বাংলাদেশের পাঁচ ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীকে নিয়ে বই
বাংলাদেশে বসবাস করে ৫০টির মতো ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষ। ২০২২ সালের জনশুমারি অনুযায়ী, বাংলাদেশে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর জনসংখ্যা ১৬ লাখ ৫০ হাজার ১৫৯। এর মধ্যে নারীর সংখ্যা ৮ লাখ ২৫ হাজার ৪০৮ আর পুরুষের সংখ্যা ৮ লাখ ২৪ হাজার ৭৫১। তবে মানবাধিকারকর্মীদের দাবি, এই সংখ্যা আরও বেশি এবং দুর্গম এলাকায় তথ্যসংগ্রাহকেরা না যাওয়ায় ওই সব এলাকায় বসবাসরত ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর প্রকৃত তথ্য জনশুমারিতে অন্তর্ভুক্ত হয়নি।
জনশুমারি অনুযায়ী, চট্টগ্রাম বিভাগে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী জনসংখ্যা ৯ লাখ ৯০ হাজার ৮৬০, ঢাকায় ৮২ হাজার ৩১১, খুলনায় ৩৮ হাজার ৯৯২, ময়মনসিংহে ৬১ হাজার ৫৫৯, রাজশাহীতে ২ লাখ ৪৪ হাজার ৫৯২, রংপুরে ৯১ হাজার ৭০, সিলেটে ১ লাখ ৩৬ হাজার ৫৯৪ জন ও বরিশালে ৪ হাজার ১৮১।
অঞ্চল নিরিখে পার্বত্য চট্টগ্রামে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। এ অঞ্চলে বসবাস করে ১৩টি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষ। তাদের মধ্যে চাকমা, ত্রিপুরা, ম্রো, খুমি, লুসাই, মারমা, রাখাইন, চাক, বম, খেয়াং, পাঙ্খোয়া জাতিগোষ্ঠী উল্লেখযোগ্য। বাকি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষেরা বসবাস করেন বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। এদের মধ্যে মণিপুরি, গারো, সাঁওতাল ও রাজবংশী উল্লেখযোগ্য।
এদের মধ্যে চাকমা, মণিপুরি, গারো, সাঁওতাল ও রাজবংশী—পাঁচটি জাতিগোষ্ঠী নিয়ে আলাদা গ্রন্থ লিখেছেন গবেষক-লেখক মুস্তাফা মজিদ। তিনি প্রান্তিক এসব জনগোষ্ঠীর উত্স সন্ধানে তথা তাদের সামাজিক নৃতাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক পরিচয়, জীবনধারা, ধর্ম, মূল্যবোধ ও মনোবৃত্তি, পরিবার ও উত্তরাধিকার, গৃহায়ণ, খাদ্যাভ্যাস, পার্বণ, অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া ইত্যাদি নিয়ে বইগুলো লিখেছেন।
চাকমা
প্রচ্ছদ: কনকচাঁপা চাকমার চিত্রকর্ম অবলম্বনে
প্রথম প্রকাশ: ২০২৩
মূল্য: ১০০০ টাকা
পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে বসবাসকারী ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীদের মধ্যে চাকমারাই সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং সবচেয়ে শিক্ষিত ও উন্নত। চাকমা সার্কেল এবং মং সার্কেলে চাকমারা বেশি সংখ্যায় বসবাস করে। চাকমারা মঙ্গোলীয় জাতিগোষ্ঠী হলেও তাদের ভাষা