আমাদের ১২২ বছর এগিয়ে দিলেন জুলহাস মোল্লা

জুলহাসের তৈরি বিমান ওড়ানো দেখতে সাধারণ মানুষের পাশাপাশি জেলা প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা হাজির হয়েছিলেন। মঙ্গলবার দুপুরে মানিকগঞ্জের শিবালয় উপজেলার জাফরগঞ্জ এলাকায় যমুনা নদীর চরেছবি: প্রথম আলো

জুলহাস মোল্লা নিজের উদ্ভাবনী প্রচেষ্টা দিয়ে বিমান উড়িয়েছেন আকাশে। এমন তো নয় যে জুলহাস মোল্লা নতুন কিছু উদ্ভাবন করে ফেলেছেন, এরপরও দেশে এটা নিয়ে এত আলোচনা হচ্ছে কেন? এর প্রধানতম কারণ বিশ্ব বিজ্ঞানসভায় আবিষ্কারের দিক দিয়ে আমাদের অবদান উল্লেখযোগ্য তেমন কিছু নেই। খুব অল্পতেই প্রবল খুশি হওয়ার প্রবণতাও আমাদের সহজাত।

১২২ বছর আগে বিশ্বে প্রথম বিমান উড়েছিল। সেটি আমেরিকায়। একেবারেই আনকোরা আবিষ্কার। সে সময় কোনো বই বা ইউটিউব থেকে কপি করার কোনো সুযোগ ছিল না। এরপরও ওই ১২২ বছর আগের ঘটনা আমাদের দেশজ কোনো বিজ্ঞানী এত দিন চেষ্টা করে দেখেননি। এমনকি দেশে যে এভিয়েশন সায়েন্স পড়ানো হয়, সেখানকার কোনো শিক্ষার্থী বা বিজ্ঞানীও যমুনার চরে গিয়ে নিজেদের বানানো বিমান উড়াতে পারেননি। এমন বাস্তবতায় অবশ্যই ব্যতিক্রম জুলহাস মোল্লা। যাঁর বিদ্যার দৌড় মাত্র মাধ্যমিক পাস। সেই তিনি ‘Aeronautical Engineering’ ব্যাপারটি ধরতে পেরেছেন—এটা বিরাট কিছু।

বিশ্বের প্রথম সফল মোটরচালিত ও নিয়ন্ত্রিত বিমান ১৯০৩ সালের ১৭ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের উত্তর ক্যারোলাইনার কিটি হক শহরে উড়েছিল। এটি আবিষ্কার করেন রাইট ব্রাদার্স—অরভিল রাইট ও উইলবার রাইট।

তাদের তৈরি বিমান ‘ফ্লায়ার ১’ (Wright Flyer) প্রথমবার আকাশে উড়ে ১২ সেকেন্ডে ৩৭ মিটার (১২০ ফুট) দূরত্ব অতিক্রম করেছিল। সেই ঐতিহাসিক দিনেই আরও কয়েকটি সফল উড্ডয়ন হয়, যার মধ্যে দীর্ঘতমটি ছিল ৫৯ সেকেন্ডে ২৬০ মিটার (৮৫২ ফুট)।

রাইট ব্রাদার্সের এই উদ্ভাবনই আধুনিক বিমানের ভিত্তি স্থাপন করে এবং তাঁদের কৃতিত্বের জন্য তারা ‘এভিয়েশনের জনক’ হিসেবে স্বীকৃত।

১২২ বছরের সময় পরিক্রমায় বাংলাদেশের বিমান বানানোয় কেউ সফলতা পাননি। এমন বাস্তবতায় নিজের তৈরি আরসি বিমানে আকাশে উড্ডয়ন করে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন মানিকগঞ্জের ষাইটঘর তেওতা এলাকার তরুণ উদ্ভাবক জুলহাস মোল্লা।

২০১৪ সালে জিয়নপুর উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করেন। তবে অর্থাভাবে পড়ালেখা আর চালিয়ে যেতে পারেননি। বর্তমানে ঢাকায় ইলেকট্রিক মিস্ত্রির কাজ করছেন ২৮ বছরের এই তরুণ।

তিন বছর ধরে তিনি বিমান বানিয়ে উড্ডয়নের চেষ্টা করে আসছিলেন। কিন্তু সফল হতে পারছিলেন না। তবে এবার সফল হয়েছেন। ৩ মার্চ যমুনার চরে তাঁর বিমানটি প্রায় ৫০ ফুট ওপরে উঠতে সক্ষম হয়। গত মঙ্গলবার সকাল ১০টার দিকে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে বিমানটি উড়ান। সে সময় মানিকগঞ্জের জেলা প্রশাসক মানোয়ার হোসেন মোল্লাসহ অনেকেই উপস্থিত ছিলেন।

