ন্যায়বিচার নিশ্চিতে গ্রাম আদালত সক্রিয়করণ প্রকল্পের তৃতীয় ধাপের যাত্রা শুরু
তৃণমূল জনগোষ্ঠীর জন্য দ্রুত, সহজ ও স্বল্প ব্যয়ে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে ইউনিয়ন পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত গ্রাম আদালতকে আরও কার্যকর ও জনবান্ধব করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। স্থানীয় সরকার বিভাগ, জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সহায়তায় বাস্তবায়িত ‘বাংলাদেশে গ্রাম আদালত সক্রিয়করণ (তৃতীয় পর্যায়) প্রকল্প’ এরই মধ্যে মাঠপর্যায়ে কার্যক্রম শুরু করেছে।
রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে ‘গ্রামীণ নারী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য জেন্ডার–সংবেদনশীল ও অন্তর্ভুক্তিমূলক গ্রাম আদালতের সেবা প্রচারের গুরুত্ব’ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। সেখানে বক্তারা বলেন, গ্রামীণ পটভূমিতে নারীরা ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠী সামাজিক বাধা, সচেতনতার অভাব ও সীমিত সুযোগ–সুবিধার কারণে ন্যায়বিচার থেকে প্রায়ই বঞ্চিত হন। বিশেষ করে অনেক নারী নিজেদের অধিকার সম্পর্কেও গ্রাম আদালতে যেতে দ্বিধা বোধ করেন।
প্রকল্পের আওতায় এরই মধ্যে আইনি সচেতনতা বৃদ্ধি, ইউনিয়ন পরিষদের নারী সদস্যদের সক্রিয় ভূমিকা নিশ্চিতকরণ এবং নিয়মিত প্রশিক্ষণ ও তথ্য প্রচারের মাধ্যমে নারীর নেতৃত্ব ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ বাড়ানো সম্ভব হয়েছে। এর ফলে গ্রামীণ জনগণের মধ্যে ন্যায়বিচারের প্রতি আস্থা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।
নাগরিক সংবাদে জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই–মেইল: [email protected]
সভায় উপস্থাপিত তথ্য অনুযায়ী, গত বছর পর্যন্ত গ্রাম আদালতে প্রায় ১ লাখ ২৬ হাজার মামলা দায়ের হয়েছে। এর মধ্যে ৩৩ হাজারের বেশি মামলা নারী আবেদনকারীরা করেছেন, যা নারীর ন্যায়বিচারে অংশগ্রহণের ইতিবাচক অগ্রগতি নির্দেশ করে। তা ছাড়া মামলার প্রক্রিয়া স্বচ্ছ ও সহজ হওয়ায় উচ্চ আদালতে আপিলের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম। এটি গ্রাম আদালতের প্রতি জনগণের আস্থা বৃদ্ধির স্পষ্ট প্রতিফলন। গোলটেবিল বৈঠকে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মমতাজ আহমেদ। উদ্বোধনী বক্তব্য দেন স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব মো. রেজাউল মাকছুদ জাহেদী, প্রকল্প পরিচিতি ও শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন বাংলাদেশে গ্রাম আদালত সক্রিয়করণ (তৃতীয় পর্যায়) প্রকল্পের জাতীয় প্রকল্প সমন্বয়ক বিভাষ চক্রবর্তী।
অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বাংলাদেশে গ্রাম আদালত সক্রিয়করণ (তৃতীয় পর্যায়) প্রকল্পের জেন্ডার অ্যানালিস্ট শামিমা আক্তার শাম্মী। আলোচনার সারসংক্ষেপ ও সুপারিশ উপস্থাপন করেন স্থানীয় সরকার বিভাগের অতিরিক্ত সচিব ও বাংলাদেশে গ্রাম আদালত সক্রিয়করণ (তৃতীয় পর্যায়) প্রকল্পের জাতীয় প্রকল্প পরিচালক সুরাইয়া আখতার জাহান।