ইন্দো-আর্যভুক্ত। তারা বৃহৎ পরিসরে ইন্দো-এশীয় অঞ্চলের মানুষ হলেও কালের আবর্তে পূর্ব ভারতীয়, তিব্বত ও ব্রহ্মদেশের আদিম কৌম সমাজেরই মানুষ। বর্তমানে তারা আদিম কিরাত জাতিভুক্ত মঙ্গোলীয় তিব্বতি-বর্মি শাখার জাতিগোষ্ঠীর মানব হিসেবে এই ভূখণ্ডে বসবাস করে আসছে। স্থান বদলের কারণে তাদের শারীরিক রসায়নসহ সাংস্কৃতায়ন ঘটেছে নানা ভাঙাগড়া ও ধর্মীয় পালাবদলের মধ্য দিয়ে।
বাংলাদেশের বিভিন্ন ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষের মতো চাকমা জাতির মানুষের জীবনযাপনও প্রায় একই ক্ষেত্রে গাঁথা ও অভিন্ন। অন্য ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর মতো চাকমারাও তাদের আদি গোত্রবন্ধন, আচার-আচরণ, লোকজ বিশ্বাসবোধ, অনক্ষর সমাজের মায়াবাদ, অদৃষ্টবাদের দুর্লক্ষণ নিয়ে তাদের আদি ঐতিহ্য ধারণ করে সমাজ বন্ধন অক্ষুণ্ন করে গেছে। ক্ষুদ্র এই জাতিগোষ্ঠী প্রান্তিক জনগোষ্ঠীরই মানব, তথাপি সভ্যতার সোপানে তাদের অবদানও কম নয়; এবং এই অবদান অস্বীকার করার উপায় নেই। চাকমা সার্কেল চিফ তথা বর্তমান চাকমা রাজা দেবাশীষ রায়। তিনি চাকমা সার্কেলের ৪৭তম রাজা।
মণিপুরি
প্রচ্ছদ: তামান্না রহমানের মণিপুরি নৃত্যদৃশ্য অবলম্বনে
প্রথম প্রকাশ: ২০২২
মূল্য: ৬৮০ টাকা
মণিপুরিরা বাংলাদেশে অভিবাসিত ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী। মূলত ভারতের মণিপুর রাজ্যে তাদের প্রধান বসতি। প্রাচীনকালে মণিপুর নানা নামে অভিহিত ছিল। বাংলাদেশে বসবাসরত মণিপুরিরা মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, সিলেট ও সুনামগঞ্জের সমতলে দীর্ঘকাল ধরে বসবাস করে আসছে। এর মধ্যে মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জে অধিকাংশ মণিপুরির বাস। এ ছাড়া একসময় ঢাকার তেজগাঁও, মিরপুর, বৃহত্তর কুমিল্লা ও ময়মনসিংহে মণিপুরিরা বসবাস করত। ঢাকায় তেজগাঁও ও মিরপুরে মণিপুরিপাড়া তাদের বসবাসের কারণেই গড়ে উঠেছিল।
বাংলাদেশের মণিপুরিরা বিষ্ণুপ্রিয়া, মৈতৈ দুই নরকায় গোষ্ঠীতে বিভক্ত। চেহারা ও ভাষাগত ব্যবধান ছাড়া তাদের সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য প্রায় একই।
বাংলাদেশে যতগুলো ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী রয়েছে, তাদের মধ্যে মণিপুরি সংস্কৃতি সবচেয়ে ঐতিহ্যমণ্ডিত ও সমৃদ্ধিশালী। তাদের নৈমিত্তিক জীবনাচারের সঙ্গে ধর্ম ও সংস্কৃতি একাকার হয়ে গেছে। বিশেষত, মণিপুরি ধ্রুপদি নৃত্যকলা। আর তা শুধু ভারতের মণিপুরি রাজ্যেই বিস্তৃত নয়, ভারতের সব রাজ্যে এবং বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এর সুনাম ছড়িয়ে আছে। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মণিপুরি নৃত্যের বিকাশ সাধন ও তার পরিধি বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত করেন।