তিন বছর গবেষণা এবং এক বছর সময় লেগেছে উড়োজাহাজটি তৈরি করতে। সব মিলিয়ে প্রায় আট লাখ টাকা খরচ হয়েছে। অ্যালুমিনিয়াম ও লোহা দিয়ে বিমানটির অবকাঠামো তৈরি করা হয়। পানির পাম্পের মাত্র ‘সেভেন হর্স পাওয়ারের’ ইঞ্জিন ব্যবহার করেছেন তিনি।

মানিকগঞ্জের জুলহাস যদি সত্যিই সেভেন হর্স পাওয়ারের (৭ HP) ইঞ্জিন দিয়ে বিমান উড়াতে পারেন, তাহলে এটি একটি ব্যতিক্রমী ঘটনা এবং নতুনত্ব হিসেবে ধরা যেতে পারে কয়েকটি কারণে—

স্বল্প ক্ষমতার ইঞ্জিনে বিমান চালনা—

সাধারণত বিমান উড্ডয়নের জন্য উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন ইঞ্জিন প্রয়োজন হয়। মাত্র ৭ HP ইঞ্জিন দিয়ে বিমান ওড়ানো অসম্ভবের কাছাকাছি। কারণ এটি সাধারণত ছোট নৌকা, বাইক বা কৃষি যন্ত্রপাতিতে ব্যবহৃত হয়। তাই এত কম শক্তির ইঞ্জিনে উড্ডয়ন করা হলে সেটি হয়তো প্রকৌশলগত বিস্ময় বলেই গণ্য হবে।

অসাধারণ অ্যারোডাইনামিক ডিজাইন—

বিমানটি সত্যিই উড়তে পেরেছে, তাহলে এটি প্রমাণ করে যে জুলহাসের নকশা অত্যন্ত দক্ষ, হালকা ওজনের এবং বায়ুগতির দিক থেকে নিখুঁত, যা সামান্য শক্তিতে বেশি লিফট তৈরি করতে পারে।

দেশীয় উদ্ভাবনের নজির—

বাংলাদেশে ব্যক্তি উদ্যোগে তৈরি বিমান সাধারণত শখের পর্যায়ে থাকে এবং সেগুলো সফলভাবে উড্ডয়ন করতে পারে না। যেহেতু জুলহাস এটি বাস্তবায়ন করে দেখিয়েছেন, তাহলে এটি প্রযুক্তিগত কৃতিত্বের দৃষ্টান্ত হবে।

বৈশ্বিক উদাহরণ কম—

বিশ্বে খুব কমসংখ্যক উদাহরণ পাওয়া যায় যেখানে এত কম ক্ষমতার ইঞ্জিনে কার্যকর বিমান চালানো সম্ভব হয়েছে। সাধারণত ছোট আলট্রালাইট এয়ারক্রাফটেও ২০-৫০ HP ইঞ্জিন ব্যবহৃত হয়। তবে সত্যিকারভাবে এটি কার্যকর হয়েছে কি না বা এটি কীভাবে সম্ভব হয়েছে—সেটি গবেষণা কেন্দ্রে যাচাই করা দরকার।

জুলহাস মোল্লার এই উদ্ভাবনী উদ্যোগ প্রশংসার দাবিদার। তিনি নিজস্ব গবেষণা এবং শ্রম দিয়ে একটি রেডিও কন্ট্রোলড (RC) উড়োজাহাজ তৈরি করেছেন, যা বাংলাদেশে স্বশিক্ষিত উদ্ভাবকদের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস হতে পারে।

চূড়ান্ত বিচারে আমরা বলতে পারি, আট লাখ টাকা ব্যয়ে এবং চার বছরের প্রচেষ্টায় তৈরি এই উড়োজাহাজের কাঠামো অ্যালুমিনিয়াম ও লোহা দিয়ে নির্মিত হয়েছে, যা কাঠামোগতভাবে মজবুত এবং বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলো সেভেন হর্স পাওয়ারের পানির পাম্প ইঞ্জিন, যা সাধারণত কৃষিকাজে ব্যবহৃত হয়, সেটি উড়োজাহাজের প্রোপালশন সিস্টেম হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। এটি স্থানীয়ভাবে সহজলভ্য উপাদান দিয়ে তৈরি বিমান প্রকৌশল ও উদ্ভাবনের একটি অনন্য উদাহরণও বটে।

তবে, এ ধরনের গবেষণা ও উদ্ভাবনকে আরও এগিয়ে নিতে প্রয়োজন যথাযথ কারিগরি সহায়তা, তহবিল এবং সরকারি বা বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যদি তাঁকে সহায়তা করে, তাহলে ভবিষ্যতে হয়তো আরও উন্নততর কিছু তৈরি করা সম্ভব হবে। যা হবে বাংলাদেশের ট্রেডমার্ক। অভিবাদন জুলহাস মোল্লা, এভিয়েশন সায়েন্সে আপনি আমাদেরকে ১২২ বছর এগিয়ে রাখলেন।

লেখক: সাংবাদিক