জীবনে অনেক কিছু শিখেছি, এখনো শিখছি

বাংলাদেশসহ বিশ্বের শতাধিক দেশে ৫ অক্টোবর বিশ্ব শিক্ষক দিবস পালিত হচ্ছে। জ্ঞানের ফেরিওয়ালাদের নিয়ে লেখা প্রকাশ হচ্ছে ‘নাগরিক সংবাদ’-এ।

শিক্ষকের গুরুত্ব আমার জীবনে এমন, যা আমি লিখতে লিখতে যদি বইও হয়ে যায়, তা-ও মনের মতো করে শেষ করতে পারব বলে আমি মনে করি না। একজন শিশু জন্মের পর ধীরে ধীরে সব শেখে। তার পৃথিবীতে ভালোভাবে টিকে থাকা নির্ভর করে অর্জিত শিক্ষার ওপর। আজকের শিক্ষা তার ভবিষ্যতের সঞ্চয়। সেই সঞ্চয় তৈরি করে দিচ্ছেন একজন শিক্ষক। আমার জীবনে শিক্ষকের ভূমিকা একটু বেশিই।

শিক্ষাজীবনের শুরু থেকে, অর্থাৎ সেই প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত অসাধারণ অনেক ভালো শিক্ষকের ছাত্র হতে পেরেছি। কিন্তু যদি সবচেয়ে প্রিয় শিক্ষক সম্পর্কে বলতে হয়, তাহলে একজন শিক্ষকের কথাই বলব। যিনি আমার ক্ষুদ্র জীবনের চলার পথে সবচেয়ে বেশি প্রেরণা ও উৎসাহ জুগিয়েছেন। আমার সেই প্রিয় শিক্ষকের নাম মাহমুদুল হাসান।

স্যার যে শুধু শিক্ষা দেন তা নয়, তাঁর অনুপ্রেরণাও আমাদের জীবনের জন‍্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। আমার এখনো মনে আছে, আমি যখন বক্তব্য, কেরাত দেওয়া থেকে পালিয়ে বেড়াতাম, তখনই আমাকে বলেছিলেন, ‘তোমার কাছে আমি একটা জিনিস চাই, সেটা হলো, তুমি কাল স্টেজে উঠে শুধু সালামটুকু দেবে। এটাই তোমার কাছে আমার চাওয়া।’ জীবনে কোনো দিন বক্তব্য দিইনি। সেখানে এমন কথা শুনে আমি রীতিমতো অবাক হয়ে গেছি।

একজন শিক্ষক তার ছাত্রকে কতটা ভালোবাসলে এভাবে বলতে পারেন, তা তখনই আমি কিছুটা বুঝতে পেরেছিলাম। তাই তাঁর ইচ্ছাকে বাস্তবে পরিণত করার জন‍্য নিজের ঘুমটাও বিসর্জন দিতে এতটুকু কষ্ট হয়নি। সারা রাত বিভিন্ন বইপুস্তক গবেষণা শুরু করি, পরদিন আমাকে বক্তব্য দিতেই হবে। তাই সহজ-সরল একটা বিষয় নির্বাচন করি, সেটা হলো, শিক্ষকের মর্যাদা। আমার নাম ঘোষণা করা হলো। কাঁপছি আর ভাবছি। স্টেজে উঠতে উঠতে শিক্ষকের দিকে তাকালাম, তারপরও স্টেজে দাঁড়িয়ে সবার উদ্দেশে সালাম দিলাম। বললাম, আজকে যে বিষয়ের ওপর আলোচনা করব, সেটা হলো শিক্ষকের মর্যাদা।

সঠিক শিক্ষা দানের মাধ্যমে শিক্ষকেরা মানুষের ভেতর সত্যিকারের মানুষ সৃজন করেন। তাই শিক্ষককে বলা হয় সন্তানের দ্বিতীয় জন্মদাতা। সত্যি তো, জন্মদাতা পিতা শুধু জন্মই দিয়ে থাকেন; কিন্তু তাকে সত্যিকার মানুষরূপে গড়ে তোলেন একজন শিক্ষক। জ্ঞান বা বিদ্যার্জনের জন্য শিক্ষকদের ভূমিকাকে দ্বিতীয় জন্মদাতার সঙ্গে তুলনা করে শাহ মুহম্মদ সগীর কবিতার ছন্দে লিখেছেন,