মণিপুরিরা যেমন উন্নত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অধিকারী, তেমনি আচার-আচরণে সদা বিনয়ী, মৃদুভাষী ও সত্যনিষ্ঠ। তাদের মধ্যে কলহ-বিবাদ নেই; এবং মিথ্যাচার, প্রতারণা ও প্রবঞ্চনা তাদের স্বভাবে নেই। জাতি হিসেবে শ্রমশীল। নারী-পুরুষ সবাই সমানভাবে শ্রমদান করেন। বিশেষত মেয়েরা। সমাজে কোনো ভিক্ষাবৃত্তি নেই। তারা এ পেশাকে ঘৃণ্য ও পাপকাজ মনে করে। বরং পরস্পরকে সাহায্য-সহযোগিতা করে। জাতি হিসেবে মণিপুরিরা স্বাধীনচেতা।
গারো
প্রচ্ছদ: কনকচাঁপা চাকমার চিত্রকর্ম অবলম্বনে
প্রথম প্রকাশ: ২০২৩
মূল্য: ৮০০ টাকা
গারোরা মূলত ভোট-ব্রহ্ম কিরাতীয় বোড়ো ভাষাভাষী শাখার নিজস্ব গারো ভাষাতেই কথা বলে। আর এসব মানুষের ধর্মবিশ্বাস ছিল সর্বপ্রাণবাদী। গারোরা একে সাংসারেক ধর্ম নামে অভিহিত করে। যারা ধারণাকৃত অদৃশ্য শক্তি কিংবা দৃশ্যমান বিমূর্ত জড়বস্তুর দেব–দেবীর পূজা-অর্চনা করে আসছে এবং এসব দেব–দেবীর মূর্তি নেই। অর্থাৎ গারোরা আগে বা এখনো ব্রাহ্মণ্যবাদী আর্যদের মতো পৌত্তলিক নয়। তথাপি তাদের দারিদ্র্যের সুযোগে পশ্চিম থেকে আসা সাদা চামড়ার মিশনারিদের দ্বারা যৎসামান্য আর্থিক সুযোগ-সুবিধার জন্য অনেককে খ্রিষ্টধর্মে ধর্মান্তরিত হতে হয়েছে।
গারো ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর আদি ইতিহাস ও উৎস এবং এই ভূখণ্ডে তাদের অভিবাসন, ভাষা ও সংস্কৃতি; তথা তাদের নৃতাত্ত্বিক শারীরিক গঠন, আচার-আচরণ, উৎপাদনপদ্ধতি, সমাজকাঠামো, খাদ্য গ্রহণ, পালা-পার্বণ, পোশাক–পরিচ্ছদ, উৎসব-আনন্দ ও জীবনাচার সম্পূর্ণই ভিন্নতর, যা এ দেশের মূলস্রোত বাঙালি জনগোষ্ঠীর সঙ্গে মেলে না।
এই গ্রন্থে বাংলাদেশে বসবাসরত মঙ্গোলীয় জাতিগোষ্ঠী গারোদের শিকড় সন্ধান তথা তাদের নৃতাত্ত্বিক-সাংস্কৃতিক পরিচয়, জীবনধারা, ধর্ম, মূল্যবোধ ও মনোবৃত্তি, চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, খাদ্যাভ্যাস, পোশাক-পরিচ্ছদ, নৃত্য, সংগীত, উৎসব, অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া ইত্যাদি সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।
সাঁওতাল
প্রচ্ছদ: তারিক সুজাত
প্রথম প্রকাশ: ২০২৪
মূল্য: ৬৮০ টাকা
বাংলাদেশের সাঁওতালরা সমতল ভূমির অধিবাসী। তারা বাংলার প্রাচীন জনজাতি। উত্তরবঙ্গের সমতলে তাদের বসবাস। বাংলাদেশ ছাড়াও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, ঝাড়খন্ড, ছত্তিশগড়, ওডিশা ও ত্রিপুরা রাজ্যে সাঁওতালদের বসতি রয়েছে।
