ক্রিকেটের বিশ্বমঞ্চে দক্ষিণ আফ্রিকার শিরোপা–খরা কি এবার কাটবে?

ছবি: সংগৃহীত

দক্ষিণ আফ্রিকা। দলটির কথা মনে হলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে ১৯৯৯ বিশ্বকাপের সেফিফাইনাল। পুরো টুর্নামেন্টজুড়ে দুর্দান্ত খেলা দলটির ফাইনালে উঠতে প্রয়োজন ছিল ৪ বলে ১ রান। স্ট্রাইকে ল্যান্স ক্লুজনার (ওই বিশ্বকাপে ম্যান অব দ্য সিরিজ হয়েছিলেন)! ননস্ট্রাইকে অ্যালান ডোনাল্ড। ক্লুজনার মিড অফে বল পাঠিয়ে দৌড়ে ননস্ট্রাইকে পৌঁছে গেলেও দিশাহারা হলেন ‘সাদা বিদ্যুৎ’! রান নিতে গিয়ে শেষে ব্যাট রেখে দৌড় দিলেও শেষ রক্ষা হলো না! শেষ ব্যাটসম্যান হিসেবে রানআউট হয়ে গেলেন। ফাইনালে অস্ট্রেলিয়া!

কী হৃদয়বিদারক দৃশ্য! হ্যান্সি ক্রনিয়ে, জন্টি রোডস আর ক্লুজনাররা থমকে গেলেন।
এই সেই দক্ষিণ আফ্রিকা। শুধু স্পিনারের অভাব থাকলেও দলটা সব সময় সেরা খেলা উপহার দেয়। ব্যাটিং, বোলিং কিংবা ফিল্ডিং—সব বিভাগেই দুর্দান্ত ওরা। গ্যারি কার্স্টেন-হার্শেল গিবস আর বোলিংয়ে পোলক-এনটিনি থেকে শুরু করে ডি ভিলিয়ার্স-ডি কক আর স্টেইন-মরকেল কিংবা হালের ক্লাসেন-রাবাদা—এরা সবাই বিশ্বসেরা!

কিন্তু বিশ্বসেরা এই দল সারা বছর এমনকি বৈশ্বিক টুর্নামেন্টের গ্রুপ পর্বে দারুণ পারফর্ম করলেও নকআউট পর্বে গিয়ে খেই হারিয়ে ফেলে। যেন ক্রিকেটের সমস্ত ব্যাকরণ তারা ভুলে যায়...! ফলাফল—তাদের ঝুলিতে ১৯৯৮ সালের নকআউট (বর্তমানে আইসিসি চ্যাম্পিয়নস ট্রফি) বিশ্বকাপের শিরোপা ছাড়া কোনো বৈশ্বিক টুর্নামেন্টের শিরোপা নেই!

নকআউট পর্বের চাপ নিতে না পারা দলটির সঙ্গে লেগে যায় ‘চোকার’ তকমা। ফ্যানদের কাছে ক্রিকেটের অভিশপ্ত দল!

২০১৪ সালে এইডেন মার্করামের দক্ষিণ আফ্রিকা অনূর্ধব-১৯ বিশ্বকাপের শিরোপা জিতলেও সিনিয়ররা হতাশ করেই যাচ্ছিলেন। ফাইনাল তো দূরে থাক, সেমিফাইনালেও তাঁদের খেলা দুঃসাধ্য হয়ে যায়। নকআউট পর্বে খেলোয়ারদের যেন জুজুর ভয় আটকে ধরে। চাপে হুড়মুড় করে ভেঙে যায় ক্রিকেট সাউথ আফ্রিকা।

এবার টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ-২০২৪–এ কেটেছে সেই খরা! ব্রায়ান লারা ক্রিকেট একাডেমিতে আজ রচিত হলো দক্ষিণ আফ্রিকার নতুন ইতিহাস। টুর্নামেন্টে রূপকথার রচয়িতা আফগানিস্তানকে একরকম উড়িয়ে দিয়ে ফাইনালে পৌঁছে গেছে তারা! আফগানিস্তানকে মাত্র ৫৬ রানে অলআউট করে দিয়ে মাত্র ১০ ওভারের মাথায় ৯ উইকেটের বিশাল ব্যবধানে জয় তুলে নেয় তারা। ফাইনালে প্রতিপক্ষ ভারত নয়তো ইংল্যান্ড।

এবার কি পারবে দক্ষিণ আফ্রিকা ক্রিকেট দল?

ইতিহাস বলে এ পর্যন্ত সিনিয়র ও জুনিয়র দল দুবার বৈশ্বিক টুর্নামেন্টের ফাইনালে উঠে দুবারই শিরোপা জিতেছে। অর্থাৎ ফাইনালে শতভাগ সাফল্য তাদের।

ছবি: সংগৃহীত

অন্যদিকে টি-টোয়েন্টিতে তাদের রেকর্ড খারাপ নয় ভারত ও ইংল্যান্ডের সঙ্গে। ভারতের সঙ্গে ২৬ বারের সাক্ষাতে দক্ষিণ আফ্রিকা ম্যাচ জিতেছে ১১টি, ভারত জিতেছে ১৪টি, ১টি ম্যাচ পরিত্যক্ত হয়েছে। অন্যদিকে ইংল্যান্ডের সঙ্গে ২৬ বারের সাক্ষাতে দক্ষিণ আফ্রিকার জয় ১৩ ম্যাচে, ইংল্যান্ডের জয় ১১ ম্যাচে, ১টি ম্যাচ হয়েছে পরিত্যক্ত। তবে সর্বশেষ পাঁচ ম্যাচের পরিসংখ্যান অনুযায়ী এগিয়ে কিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকাই। ভারতের সঙ্গে সর্বশেষ পাঁচবারের দেখায় দক্ষিণ আফ্রিকার জয় ৩ ম্যাচে, ভারতের জয় ১ ম্যাচে, অন্য ম্যাচটি পরিত্যক্ত।

