এভারেস্ট জয়: শাকিলরা কীভাবে বনের মোষ তাড়ান!
ভয়াবহ রোদ, ভ্যাপসা গরম আর টানা পরিশ্রমে সেটা খুব ক্লান্তিকর একটা দিন ছিল।
ইকরামুল হাসান শাকিল তখন সবে ১ হাজার ৭০০ কিলোমিটারের বেশি হেঁটে গ্রেট হিমালয়ান ট্রেইল অভিযান শেষ করে এসেছেন। ক্লান্ত শরীর নিয়ে সাক্ষাৎকার দিচ্ছিলেন। একেবারে শেষ দিকে এসে শাকিলকে প্রশ্ন করেছিলাম, ‘ঘরের খেয়ে এসব অভিযান করে লাভ কী?’
শাকিল এতটুকু সময় না নিয়ে উত্তর দিয়েছিলেন, ‘আমি কৃষক পরিবারের ছেলে। আমি যখন ভালো কিছু করি, আমার কিষানি মায়ের মুখে তখন গর্বের হাসি দেখি। একই রকম আমি তো এই কৃষিপ্রধান বাংলাদেশের ছোট্ট একটা সন্তান। আমার কেন যেন মনে হয়, আমি কিছু অর্জন করতে পারলে সেই গর্বে আমার দেশটা হেসে উঠতে পারবে।’
শাকিলের কথার সূত্র ধরেই বলা যায়, এই সদ্য কৈশোর পার করা তরুণ বাংলাদেশকে আরও একবার হাসার উপলক্ষ এনে দিয়েছেন। বাংলাদেশের সপ্তম অভিযাত্রী হিসেবে এভারেস্ট জয় করলেন। সেটাও আবার অনন্য এক কীর্তি করে। কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত থেকে হেঁটে, মাঝখানে যমুনা নদী সাঁতার কেটে এবং আবার হেঁটে পৌঁছে গেছেন এভারেস্টে। বিশ্বের মাত্র দ্বিতীয় অভিযাত্রী হিসেবে সৈকত থেকে এভারেস্ট অভিযান করেছেন; যেটাকে শাকিলরা বলেন—সি টু সামিট।
সব হিসাব ঠিক থাকলে শাকিল এ অভিযানের মাধ্যমে কয়েকটি বিশ্ব রেকর্ড করে ফেলার দাবিদারও হয়েছেন। প্রথমত, তিনি সবচেয়ে কম দিনে, ৮৪ দিনে ‘সি টু সামিট’ সম্পন্ন করেছেন। ১৯৯০ সালে অস্ট্রেলিয়ান অভিযাত্রী টিম ম্যাকার্টনি-স্নেপ ৯৬ দিনে এ অভিযান সম্পন্ন করেছিলেন। আরেকটি হলো, শাকিল সবচেয়ে কম বয়সে অভিযানটি সফলভাবে করেছেন।
এসব রেকর্ডের স্বীকৃতি শাকিল পাবেন কি না, সেটা জানতে একটু সময় লাগবে। আমরা আপাতত জানার চেষ্টা করি যে এমন অভিযান শাকিলরা কীভাবে করেন?
ঘটনাচক্রে বাংলাদেশ থেকে এ পর্যন্ত যাঁরা এভারেস্ট জয় করেছেন বা চেষ্টা করেছেন, তাঁদের কয়েকজনের অভিযান-উদ্যোগ কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে। ফলে এটা সাক্ষ্য দিতে পারি যে এই অভিযাত্রীদের পর্বতে ওঠার যে কষ্ট, তার চেয়ে ঢের বেশি কষ্ট হয়েছে অভিযানের টাকা জোগাড় করতে। টাকা হাতে না পেয়েই অভিযান শুরু করা, নেপালের পথে পথে পাসপোর্ট বন্ধক রেখে টাকা জোগাড় করা এবং টাকার অভাবে নেপাল থেকে ফিরতে না পারা; এটা আমাদের অভিযাত্রীদের সবচেয়ে কমন গল্প।
আমরা খুব ভালো করে জানি, একটা অভিযানের টাকা জোগাড় করতে কতগুলো করপোরেট অফিস, বিজ্ঞাপনদাতার দুয়ারে দুয়ারে ঘুরে জুতা ক্ষয় করতে হয় তাঁদের। শেষ পর্যন্ত অবমাননা ছাড়া বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই খুব বেশি কিছু জোটে না।
‘নাগরিক সংবাদ’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]