‘ওস্তাদে প্রণাম করো পিতা হন্তে বাড়,

দোসর জনম দিলা তিঁহ সে আহ্মার।’

শিক্ষকের মর্যাদা নামে কবি কাজী কাদের নেওয়াজের কবিতা পড়েছি ছেলেবেলায়। শিক্ষকের প্রতি বাদশাহর অপরিসীম শ্রদ্ধার প্রতিফলন ঘটেছে এই কবিতায়।
আমার শিক্ষক ছিলেন ভীষণ স্বপ্নবান। ছাত্রদের নিয়ে ছিল তার ছিল অজস্র স্বপ্ন। তার ছাত্ররা কেউ ভালো করেছে কিংবা খারাপ করছে, এই খবর শুনলে তিনি শ্রেণিকক্ষে বলতেন এবং অন্যদেরও এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা দিতেন। প্রতি মুহূর্তেই বলতেন, ‘আর যা-ই কর, পড়ার সময় পড়বে। বাকি দিন যা ইচ্ছা কর, সমস্যা নেই। পড়তে বসে ফাঁকি দেবে না। নিজের ওপর আত্মবিশ্বাস রাখবে। ও পেরেছে, আমি কেন পারব না। মানুষের পক্ষে সব সম্ভব, কেবল চেষ্টা থাকা চাই। চেষ্টা কর, দেখবে পারবে।’

কেউ হয়তো দুর্বল ছাত্র, কিন্তু তার অনুপ্রেরণা আর উদ্দীপনায় নিজেকে নতুন করে খুঁজে নিত। হুজুর প্রায়ই বলতেন, ‘দেখ, তোমাদের মধ্যে কেউ হয়তো একসময় বড় আলেম হবে, কেউ বিসিএস ক্যাডার, কেউ ইসলামি শিক্ষাবিদ, কেউ ভালো লেখক হবে বা শিক্ষক হবে; কিন্তু সবার আগে ভালো মানুষ হও। মানুষের জন্য কাজ কর।’ এই যে উদ্দীপ্ত করা, স্বপ্ন দেখতে শেখানো, নিজের ওপর আত্মবিশ্বাস রাখা একজন আদর্শ শিক্ষকের পরিচয় ছিল এটি।

আসলে জীবন গঠন হবে আমাদের, কিন্তু সবচেয়ে বেশি হয়তো আমাদের শিক্ষকেরাই খুশি হবেন। শিক্ষক শব্দটির ওজন এতটাই বেশি, যাকে খুব সহজে ব্যাখ্যা করে শেষ করা যাবে না।

আমি তো একজনের কথা বললাম, কিন্তু এমনও কিছু শিক্ষক আমার জীবনে আলোর সারথি হয়ে বারবার এসেছেন, যাঁদের অবদান বলে শেষ করা যাবে না। তাই আজ ৫ অক্টোবর শিক্ষক দিবস উপলক্ষে আমার জীবনে অগ্রণী ভূমিকা রাখা সব শিক্ষককে জানাই শিক্ষক দিবসের অসংখ্য শুভেচ্ছা। যাঁদের কাছ থেকে আমি জীবনে অনেক কিছু শিখতে পেরেছি এবং এখনো শিখে যাচ্ছি। আর এ জন্য আমি সারা জীবন কৃতজ্ঞ থাকব।

  • লেখা: মোহাম্মদ এনামুল হক, শিক্ষার্থী, জামেয়া আহমদিয়া সুন্নীয়া আলিয়া মাদ্রাসা, চট্টগ্রাম

  • লিখতে পারবেন আপনিও। লেখার শিরোনামের ওপর ‘শিক্ষক দিবসের লেখা’ শব্দটি লিখবেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা [email protected]