এদিকে ইংল্যান্ডের সঙ্গে সর্বশেষ পাঁচ ম্যাচের চারটিতেই জয় তুলে নিয়েছে প্রোটিয়ারা। বিপরীতে একটিমাত্র জয় ইংল্যান্ডের।

ছবি: সংগৃহীত

সব সময়ের মতোই দক্ষিণ আফ্রিকার মূল ভরসা ব্যাটিং। বিধ্বংসী ব্যাটিং লাইনআপের মূল স্তম্ভ কুইন্টন ডি কক। সঙ্গে আছেন রিজা হেনড্রিকস, ডেভিড মিলাররা। আরও আছেন অতি মারমুখী ব্যাটিংয়ের জন্য ক্রিকেটের ‘হালাকু খান’ উপাধি পাওয়া বিধ্বংসী ব্যাটসম্যান হাইনরিক ক্লাসেন। বোলিংয়েও দক্ষিণ আফ্রিকা কম যায় না। কাগিসো রাবাদা ও আনরিক নর্কিয়া যেকোনো দলের ব্যাটিং লাইনআপের জন্য মূর্তিমান আতঙ্ক। আছেন স্পিনার কেশব মহারাজ ও তাব্রেইজ শামসি। ব্যাট হাতেও যাঁরা খুব একটা খারাপ নন। আরও আছেন ট্রিস্টান স্টাবস ও মার্কো ইয়ানসেনের মতো তুখোড়-তরুণ অলরাউন্ডাররা, যাঁরা নিজেদের দিনে তাঁদের পারফরম্যান্স দিয়ে যেকোনো প্রতিপক্ষকে কুপোকাত করতে পারেন। সব শেষে বলতে হয়, শীতল মস্তিষ্কের খেলোয়াড় হিসেবে পরিচিত দলপতি এইডেন মার্করামের কথা। দুর্দান্ত ব্যাটিংয়ের পাশাপাশি বোলিংটাও তাঁর খারাপ হয় না। সঙ্গে যুক্ত হয়েছে তাঁর ক্যাপ্টেন হিসেবে ২০১৪ সালের অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ জয়ের অভিজ্ঞতা।

তা ছাড়া এবারের বিশ্বকাপে কয়েকটি ম্যাচে বিশেষ করে বাংলাদেশ ও নেপালের সঙ্গে শেষ মুহূর্তে যেভাবে তারা ম্যাচ বের করে নিয়ে এসেছে, তা সত্যিই প্রশংসনীয়। আর সেমিফাইনালে রূপকথা লিখে যাওয়া আফগানিস্তানকে একরকম উড়িয়ে তারা যেন জানান দিল, ‘এবার আমরা এসেছি বিশ্বকাপ ক্রিকেট জয় করতে!’

কেনসিংটন ওভালের মাঠে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বাইরে সফলতম দল ইংল্যান্ড। তাদের সর্বোচ্চ স্কোর ২০৪/৯। চলতি বিশ্বকাপে এই মাঠে অস্ট্রেলিয়ার কাছে ৩৬ রানে পরাজিত হলেও টুর্নামেন্টের চমক ইউএসএকে এই মাঠে তারা উড়িয়ে দিয়েছে ১০ উইকেটের ব্যবধানে। অন্যদিকে এই মাঠে ভারতের রেকর্ডও বেশ সমীহজাগানিয়া।
এই মাঠে প্রচুর রান ওঠে। সুতরাং দুই দলই ব্যাটিংয়ের সুবিধা পাবে। পার্থক্য গড়ে দিতে পারে বোলিং। তবে নজর রাখতে হবে ফিল্ডিংয়ের ওপরও। এখানে সফল দক্ষিণ আফ্রিকা। এই বিশ্বকাপে ফিল্ডিংয়ের সবচেয়ে বেশি এগিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকা। ক্যাচ নেওয়া ও রান বাঁচানোয় তাদের সফলতা শতকরা ৮৬ শতাংশ। গোটা টুর্নামেন্টজুড়ে উইকেটের পেছনে কুইন্টন ডি কক আর মাঠে এইডেন মার্করাম ও স্টিস্টান স্টাবসের ভূমিকা অসাধারণ।

ফাইনালে ভারত কিংবা ইংল্যান্ড—দুটিই প্রবল প্রতিপক্ষ। তবে এবার দক্ষিণ আফ্রিকার মূল ভরসা হবে তাদের আত্মবিশ্বাস। কী ঘটবে, জানতে অপেক্ষা করতে হবে ২৯ জুন পর্যন্ত।

একজন সমর্থক হিসেবে চাওয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা ইতিহাস সৃষ্টি করে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট বিশ্বকাপ ২০২৪ জিতুক। এতে ক্রিকেটের দর্শক যেমন বাড়বে, তেমনি ক্রিকেট নিয়ে নতুন করে উন্মাদনার সৃষ্টি হবে।

লেখা: রবিউন নাহার তমা