রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠাতা এফ আর খান স্যার

সমাজবিজ্ঞানী অধ্যাপক ফজলুর রশিদ খান (এফ আর খান)ছবি: লেখকের পাঠানো

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা, বাংলাদেশের প্রথিতযশা সমাজবিজ্ঞানী অধ্যাপক ফজলুর রশিদ খান (এফ আর খান) নামটি শুনলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে শিশুসুলভ, সৌম্যদর্শন, ভদ্রজনোচিত শিক্ষকের প্রতিচ্ছবি। তিনি ১৯৪০ সালে ৩ মার্চ টাঙ্গাইলের সেলিমাবাদ ইউনিয়নের সেলিমাবাদ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা মরহুম এস এম বজলুর রহমান খান। ১৯৫৫ সালে মানিকগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী মডেল হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন তিনি। পরে ১৯৫৭ সালে মানিকগঞ্জের দেবেন্দ্র কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট অব আর্টস পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে পাস করেন। তিনি ১৯৫৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সদ্য প্রতিষ্ঠিত সমাজবিজ্ঞান বিভাগে প্রথম ব্যাচে ভর্তি হন এবং ১৯৬০ সালে দ্বিতীয় শ্রেণিতে প্রথম স্থান লাভ করে বিএ অনার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি ১৯৬১ সালে একই বিভাগ থেকে মেধাতালিকায় প্রথম স্থান লাভ করে এমএ ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর ১৯৬৩ সালে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের আন আরবনে অবস্থিত ইউনিভার্সিটি অব মিশিগান থেকে জনসংখ্যাতত্ত্ব বিষয়সহ সমাজবিজ্ঞানে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের প্রভাষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন।

উল্লেখ্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পর ১৯৬৪ সালের ৪ অক্টোবর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধীন সমাজবিজ্ঞান বিভাগটি চালু হয়। প্রতিষ্ঠাকালীন বিভাগটির প্রধান ছিলেন বদরুদ্দীন উমর। ১৯৬৯ সালের ৭ অক্টোবর এফ আর খান তাঁর প্রিয় ছাত্র অধ্যাপক আবদুল কাদির ভূঁইয়ার অনুরোধে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সরাসরি রিডার (সহযোগী অধ্যাপক সমমান) পদে রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগে যোগ দেন। যোগ দেওয়ার পর থেকেই তিনি সমাজবিজ্ঞান বিভাগ প্রতিষ্ঠায় সক্রিয় নেতৃত্ব প্রদান করেন। মূলত তাঁর যোগ দেওয়ার পরপরই সমাজবিজ্ঞান বিভাগটি রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ থেকে পৃথক হয়। তিনি নতুন বিভাগের দায়িত্ব পান। উল্লেখ্য, সে সময় সমাজবিজ্ঞান ও সমাজকর্ম একত্রে ছিল এবং বিভাগটির নাম ছিল সমাজবিজ্ঞান ও সমাজকর্ম (৭-১০-৬৯ থেকে ১২-১১-৭২ পর্যন্ত)। এরপর ১৯৭২ সালের ১৩ নভেম্বর সমাজবিজ্ঞান ও সমাজকর্ম স্বতন্ত্র বিভাগ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।

অধ্যাপক এফ আর খান সমাজবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে থাকেন। তাঁর নেতৃত্বে বিভাগটির নবতর গতির সঞ্চার হয়। বিভাগটির সুনাম দেশের বিদ্বান মহলে ছড়িয়ে পড়ে। তিনি সমাজবিজ্ঞান ও সমাজকর্ম বিভাগের অধ্যক্ষ (৭-১০-৬৯ থেকে ১২-১১-৭২ পর্যন্ত), সমাজবিজ্ঞান বিভাগের বিভাগের অধ্যক্ষ, সমাজবিজ্ঞান বিজ্ঞান সভাপতির পদ অলঙ্কৃত করেন। পরে ১৯৭৭ সালে তিনি যুক্তরাজ্যের এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৭৮ সালে তিনি অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পান।

