফটোফোন উদ্ভাবিত হয়েছিল।

এরপর ১৯৬২ সালে ইনফ্রারেড (আইআর) লাইট-এমিটিং ডায়োড (এলইডি) আবিষ্কারের সঙ্গে সঙ্গে রিমোট কন্ট্রোলের জন্য আইআরের (অদৃশ্য আলো) ব্যবহার ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। নিঃসন্দেহে, এটি এখন পর্যন্ত অপটিক্যাল ওয়্যারলেস কমিউনিকেশন (ওডব্লিউসি) প্রযুক্তির সবচেয়ে সফল অ্যাপ্লিকেশনগুলোর একটি।

গত কয়েক দশকে বেশ কয়েকজন গবেষক সাদা এলইডি ব্যবহার করার কথা বিবেচনা করেছেন। যেমন এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হ্যারাল্ড হাস ওয়্যারলেস–ফিডেলিটির (ওয়াই–ফাই) বিকল্প হিসেবে আলোভিত্তিক অন্দর যোগাযোগকে সংজ্ঞায়নে ‘লাইট-ফিডেলিটি’ (লাই–ফাই) শব্দ ব্যবহার করেছেন।

যেকোনো প্রচলিত ওয়্যারলেস কমিউনিকেশন সিস্টেমের মতো ওডব্লিউসি সিস্টেমের তিনটি অংশ রয়েছে: ট্রান্সমিটার, প্রচার চ্যানেল ও রিসিভার। ট্রান্সমিটারে প্রেরিত তথ্যের বিটগুলো প্রথমে বৈদ্যুতিক সংকেতে রূপান্তরিত হয়। মডিউলেশনের পর ড্রাইভিং সার্কিটের মাধ্যমে তা আলোর উৎসে বিতরণ করা হয়।

রিসিভারে প্রচারিত অপটিক্যাল সংকেতগুলো একটি ফটোডিটেক্টর দ্বারা সংগ্রহ করা হয়। উৎপন্ন ফটোকারেন্ট একটি পরিবর্ধক দ্বারা ভোল্টেজ সংকেতে রূপান্তরিত হয়।

অবশেষে সিগন্যাল ডিমডিউলেশনের পর প্রেরিত বিটগুলো পুনরুদ্ধার করা হয়। সাধারণত, ইনডোর পরিবেশে দ্বিমুখী আলোভিত্তিক আপলিংক ও ডাউনলিংক যোগাযোগের জন্য যথাক্রমে দৃশ্যমান ও আইআর স্পেকট্রাম ব্যবহার করা হয়।
সম্প্রতি ইন্টারনেটে ৬–জি নেটওয়ার্কে সবকিছু সংযুক্ত করার প্রয়োজনীয়তা চলমান রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি (আরএফ) নেটওয়ার্কগুলোর জন্য নতুন প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছে। যেমন স্পেকট্রাম কনজেশন ও ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ইন্টারফারেন্স (ইএমআই)।

অনিয়ন্ত্রিত স্পেকট্রাম ও উচ্চগতির আলো সংযোগের প্রাপ্যতার কারণে লাই–ফাইকে ভবিষ্যতের ৬–জি নেটওয়ার্কগুলোর জন্য সবচেয়ে কার্যকর প্রার্থীদের মধ্যে বিবেচনা করা হয়। বিশেষ করে আলো সাধারণত অস্বচ্ছ দেয়ালের মধ্য দিয়ে যায় না। ফলে বর্ধিত গোপনীয়তা ও নিরাপত্তার পাশাপাশি ফ্রিকোয়েন্সির পুনর্ব্যবহার করা যায়।

তা ছাড়া ঐতিহ্যগত ওয়াই–ফাইঢের তুলনায় লাই–ফাই ১০০ গুণ দ্রুতগতির ইন্টারনেট প্রদান করতে পারে। যেমন পিউর লাই–ফাই ১ জিবিপিএস পর্যন্ত গতিতে ডেটা ট্রান্সমিট করার জন্য একটি গিগাবিট লাই–ফাই সিস্টেম ডিজাইন করেছে। যখন পরীক্ষাগার গবেষণাগুলো ২২৪ জিবিপিএস পর্যন্ত তাত্ত্বিক গতি প্রদর্শন করেছে।

অন্যদিকে ফরাসি প্রযুক্তি কোম্পানি ওলেডকম আইআরের ওপর ভিত্তি করে একটি দ্বিমুখী গিগাবিট চিপ তৈরি করেছে, যা মুঠোফোন ও ল্যাপটপ ডিভাইসে ব্যবহার করা যেতে পারে।

