তেত্রিশেও কথা রাখা!
২ ডিসেম্বর দিনব্যাপী খেলোয়াড় কল্যাণ সংস্থার ৩৩ বছরপূর্তী অনুষ্ঠান। সুনীলের বরুণা ৩৩ বছর কথা না রাখলেও এ সংগঠনটি কথা রেখেছে এবং রাখবে। ১৯৯১ সালে এ ক্রীড়া সংগঠনের পথচলার শুরু। সে হিসেবে কয়েকটি প্রজন্ম এ সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। সংগঠনে ৬০ বছরের কাছাকাছি সদস্য যেমন আছেন, ১৫-১৬ বছরের তরুণেরাও আছেন। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অনুষ্ঠানে যোগ দিতে ১ তারিখে জলপথ, স্থলপথে সদস্যরা রওয়ানা করছেন।
অন্যদিকে বোরহানউদ্দিন সরকারি উচ্চবিদ্যালয় মাঠে সন্ধ্যায় শুরু হয়ে গেছে পরদিন সকালের নাস্তা থেকে শুরু করে দুপুরের খাবারের নানা আয়োজনের প্রস্তুতি। আমাদের দলের সদস্যরা চাপা আনন্দে। বাবুর্চি দেলোয়ার মিয়াকে নানাভাবে সাহায্য করা হচ্ছে। তাকে দিয়ে এক-দুইবার চা বানিয়ে খাওয়া হলো। রাত ১২টার দিকে তরুণদের দায়িত্ব দিয়ে বাসায় চলে গেলেন জ্যেষ্ঠরা। সকালে জানা গেল জ্যেষ্ঠ সদস্য সালাউদ্দিনের পুকুর থেকে দায়িত্বরতরা মাছ ধরে বারবিকিউ করে খেয়েদেয়ে রাত দুইটা পর্যন্ত হইহুল্লোড় করেছে। পরদিন সকালে সালাউদ্দিন হুংকার দিয়ে বললেন, কারা আমার মাছ খেয়েছে? নিস্তব্ধতা ভেঙে সে-ই বলল, তোরা বললে আমিতো মাছ ধরে দিতাম। অনেক দিন পোড়া মাছ খাই না!
সকালে এক এক করে সবাই আসতে শুরু করল। ঢাকা থেকে হাই সাহেব (আবদুল হাই) মাঠে ঢুকলেন আমাদের চোখ ছানাবড়া। জীর্ণশীর্ণ দেহ। চোখে পাওয়ার গ্লাসের ভারি চশমা। ইতিমধ্যে পৌঁছেছেন তাঁই সতীর্থ দুলাল দাদা, সুব্রত দাদা, হিরন ভাই, পন্তি দাদা। শিমুল, সামছুদ্দিনসহ আমরা তো আছিই
কোলাকুলি করতে গিয়ে দীর্ঘক্ষণ জড়িয়ে ধরা। কত্ত বছর পর দেখা! চোখে বোধহয় একটু পানি গড়িয়ে পড়ছিল। হাই ভাই এ ক্রীড়া সংগঠনের কারিগর। আবদুল হাই নাম হলেও সবার কাছে সে হাই সাহেব। তাঁর ব্যক্তিত্ব, চলাফেরা, কমান্ডিং স্টাইল সবই ছিল সাহেবি ঢঙে। দুলাল দাদা, হিরন ভাই ছিল তার দুই হাতের ভর। দুলাল দাদার পা ফ্রাকচার হয় অল্প কয় দিন আগে। প্লাস্টার বাঁধা পা নিয়ে মাঠে চলে এলেন।
সাড়ে ৯টার দিকে যার যার শরীরের মাপ (সাইজ) মতো উৎসবের টি-শার্ট দেওয়া হলো। এর মধ্যে চলে এলেন আমন্ত্রিত প্রধান অতিথি পৌর মেয়র মো. রফিকুল ইসলাম। তাঁর সঙ্গে যোগ দিলেন, পৌরসভার প্যানেল মেয়র হারুন-অর-রশীদ, বোরহানউদ্দিন সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক শাহ মোহাম্মদ আবু নোমানসহ অন্যান্য শিক্ষকেরা। স্মৃতি রক্ষার্থে গ্রুপ ছবি তোলা হল। এরমধ্যে সংগঠনের তরুণ সদস্যরা যে যার মতো সেলফি, বন্ধুদের নিয়ে ছবি তুলল। তারপর পৌর মেয়রের নেতৃত্বে বর্ণাঢ্য র্যালি বের হল। পৌর শহরের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে আবার সেই স্কুলের মাঠে। পরিকল্পিত ব্যবস্থাপনার ফলে মাত্র পাঁচ মিনিটে সবার হাতে ভুনা খিচুরি পৌঁছে গেল। খিচুরির স্বাদে বাবুর্চি দেলোয়ার মিয়ার প্রশংসার ব্যারোমিটারের পারদ ক্রমশ বাড়ছিল।
সামান্য বিরতির পর মাঠে শুরু হল প্রীতি ক্রিকেট ম্যাচ। নবীন-প্রবীণের প্রীতিময় লড়াই। ব্যাট-বলে ক্রমশ সময়কে যেন ভুলে গেছে খেলোড়েরা। অন্যদিকে দাবার বোর্ড নিয়ে বসে আছেন আরেক দল। সূর্য তখন মধ্যগগনে। এর মধ্যে দুপুরের খাবার তৈরি। খেলা শেষ করার তাড়া দেওয়া হল। হঠাৎ ফোন বেজে উঠল।
