শিশুদের জন্য সহশিক্ষা কার্যক্রম জোরদার চাই, কারণ

ফাইল ছবি

সুনাগরিক হিসাবে গড়ে ওঠা এবং দৈহিক ও মনের সুস্থ বিকাশের জন্য সুস্থ থাকা আবশ্যক। শরীর সুস্থ থাকলেই মন সুস্থ থাকবে কারণ শরীরের সঙ্গে মনের সম্পর্ক সুনিবিড়। শিশুদের শরীর সুস্থ রাখার জন্য জন্য যেমন নানান ধরনের পথ্য, ঔষধ, ভেজালমুক্ত খাবারের প্রয়োজনীয়তা আবশ্যক তেমনি মনের সুস্থতা এবং উৎফুল্লতা বৃদ্ধির জন্য চাই সহশিক্ষা কার্যক্রম। বিখ্যাত উপন্যাসিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন ‘সব মানুষের মধ্যে একটি খোকা থাকে যে মনের কবিত্ব, মনের কল্পনা, মনের সৃষ্টিছাড়া অবাস্তবতা, মনের পাগলামিকে লইয়া সময়ে-অসময়ে এমনিভাবে খেলা করিতে ভালোবাসে।’

মন হচ্ছে দৈহিক এবং মানসিক সুস্থতার নিউক্লিয়াস। নিউক্লিয়াস যেমন কোষের যাবতীয় কার্যক্রমকে নিয়ন্ত্রণ করে ঠিক তদ্রুপ মনের কাজ মানুষের যাবতীয় প্রেম-ভালোবাসা, মমতাবোধ, হিংসাকে নিয়ন্ত্রণ করে। শিশুদের দেহের মতো তাদের মন বেশ কোমল। শিশুদের কোমল মনকে উৎসাহী করে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি, কাজের এবং চিন্তার দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য সহশিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। সহশিক্ষা হচ্ছে প্রথাগত পাঠ্য বইয়ের বাহিরের শিক্ষা।

যা তাদের সুনাগরিক হিসাবে গড়ে উঠা এবং দৈহিক এবং মানসিক সুস্থতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সহশিক্ষার কার্যক্রমের ভেতর হতে পারে খেলাধুলা, বির্তক প্রতিযোগিতা, আন্তস্কুল ফুটবল, জাতীয় দিবস পালন, স্কাউট, গার্লস গাইড, নাট্যানুষ্ঠান, বাগান তৈরি, শিক্ষা সফর, ক্রীড়ানুষ্ঠান, গানবাজনা, সামাজিক সংগঠন, গল্প প্রতিযোগিতা, দেয়ালিকা তৈরি, ভাস্কর্য তৈরি, অ্যালবাম তৈরি, ফটোগ্রাফি, ছবি আঁকা, কুইজ প্রতিযোগিতা, ক্যারিয়ার ক্লাব, বইপড়া ক্লাব, বিজ্ঞানচর্চা ক্লাব, রক্তদান কর্মসূচী এবং বইপড়া কর্মসূচী ইত্যাদি।

বলাবাহুল্য প্রথাগত শিক্ষায় পাঠ্য বই পড়ে শুধু জ্ঞান আহরণ করা যায় কিন্তু সুনাগরিক হয়ে ওঠা সম্ভব নয়। কারণ, সুনাগরিক হিসাবে গড়ে উঠার জন্য চিন্তা করার দক্ষতা, মনের বিকাশ, কথা বলার এবং যোগাযোগের দক্ষতা, প্রতিকূল পরিবেশ মোকাবিলার দক্ষতা থাকা চাই। আর এ সকল গুণাগুণ একমাত্র সহশিক্ষায় সম্ভব। বিতর্ক প্রতিযোগিতা, দেয়ালিকা, নানান ধরনের সংগঠনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে একজন শিশু চিন্তার দক্ষতা বৃদ্ধি, যুক্তি এবং সাবলীলভাবে কথা বলার দক্ষতা অর্জন করে। নাচ-গান, কবিতা আবৃত্তি, বইপড়া ছবি আঁকা প্রভৃতির মাধ্যমে একজন শিশুর ভেতর সুকুমারবৃত্তি জেগে উঠে এবং কোমলমনের ভেতর জেগে ওঠে প্রেমবোধ, মমতাবোধ। বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি, রক্তদান প্রভৃতি অংশগ্রহণের মাধ্যমে একজন শিশুর উদার হয়ে ওঠে। খেলাধুলায় অংশগ্রহণের মাধ্যমে একজন শিশু নেতৃত্বের এবং শৃঙ্খলাবোধের গুণাবলি অর্জন করে। সুতরাং শিশুদের মানসিক বিকাশ এবং সুস্থতার জন্য সহশিক্ষার গুরুত্ব অনস্বীকার্য।