রাজশাহীর বিশ্ববিদ্যালয়ে সুদীর্ঘ (৩৬ বছর) ও বর্ণাঢ্য কর্মজীবনে তিনি বহু একাডেমিক, প্রশাসনিক ও সাংগঠনিক পদে বহাল ছিলেন। যেমন কলা অনুষদের ডিন, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের প্রতিষ্ঠাতা ডিন (২৭-১২-১৯৮৬ থেকে ২২-১২-১৯৮৮), পরবর্তীকালে দ্বিতীয় মেয়াদে (২৩-১-১৯৯৩ থেকে ২২-১-১৯৯৫)। এ ছাড়া সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের অধীন গ্রন্থাগারবিজ্ঞান বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সভাপতি, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক হলের প্রভোস্ট, সিন্ডিকেট সদস্য, সিনেট সদস্য, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি, বাংলাদেশ সমাজবিজ্ঞান সমিতির সহসভাপতি প্রভৃতি। এ ছাড়া তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজের (আইবিএস) সিনিয়র ফেলো এবং খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। বাংলাদেশে সমাজবিজ্ঞান পাঠদানের শুরুর দিকে বাংলায় ভাষায় এবং বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে তেমন কোনো গ্রন্থ ছিল না। ফলে শিক্ষার্থীরা সমাজবিজ্ঞান বিষয়টিকে সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে অপারগ ছিল। বিষয়টি উপলব্ধি করে তিনিই প্রথম সমাজবিজ্ঞানের ওপল গ্রন্থ রচনায় এগিয়ে আসেন। তাঁর লিখিত গ্রন্থগুলোর হলো ‘সোসিওলজি অব পাকিস্তান’ (১৯৬৬), ‘সোশ্যাল হিস্ট্রি’ (১৯৬৭) ও ‘সমাজবিজ্ঞানের মূল তত্ত্ব’ (১৯৭৩)। তাঁর এই গ্রন্থগুলো নবীন শিক্ষার্থী থেকে প্রবীণ শিক্ষক পর্যন্ত সবার কাছে আজও সমাদৃত। তাঁর ১৫টি গবেষণা প্রবন্ধ দেশ-বিদেশের খ্যাতনামা জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। তিনি রাজশাহী ইউনিভার্সিটি স্টাডিজ জার্নালের প্রধান সম্পাদক ও সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য, সামাজিক জার্নাল ও আইবিএস জার্নালের সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য ছিলেন। এ ছাড়া তিনি উল্লেখযোগ্যসংখ্যক গবেষণা তত্ত্বাবধান করেছেন। তিনি প্রায়ই বলতেন, বাংলাদেশের মতো উন্নয়নকামী দেশে সমাজতাত্ত্বিক জ্ঞানের প্রয়োজন অত্যন্ত বেশি।

অধ্যাপক এফ আর খান ছিলেন সদাহাস্যোজ্জ্বল, বন্ধুবৎসল, নিরহংকার, অমায়িক এবং একজন জ্ঞানপিপাসু মানুষ। মহিরুহ তুল্য এই ব্যক্তির জ্ঞানালোকের স্পর্শে যাঁরাই এসেছেন, তাঁরা নতুন জ্ঞানভান্ডারের সন্ধান পেয়েছেন। অধ্যাপক এফ আর খান সমাজবিজ্ঞানকে বাংলাদেশে জ্ঞানের জগতে অধিকতর পরিচিত করে তোলেন। ২০০৫ সালের ৩ মার্চ অধ্যাপক এফ আর খান কর্মজীবন থেকে অবসর গ্রহণ করেন। অবসর পরবর্তী সময়ে তিনি ঢাকায় অবস্থান করেন এবং কয়েক বছর ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাডজাঙ্কট ফ্যাকাল্টি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

অধ্যাপক এফ আর খান গত ২১ জানুয়ারি ঢাকায় ইন্তেকাল করেন। তিনি বাধক্যের কারণে নানা জটিলতা নিয়ে ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালে ভর্তি হন। তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৪ বছর। তাঁর মৃত্যুর আগেই তাঁর স্ত্রী (সুরাইয়া বেগম) মারা যান। মৃত্যুকালে তিনি এক কন্যা, জামাতা ও এক নাতি রেখে গেছেন। রেখে গেছেন অগণিত ভক্ত, অনুরাগী, ছাত্রছাত্রী, গবেষক ও গুণগ্রাহী।

তথ্যসুত্র: স্যুভেনির ৫ম সম্মিলন ২০২৪, অধ্যাপক আব্দুর রহমান সিদ্দিকী, অধ্যাপক ওয়ারদাতুল আকমামের লেখা, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইট।

লেখক: খ ম রেজাউল করিম, সমাজ–গবেষক ও শিক্ষক, সরকারি মাইকেল মধুসূদন কলেজ, যশোর।