ওডব্লিউসি প্রযুক্তি ও লাই–ফাই এমন পরিবেশের জন্য উপযুক্ত, যেখানে আরএফ নিষিদ্ধ। যেমন মেডিকেল ইনডোর স্বাস্থ্য পর্যবেক্ষণ ও মিলিটারি অ্যাপ্লিকেশন। এ ব্যাপারে একটি ভ্রান্ত ধারণা হলো, ওডব্লিউসি প্রযুক্তি শুধু অভ্যন্তরীণ যোগাযোগের জন্য উপযুক্ত। প্রকৃতপক্ষে, লেজার ডায়োড ব্যবহার করে দূর-দূরান্তে পয়েন্ট-টু-পয়েন্ট যোগাযোগ করা সম্ভব। যেমন মুক্ত স্থান ও পানির নিচে অপটিক্যাল ওয়্যারলেসের মাধ্যমে যোগাযোগ।

শুধু তা–ই নয়, উচ্চ ব্যান্ডউইডথ দক্ষতা, কম বিদ্যুৎ খরচ, কম ভর, আরএফের তুলনায় ছোট অ্যানটেনার আকারের কারণে ওডব্লিউসি সম্প্রতি আন্ত ও অভ্যন্তরীণ স্যাটেলাইট যোগাযোগ, যানবাহন থেকে যানবাহন যোগাযোগ, আউটডোর ওয়্যারলেস অ্যাকসেসে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে।

বাস্তবিক অর্থে, ফ্রি স্পেস অপটিক্যাল কমিউনিকেশন হলো ইন্ডাস্ট্রির একটি সুপ্রতিষ্ঠিত ক্ষেত্র, যা ১৯৯০ সাল থেকে স্যাটেলাইট যোগাযোগের জন্য ব্যবহৃত হয়ে আসছে।

সম্প্রতি ওলেডকম অপটিক্যাল ওয়্যারলেস নেটওয়ার্কের সঙ্গে একটি প্রকল্পে কাজ করছে, যা স্যাটেলাইটের অভ্যন্তরে নেটওয়ার্ক কেব্‌লগুলো প্রতিস্থাপন করার মাধ্যমে স্যাটেলাইটের অতিরিক্ত ওজন ও স্থান কমিয়ে আনবে। আকর্ষণীয় অ্যাপ্লিকেশনগুলোর মধ্যে আরও রয়েছে ড্রোন থেকে ড্রোন যোগাযোগ, কৃষি ও খামার নজরদারি, স্মার্ট হোমস, ট্রেন ও ভূগর্ভস্থ স্টেশন।

লাই–ফাই শিল্প ক্রমান্বয়ে প্রসারিত হচ্ছে। এ-সংক্রান্ত বেশ কয়েকটি গবেষণা ইতিমধ্যে গবেষকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। বিশেষ করে ওডব্লিউসি সিস্টেমের সীমিত ফ্যাক্টর উপলব্ধি করার জন্য বাস্তবসম্মত পরিবেশ বিবেচনা করা প্রয়োজন।

যেমন ব্যবহারকারীর গতিশীলতা বিবেচনায় নেওয়া, ইনডোর পরিবেশে বাধা, আউটডোর অ্যাপ্লিকেশনের জন্য কুয়াশা, মেঘ ও ধুলোর প্রভাব। অধিকন্তু একাধিক ব্যবহারকারীকে একই সময়ে তাঁদের ডেটা স্থানান্তর করতে হতে পারে, যার জন্য উপযুক্ত মডিউলেশন ও একাধিক অ্যাকসেস কৌশল প্রয়োজন।

যোগাযোগব্যবস্থার নির্ভরযোগ্যতা বৃদ্ধি করা গবেষণার আরেকটি আকর্ষণীয় ক্ষেত্র। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ভিশন নামে একটি গবেষণা উদ্যোগে ৩ দশমিক ৫ মিলিয়ন ইউরো অর্থায়ন করেছে, যার মধ্যে ১৪ জন পিএইচডি গবেষক ওডব্লিউসি নিয়ে কাজ করছেন।

আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ (এআইইউবি) ইতিমধ্যে পরবর্তী প্রজন্মের লাই–ফাই নিয়ে গবেষণায় অর্থায়ন শুরু করেছে। একটি গবেষণার ফলাফল ইতিমধ্যে একটি কিউ ১ জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। এআইইউবির গবেষকেরা, বিশেষ করে লাই–ফাই ব্যবহারের ক্ষেত্রে উদ্ভাবনী মডিউলেশন ও একাধিক অ্যাকসেস পদ্ধতির ওপর কাজ করছেন। গবেষণার দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য হলো বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো লাই–ফাইয়ের জন্য পরীক্ষামূলক টেস্টবেড ডিজাইন ও ডেভেলপ করা।

লেখক: ড. মোহাম্মদ জাহিদ হাসান

সহকারী অধ্যাপক, ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ (এআইইউবি)

ইমেইল: [email protected]