বিশেষজ্ঞদের মতে, পৃথিবীতে সুস্থভাবে বেঁচে থাকা এবং মনের সজীবতার জন্য খেলাধুলা করা প্রয়োজন। কারণ, শারীরিক সুস্থতা, মানসিক প্রশান্তি, শৃঙ্খলাবোধ এবং সুঠাম দেহগঠন প্রভৃতির জন্য খেলাধুলা করা আবশ্যক। এ ছাড়াও উন্মুক্ত মাঠে খেলাধুলায় অংশগ্রহণের মাধ্যমে শিশুদের দেহে রক্ত চলাচল বৃদ্ধি, অঙ্গের সঠিক বিকাশ এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। তবে দেশে অপরিকল্পিত নগরায়ণ কারণে খেলাধুলার মাঠ সংকীর্ণ হয়ে উঠেছে। ফলে শিশুদের উন্মুক্ত মাঠে খেলাধুলা অনেকটা বন্ধ প্রায়।

জাতীয় শিশুশ্রম জরিপ ২০২২–এর ফলাফলে দেখে গেছে দেশে ৫-১৭ বছর বয়সী শিশুর সংখ্যা প্রায় ৪ কোটি। দুর্ভাগ্য, বর্তমানে অধিকাংশ শিশুদের মধ্যে সহশিক্ষার প্রতি অনাগ্রহ লক্ষ করা যায়। প্রযুক্তির ছোঁয়ায় শিশুদের সহশিক্ষা কার্যক্রম অনেকটা অধরাই হয়ে যাচ্ছে। প্রযুক্তির কল্যাণে মানুষের সময় উপভোগ্য করার জন্য আবিষ্কার হয়েছে নানান ধরনের অনলাইন গেমস। যেমন পাপজি, ফ্রি-ফায়ার, মোটরগাড়ি, টেম্পলরান, ফায়ার বার্ড প্রভৃতি। বর্তমানে এ সকল গেমস শিশুদের জন্য সহশিক্ষার কার্যক্রমের বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। যে সময়ে শিশুদের প্রকৃতির সংস্পর্শে খেলাধুলা করার কথা ঠিক এ সময় অধিকাংশ শিশুরা মোবাইল গেমস খেলে সময় অতিবাহিত করছে। ফলে তাদের মধ্যে দেখা দিচ্ছে একঘেয়েমি এবং মানসিক ক্লান্তি। যা মস্তিষ্কের উপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে। দীর্ঘ সময় অনলাইনে গেমস খেলার কারণে বাস্তব জীবন থেকে বিচ্যুত হচ্ছে এবং বিভিন্ন সময়ে নানান ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিতের মতো ঘটনা ঘটছে।

বিজ্ঞানীদের মতে, মোবাইল গেমস খেলার ফলে অল্প বয়সে চোখের সমস্যায় ভোগা, চোখ দিয়ে জল পড়া, মাথাব্যথা, ঝাপসা দেখা, স্মৃতিশক্তি ও বিচক্ষণতা হ্রাস এবং সৃজনশীলতার হ্রাস ঘটেছে। চলতি বছর দেশে শিশুদের ওপর এক পরিচালিত গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের প্রায় ৮৬ শতাংশ প্রি-স্কুল শিশু মোবাইল গেমসে আসক্ত। যাদের মধ্যে ২৯ শতাংশ শিশু মারাত্মকভাবে আসক্ত। দিন দিন আসক্ত হওয়ার সংখ্যা বাড়ছে। দীর্ঘমেয়াদী যার প্রভাব ভয়ংকর। সুতরাং এখনই পদক্ষেপ না নিলে ভবিষ্যতে সোনার বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন অধরাই থেকে যাবে। শিশুরা যে শুধু অনলাইন গেমস খে‌লে বিপথগামী হচ্ছ ঠিক এই রকমটা নয়। ইন্টার‌নে‌টের যু‌গে সব‌কিছু আজ সহজলভ্য এবং হা‌তের মু‌ঠোয়। ফলে শিশুরাই সহ‌জেই অনলাইন জুয়া এবং ক্ষ‌তিকর মান‌বিক বিপর্যয়কর ওয়েবসাইট যেমন পর্নগ্রাফি, সন্ত্রাসী সংগঠ‌নের পেই‌জে ব্রাউজ কর‌ছে। যা শিশু‌দের ভেতর সুকুমারবৃ‌ত্তি এবং সৃজনশীল প্রতিভা‌কে নষ্ট কর‌ছে। নিঃসন্দে‌হে প্রভাব ভয়ংকর। অনলাই‌নে জুয়ায় আসক্ত হওয়ার কার‌ণে এক‌দি‌কে যেমন তা‌দের প‌রিবার আর্থিকভা‌বে ক্ষতিগ্রস্ত হ‌চ্ছে অন্যদিকে তা‌দের ম‌নোভাব এবং দৃ‌ষ্টিভ‌ঙ্গির প‌রিবর্তন ঘট‌ছে। তা‌দের খাম‌খেয়া‌লি ম‌নোভাব সমা‌জের ভেতর নানান ধর‌নের অপ্রী‌তিকর অবস্থার জন্ম দি‌চ্ছে। যা শান্তিপ্রিয় লোকজনের নিকট বির‌ক্তের কারণ হ‌য়ে দাঁ‌ড়ি‌য়ে‌ছে।