চেয়ে দেখি ঢাকা থেকে আসা আমাদের আরেক অভিভাবক কবি, সাংবাদিক, সংগীতশিল্পী, উপস্থাপক হাসান মাহমুদের নম্বর। বললাম মাঠে চলে আসেন। না বললেই নয়; ২ তারিখে তাঁর বগুড়ায় দুই দিনব্যাপী লেখক সম্মেলনে যোগ দেওয়ার কথা ছিল। যখন সে বলল, ‘আমার তো বগুড়ায় না গেলেই নয়।’ আমি বললাম, আপনি শেষদিন গিয়ে যোগ দিবেন।
—যোগাযোগব্যবস্থার কথা চিন্তা করছিস? ভোলা থেকে ৩ তারিখে পৌঁছা রীতিমত অসম্ভব।
—আমি এতো কিছু জানি না। শুধু জানি আপনি না থাকলে আমাদের প্রোগ্রাম অসম্পূর্ণ।
দুই দিন পর। হাসান দাদার ফোন, ‘আমি আসছি। বগুড়া যাব না।’
স্বস্তির বাতাসে ফুসফুস ভরে গেল।
দুপুরের খাবার। একসঙ্গে প্রায় দেড় শ লোক।
শত ব্যস্ততা সত্ত্বেও সময়মতো পৌঁছে গেলেন, খেলোয়াড় কল্যাণ সংস্থার সব সময়ের অকৃত্রিম বন্ধু, পৌর মেয়র মো. রফিকুল ইসলাম। সবার একসঙ্গে খাওয়া আর কথায় কথায় সময় বিকেলের দরজায়।
দুই দল ভাগ হয়ে ফুটবল নিয়ে নেমে গেল মাঠে। ওই মাঠের দুর্দান্ত সব খেলোয়াড়ের স্মৃতি কী তখন ভেসে উঠছিল! হয়তো। সন্ধ্যায় শেষ হলো মাঠের আয়োজন।
সন্ধ্যার পর পৌরসভা মিলনায়তনে সাংস্কতিক অনুষ্ঠান। হাসান মাহমুদ তো আছেনই। তাঁর সঙ্গে যোগ দিয়েছেন ভোলার সাংস্কৃতিক অঙ্গনের অতি পরিচিত মুখ তালহা তালুকদার বাঁধন, বরগুনা থেকে আগত বাঁশি ও বেহালাশিল্পী সোহেল খান। ছিলেন বরিশালের যন্ত্রশিল্পীরা।
মঞ্চ ও টেলিভিশনের নিয়মিত শিল্পী হাসান মাহমুদ একে একে গাইলেন, ‘চুমকি চলেছে একা পথে’, ‘ওরে নীল দরিয়া’, ‘আছেন আমার ব্যারিস্টার, আছেন আমার মোকতার’, ‘এ আকাশকে সাক্ষী রেখে’র মতো সব সময়ের জনপ্রিয় গান। মাঝখানে সোহেল খানের বাঁশির সুরে ওরে নীল দরিয়া, বুকের ভিতর বান্ধি রাখমু তোমারে দর্শকদের মোহাবিষ্ট করে রাখে।
তালহা তালুকদার বাঁধন একে একে গাইলেন প্রিয়তমা, ও আমার বন্ধু গো, শুধু একবার, কি ছিলে তুমি, তোরে পুতুলের মতো করে সাজিয়ে, সোনা বন্ধু আমারসহ নতুন প্রজন্মের পছন্দের অসাধারণ কিছু গান।
গানের আগে সরোয়ার শিমুলের সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি পৌর মেয়র মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, মফস্সলে ৩৩ বছর একটি ক্রীড়া সংগঠন সগর্বে সক্রিয়ভাবে টিকে থাকা নিঃসন্দেহে বিরল বিষয়। তিনি এ সংগঠনের সমৃদ্ধি কামনা করে সব সময় পাশে থাকার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। ওই সময় সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা আবদুল হাই, দুলাল দাদাকে সব সদস্য দাঁড়িয়ে শুভেচ্ছাসহ সম্মান জানান।
প্রতিষ্ঠার গৌরবের ৩৩ বছর নিয়ে আমাদের মূলত লক্ষ্য ছিল, সেই শুরু থেকে যারা এ সংগঠনের জড়িত ছিলেন সবাইকে একত্রিত করা। একটা দিন আমাদের মতো করে কাটাতে। এ ক্ষেত্রে শতভাগ সম্ভব না হলেও, বলা চলে অধিকাংশের উপস্থিতি নিশ্চিত করা গেছে।
খেলোয়াড় কল্যাণ সংস্থার প্রতিষ্ঠার গৌরবের ৩৩ বছর। মোটা দাগে বললে উপজেলা লেভেলে এত বছর একটি ক্রীড়া সংগঠন বাঁচিয়ে রাখা কঠিন। কিন্তু খেলোয়াড় কল্যাণ সগৌরবে টিকে আছে। বিত্তবৈভব নেই, বসার নিজস্ব যায়গা নেই। এ ছাড়া নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যে বলা চলে ভালোভাবেই আছে। এ থাকার পেছনে কারণ হলো শুরু থেকেই কিছু ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর মানসিকতার কিছু লোক আছে বলে। আরেকটা বিষয় হলো, সামাজিক দায়বদ্ধতার যায়গা। আজকাল দৌড়ের পৃথিবীতে এ অলাভজনক খাতে সময় দেওয়ার মতো কয়জন আছে!
লেখক: মোবাশ্বির হাসান শিপন, শিক্ষক, সংগঠক