এখন বিজ্ঞাপনদাতাদের ক্ষেত্রেও যুক্তি আছে। তাঁরা অভিযানের অর্থ দেওয়ার বিনিময়ে চান মিডিয়া কাভারেজ, হইচই; যেটাকে বাণিজ্যের ভাষায় মাইলেজ বলে। প্রথম এভারেস্ট বিজয়ীকে পৃষ্ঠপোষকতা করে যে মাইলেজ পাওয়া গিয়েছিল, তা এখন আর প্রতিষ্ঠানগুলো পায় না। ফলে তাদের মধ্যেও দ্বিধা কাজ করে। আরেকটা সমস্যা হলো, পৃষ্ঠপোষকতা করার পর অভিযাত্রী ব্যর্থ হলে তো টাকা ফেরত নেওয়া যায় না; কিন্তু মাইলেজ শূন্য হয়ে যায়। ফলে এটা খুব ঝুঁকিপূর্ণ ‘বিনিয়োগ’। সামাজিক দায়বদ্ধতা ছাড়া আর কোনো যুক্তি তাদেরও নেই।
অথচ ব্যাপারটা অন্য রকম হতে পারত। বাংলাদেশে একটি মাউন্টেনিয়ারিং ফেডারেশন আছে। যত দূর জানি, এ ফেডারেশন আন্তর্জাতিক মাউন্টেনিয়ারিং সংস্থা UIAAK স্বীকৃত এবং অবশ্যই বাংলাদেশ ক্রীড়া পরিষদের অনুমোদিত। নিশ্চয়ই তাদের আন্তর্জাতিক ও রাষ্ট্রীয় কিছু বরাদ্দ এই খাতে আছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাংলাদেশে যাঁরা এ ধরনের এভারেস্ট অভিযান বা অন্যান্য সামিট করেন, তাঁদের সঙ্গে এই ফেডারেশনের যোগাযোগ নেই বললেই চলে। এই ফেডারেশন থেকে কখনোই তাঁরা কোনো প্রশিক্ষণ বা অর্থনৈতিক সমর্থন পেয়েছেন, এমন দাবি শোনা যায় না।
বাংলা মাউন্টেনিয়ারিং অ্যান্ড ট্রেকিং ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা ইনাম আল হক নিশ্চিত করলেন, তাঁরা কখনো এই ফেডারেশনের দ্বারস্থ হননি এবং তাঁদের দ্বারা কোনো উপকারও কখনো পাননি। কার্যত ইনাম আল হক, এই ফেডারেশন বা রাষ্ট্রের কাছ থেকে অনুদান নিয়ে অভিযানের পক্ষেও নন। তিনি মনে করেন, এতে অযোগ্য হাতে বরাদ্দ যাওয়া, দল মুখাপেক্ষী হওয়াসহ নানাবিধ অশোভন কাণ্ডের দুয়ার খুলবে। ফলে বাংলাদেশের বেশির ভাগ এভারেস্টজয়ীর এই গুরু রাষ্ট্রীয় অর্থায়ন আশা করেন না।
কিন্তু আমি চাই। আমি চাই, রাষ্ট্র এই অভিযাত্রীদের দায়িত্ব নিক। এখন আপনি পাল্টা প্রশ্ন করতে পারেন, কেন রাষ্ট্র এই খাতে অর্থ ব্যয় করবে? কেন ‘ব্যক্তিগত’ এসব অভিযানে রাষ্ট্রীয় অর্থ খরচ করা হবে?
এককথায় উত্তর দেওয়া যায়, যে কারণে রাষ্ট্র অ্যাথলেটিকস, ফুটবল বা ক্রিকেটেও যৎসামান্য ব্যয় করে, ঠিক সেই কারণে অভিযানেও করবে। দেখুন, পর্বতারোহণ বলেন, হিমালয়ান ট্রেইল বলেন বা আয়রনম্যান—এগুলো কিন্তু আন্তর্জাতিক স্বীকৃত ক্রীড়া। এসবের স্বীকৃতি বাংলাদেশ ক্রীড়া পরিষদও দিয়েছে। কেবল প্রতিযোগিতামূলক খেলা নয় বলে এটাকে আপনার কাছে ‘খেলাধুলা’ মনে হয় না।
এখন খেলাধুলার পেছনে রাষ্ট্রের টাকা ঢেলে লাভ কী? আপনি সরল দৃষ্টিতে এর উত্তর পাবেন না। একটু তলিয়ে দেখলে দেখবেন, ক্রিকেট বা পর্বতারোহণ—সব ক্রীড়ার একটা বড় ভূমিকা হচ্ছে রাষ্ট্রের গৌরব বৃদ্ধি করা এবং তারুণ্যের শক্তিকে উজ্জীবিত রাখা। এ কারণেই বিভিন্ন রাষ্ট্র বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার এসব খেলায় খরচ করে।
আমাদের গরিব রাষ্ট্র। আমাদের এত ক্ষমতা নেই। কিন্তু যেটুকু আছে, তা দিয়ে পাশে দাঁড়ালে শাকিলদের তো এভাবে পাসপোর্ট বন্ধক রেখে টাকা নিতে হয় না। দিন শেষে আমরা এই কিষানির ছেলেরা তাহলে চোখেমুখে টাকার দুশ্চিন্তা না নিয়েই পাহাড়ে-পর্বতে, মেরুতে-মরুতে লাল-সবুজ পতাকা ওড়াতে পারি।
তাতে নিশ্চিত করেই আমাদের দরিদ্র দেশটা একটু হেসে ওঠার সুযোগ পায়।
দেবব্রত মুখোপাধ্যায়: সাংবাদিক ও লেখক