স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব মো. রেজাউল মাকছুদ জাহেদী উদ্বোধনী বক্তব্যে বলেন, ‘গ্রাম আদালতের তৃতীয় ফেজের সেবার প্রচার সবাই যেন জানতে পারে, তাই আমরা মিডিয়ার কাছে অনুরোধ করছি। প্রান্তিক পর্যায়ে এই প্রচারণার জন্য সাংবাদিক ভাইয়েরা সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখতে পারেন।’ বৈঠকের শেষ পর্যায়ে তিনি আরও বলেন, ‘২০০৯ সালে এ প্রকল্প শুরু হয়েছে, ২০২৭ পর্যন্ত এ প্রকল্পটি চলমান থাকবে। প্রতিটি গ্রাম্য আদালতে নারীদের অন্তর্ভুক্ত করলে কার্যক্রম আরও গতিশীল হবে।’
জাতীয় প্রকল্প সমন্বয়ক বিভাষ চক্রবর্তী বলেন, প্রকল্পের উদ্দেশ্য হচ্ছে গ্রামাঞ্চলে, বিশেষ করে নারী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে ন্যায়বিচার পাইয়ে দেওয়া। স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে গ্রাম আদালত সক্রিয়করণ নিশ্চিত করা, আইন পর্যালোচনা করা, সরকারিভাবে দায়িত্ব নেওয়া এবং গ্রামের জনগোষ্ঠীকে আইনি সহায়তা দেওয়া। তিনি জানান, গ্রাম আদালতে মামলা দায়ের করা ৭৮ শতাংশই নিষ্পত্তি হয়েছে। গড়ে ১৮ দিনে একটি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে, খরচ হয়েছে গড়ে ৩২৮ টাকা। সারা দেশে ১০ লাখের বেশি মানুষের কাছে এটি পৌঁছে গেছে।
বৈঠকে প্রকল্পের উপকারভোগীর মধ্যে নরসিংদীর বিলকিস বেগম তাঁর অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন এবং গ্রাম আদালতের নারী প্রতিনিধি রত্না আক্তার জানান, ‘গ্রাম আদালতে আসা দুই পক্ষকে বসিয়ে ন্যায়বিচার প্রচার করি।’ তবে কার্যক্রম আরও বৃদ্ধির সুপারিশ করেন তিনি।
ইউএনডিপির অ্যাসিস্ট্যান্ট রেসিডেন্ট রিপ্রেজেন্টেটিভ মো. আনোয়ারুল হক বলেন, ‘প্রায় ১০ হাজার মামলা জেলা আদালত থেকে গ্রাম আদালতে পাঠানো হয়েছে, যেটা আমাদের জন্য ইতিবাচক। কারণ, এতেই বোঝা যাচ্ছে, গ্রাম আদালতের ওপর প্রশাসন ও জনগণের আস্থা আছে। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্য ইউনিয়ন পরিষদে গ্রাম আদালত একটি দারুণ সুযোগ করে দিয়েছে।’
গোলটেবিল বৈঠকে গ্রাম আদালতের কার্যক্রমের ওপর একটা প্রামাণ্যচিত্র দেখানো হয়। গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা একমত হন যে গ্রাম আদালতের সেবা আরও জেন্ডার–সংবেদনশীল ও অন্তর্ভুক্তিমূলক হলে ন্যায়বিচার সহজলভ্য হবে এবং সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে এ উদ্যোগ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। অনুষ্ঠানে জাতীয় মহিলা সংস্থার নির্বাহী পরিচালক শাহানা সারমিন, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব মোছা. হাজেরা খাতুন ও মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব প্রকাশ কান্তি চৌধুরীসহ জাতীয় পর্যায়ের নীতিনির্ধারক, আইন বিশেষজ্ঞ, গণমাধ্যমকর্মী, শিক্ষাবিদ ও উন্নয়ন সহযোগীরা উপস্থিত ছিলেন।