অনলাইনে আসক্ত হওয়ার অন্যতম কারণ একাকীত্ব, পা‌রিবা‌রিক কলহ ও ভাঙন। আবার শিশু কি‌শোররা ফেসবু‌কে নানান ধর‌নের গ্রুপ যেমন বাবা‌জি, ঢাকার মাস্তান, একাই এক‌ শ, ফাটায় দে প্রভৃ‌তি হাস্যকর নাম‌ গ্যাং তৈরি কর‌ছে। যা সমা‌জে কি‌শোর গ্যাং না‌মে প‌রি‌চিত। বি‌ভিন্ন গ‌বেষণায় দেখা গে‌ছে কি‌শোর গ্যাং যে সকল সদস্য বিরাজমান বে‌শির ভাগই মাদকাসক্ত। ফলে তারা মাদ‌কের টাকা জোগাড় করার জন্য শহ‌রের অলিগ‌লি‌তে ছিনতাই, ডাকা‌তি, খুন, চু‌রি এবং চাঁদাবা‌জির ম‌তো কাজ কর‌ছে। যা সমা‌জের শা‌ন্তিপ্রিয় মানুষজ‌নের ভেতর ভ‌য়ের জন্ম দিচ্ছে।

চল‌তি বছর আঁচল ফাউ‌ন্ডেশ‌নের তথ্যানুসারে জানুয়ারি থে‌কে মে পযন্ত ১৮৮ জ‌নের ম‌তো আত্মহত্যা করেছে। যার মধ্যে অধিকাংশই তরুণ নারী। যা নিঃস‌ন্দে‌হে হৃদয়‌বিদায়ক। সুতরাং শিশু-কিশোরদেও অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা বন্ধে এখনই উচ্চতর গবেষণা করা জরুরি। তা না হলে তরুণদের দ্বারা বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন অনেকটাই অধরাই থেকে যাবে। এই জন্য সহশিক্ষায় শিশু-কিশোরদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধির জন্য নানান ধরনের পদক্ষেপ নিতে হবে। যেমন—

১. শিশু-কিশোরদের নানান ধরনের প্রতিযোগীতায় অংশগ্রহণে উৎসাহী এবং পুরস্কৃত করতে হবে
২. বিদ্যালয়গুলোতে সহশিক্ষায় নানান ধরনের সংগঠন তৈরিতে উৎসাহী করতে হবে এবং প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম সরবরাহ করতে হবে
৩. সহশিক্ষা কার্যক্রম বৃদ্ধির জন্য জনসচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে
৪. জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন পর্যায়ে নানান ধরনের খেলাধুলা এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে হবে
৫. পাঠ্য বইয়ে সহশিক্ষার গুরুত্ব অন্তর্ভুক্ত এবং তা কার্যকর করতে হবে
৬. শিশুদের অনলাইন গেমস খেলা থেকে দূরে রাখতে পরিবারের লোকদের সর্তক থাকতে হবে এবং সন্তানদের বেশি বেশি সময় দিতে হবে
৭. সন্তানেরা কী ধরনের গেমস খেলে, কাদের সঙ্গে মেশে সে দিকে নজর দিতে হবে
৮. শহরে অপরিকল্পিত নগরায়ণ বন্ধ করে উন্মুক্ত খেলার মাঠের ব্যবস্থা করতে হবে
৯. অল্প বয়সের শিশুদেরকে স্মার্ট মোবাইলের সংস্পর্শে থেকে দূরে রাখতে হবে
১০. বিশেষজ্ঞদের শিশুদের সহশিক্ষা কার্যক্রম নিয়ে উচ্চতর গবেষণা করতে হবে।
 

  • লেখক: মো. রিয়াজ হোসাইন, শিক্ষার্থী, বাংলাদশে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় , ময়মনসিংহ

  • নাগরিক সংবাদে ছবি, লেখা ও ভিডিও পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]