আদি অস্ট্রিকভাষী সাঁওতালরা অস্ট্রেলীয়-এশীয় জাতিগোষ্ঠীর মানব। যদিও তাদের আদি ও মূল ভাষা অস্ট্রিক, তা সত্ত্বেও এর উপভাষা দ্রারির শাখার মুণ্ডারী ভাষায় কথা বলে। এতকাল সাঁওতালদের ভাষার বর্ণমালা ছিল না। ভারতে সম্প্রতি তাদের বর্ণমালা সৃষ্টি করা হয়েছে।
ঐতিহাসিক সূত্র অনুযায়ী আদিমকালে সাঁওতালদের পূর্বসূরিরা অস্ট্রেলিয়া-ওশেনিয়া অঞ্চল থেকে সমুদ্রপথে ভারতবর্ষের দক্ষিণ উপকূলে প্রথম পদার্পণ ঘটায়। আর তা আর্যদের আগমনেরও অনেক অনেক আগে। আর এরাই ভারতবর্ষের এ অঞ্চলে সভ্যতার সূত্রপাত করে। কৃষি ও নগরসভ্যতা এই অস্ট্রিকভাষীদের দ্বারাই ভারতবর্ষে প্রথম ঘটে। হরপ্পা-সভ্যতা [খ্রিষ্টপূর্ব ২৪৫০-২৩০০] অস্ট্রিকভাষী আদি অস্ট্রেলীয়-এশীয় মানুষের দান।
রাজবংশী
প্রচ্ছদ: কনকচাঁপা চাকমার চিত্রকর্ম অবলম্বনে
প্রথম প্রকাশ: ২০২৩
মূল্য: ১০০০ টাকা
রাজবংশীরা ভারতের পূর্বাংশের আদিম ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী। গবেষকদের মতে, কোচ ও পালিয়া জাতিগোষ্ঠীর রক্ত সংমিশ্রণজাত সম্প্রদায় হচ্ছে রাজবংশী। যদিও রাজবংশীরা কাম্তাপুরী কিংবা আদি রংপুরী ভাষায় কথা বলে, তা সত্ত্বেও ভারত ও বাংলাদেশের রাজবংশীরা সবাই স্থানীয় বাংলা ভাষায় কথা বলে এবং বিশুদ্ধ বাংলায় পড়ালেখা করে।
রাজবংশীরা প্রাচীন গৌড়, আসামসহ এ অঞ্চলের অধিবাসী, তা সত্ত্বেও রাজবংশীদের উৎস ও উৎপত্তি সম্পর্কে নানা ধোঁয়াশা রয়েছে। যেটুকু জানা যায়, তা–ও পূর্ণাঙ্গ নয়।
বাংলাদেশ ও ভারতের সব ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী একসময় সর্বপ্রাণবাদী প্রকৃতিপূজারি ছিল, যা মূলত লোকজধর্ম নামে অভিহিত। রাজবংশী ও কোচরাও তা–ই ছিল।
প্রাচীনকাল থেকেই রাজবংশী সমাজ কৃষিভিত্তিক। কৃষিকাজই তাদের মূল পেশা। যদিও তাদের মধ্যে প্রান্তিক চাষি ও ভূমিহীনদের সংখ্যাই অধিক। আর এ কারণে ভূমিহীনদের কৃষিমজুর হিসেবেই দিনপাত করতে হয়। তাদের সাহিত্য ও সংস্কৃতি, বিশেষত তাদের লোকসংগীত খুবই সমৃদ্ধ ও জনপ্রিয়। এর মধ্যে ভাওয়াইয়া ও চটকা গান, যা তাদের বিশেষভাবে পরিচিত করেছে।
রাজবংশীরা বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গের জেলাগুলোয় বেশি বসবাস করে। যেমন রংপুর, নীলফামারী, লালমনিরহাট, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, জয়পুরহাট ও পাবনা। ঢাকা, ময়মনসিংহ, মানিকগঞ্জ, গাজীপুর, নড়াইল, ঝিনাইদহ, যশোর, মাগুরা, সাতক্ষীরা ও খুলনাও কিছু রাজবংশীর বসবাস রয়েছে। এ ছাড়া বিক্ষিপ্তভাবে রাজবংশী পরিবার দেশের বিভিন্ন স্থানে বসবাস করে।
লেখক: রেহেনা রহমান, সেন্ট্রাল রোড, ঢাকা
নাগরিক সংবাদে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]