বাতিঘর মান্নান স্যার

বাংলাদেশসহ বিশ্বের শতাধিক দেশে ৫ অক্টোবর বিশ্ব শিক্ষক দিবস উদ্‌যাপিত হচ্ছে। জ্ঞানের ফেরিওয়ালাদের নিয়ে লেখা প্রকাশ হচ্ছে ‘নাগরিক সংবাদ’-এ।

মান্নান স্যার
ছবি: সংগৃহীত

আমাদের বাতিঘর শ্রদ্ধেয় শিক্ষাগুরু মান্নান স্যার শতবর্ষী বোরহানউদ্দিন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের (বর্তমান বোরহানউদ্দিন সরকারি উচ্চবিদ্যালয়) সর্বকালের সেরা প্রধান শিক্ষক। ৯৫ বছর বয়স চলছে। নামাজ আর কোরআন তিলাওয়াতের মধ্যে দিন কাটছে তাঁর। জীর্ণশীর্ণ শরীর নিয়ে এখনো জামাতের সঙ্গে নামাজ না পড়তে পারলে মন খারাপ হয়। কোনো স্বীকৃতির পেছনে দৌড়াননি; বরং স্বীকৃতি তাঁকে খুঁজে নিয়েছে। জেলা ছাড়িয়ে অসংখ্যবার যশোর বোর্ডের (তখন বরিশাল বোর্ড ছিল না) সেরা প্রধান শিক্ষক নির্বাচিত হয়েছেন। সর্বশেষ ১৯৯২ সালে জাতীয় পর্যায়ে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার হাত থেকে খুলনা বিভাগের শ্রেষ্ঠ প্রধান শিক্ষক হিসেবে স্বর্ণপদক ও ১০ হাজার টাকার চেক গ্রহণ করেন তিনি।

মুক্তিযুদ্ধেও ছিল স্যারের অসামান্য ভূমিকা। ১৯৭০ সালের বন্যার পর পাকিস্তানি সেনাসদস্যরা ত্রাণ দেওয়ার জন্য স্কুলে ক্যাম্প করে। ওই সময় সেনারা স্কুলের হাইবেঞ্চ পুড়িয়ে রান্নার কাজ করে। স্কুলের শিক্ষার্থীরা দেখে প্রতিবাদ করে। স্যারকে পাকিস্তানি সেনারা ওই ছাত্রদের টিসি দিয়ে স্কুল থেকে বের করে দিতে বলেন। স্যার অপারগতা প্রকাশ করলে সেনারা স্যারসহ ইংরেজি শিক্ষক প্রয়াত মোফাজ্জল হোসেন ও ছাত্রদের নামে থানায় মামলা করে। এর মধ্যে চলে আসে মুক্তিযুদ্ধ। স্যার স্কুলের ছাত্রদের মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার জন্য উদ্ধুদ্ধ করেন। স্কুলের বোর্ডিংয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করেন। সহযোগিতার জন্য মুক্তিযোদ্ধারা তাঁকে সব সময় কাছে পেয়েছেন।

মান্নান স্যার ১৯৫৪ সালে বোরহানউদ্দিন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সহকারী প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। দুই বছর পর ১৯৫৬ সাল থেকে ১৯৯৩ সালের জুন পর্যন্ত টানা ৩৭ বছর প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর সময়কালে আমার জানামতে উর্দু স্যার (প্রয়াত মজিবুল হক স্যার) ব্যতীত সব শিক্ষকই তাঁর ছাত্র ছিলেন। আবার কেউ কেউ ছিলেন তাঁর ছাত্রেরও ছাত্র। স্যার যখন স্কুলের বারান্দায় দাঁড়াতেন, স্কুল বন্ধ কি খোলা বলা মুশকিল ছিল। মাঠ দূরে থাক, স্কুলের বরান্দায়ও সুনসান নীরবতা। শিক্ষক-শিক্ষার্থী শ্রেণিকক্ষে।

স্যারকে বলা হয় ইংরেজির ‘জাহাজ’। কিন্তু এমন কোনো বিষয় নেই যাতে তাঁর পাণ্ডিত্য নেই। কী গণিত, কী বিজ্ঞান, কী ভূগোল—সব তাঁর কাছে সহজ সমাধান। অনেক সময় দেখেছি, অন্যান্য বিষয়ের স্যারেরাও দ্বিধায় পড়লে স্যারের দ্বারস্থ হতেন।

একটি মজার ঘটনা মনে পড়ছে। চার-সাড়ে চার ফুটের দেয়ালপত্রিকার জন্য আর্ট পেপার, রংপেনসিল, কলমসহ যাবতীয় খরচের ভাউচার দিতে বললেন শ্রদ্ধেয় মান্নান স্যার। আমিসহ আমার সহসম্পাদক বন্ধু আকবর সর্বসাকল্যে ৮২ টাকা খরচের ভাউচার দিলাম।

মান্নান স্যার
ছবি: সংগৃহীত

স্যার ভাউচারে চোখ বুলিয়ে হুংকার দিয়ে বললেন, তিন দিনে শেষ করতে পারবি। কাঁপুনিসহ বললাম, জি স্যার। স্যার ভাউচারের কপিটা ছুড়ে দিয়ে বললেন, গাধা এটা ঠিক করে আন।

গর্দভকণ্ঠে বললাম, স্যার কি ভুল! স্যার বললেন, আরে গাধা তিন দিন ধরে স্কুলে বসে কিছু না খেয়েই কাজ করবি, স্যারের জিজ্ঞাসা। শেষমেশ ১০৮ টাকার ভাউচার দিলেও স্যার বললেন, এত কমে হয়ে গেলে তো ভালোই!

দশম শ্রেণিতে পড়ার সময় একদিন সাইকেলে চড়ে মানিকার হাঁটের দিকে যাচ্ছি। সাইকেল চালাচ্ছে বন্ধু আকবর। পরনে লুঙ্গি। হেলিপ্যাডের কাছে দূর থেকে দেখি, রিকশায় চড়ে স্যার বিপরীত দিকে আসছেন। আমি বললাম, আকবর টাইগার আসছে! ‘কই’ বলেই আকবর সামনে তাকিয়েই ঝপাৎ করে নামতে গিয়ে সাইকেলে লুঙ্গি আটকিয়ে রাস্তায়। স্যার রিকশা থামিয়ে নামলেন। আমাদের তো মাথা আর উঁচু হয় না। স্যার হুংকার দিয়ে বললেন, সম্মান দেখাতে গিয়ে হাড়গোড় ভাঙলে হবে? আমাকে দেখলে আর এভাবে নামাবি না।

১৭ এপ্রিল ২০২৩ সোমবার। মডেল মসজিদ আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে স্যার এসেছিলেন। এক জনমে স্কুলের কাছে যেমন নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন; তেমনি তাঁর আরেক সত্তা ছিল সাবেক হাইস্কুল মসজিদ বা মারকাজ মসজিদ বা ঈদগাহ মসজিদ। অন্যান্য দিনের চেয়ে তাঁর সরব উপস্থিতি ছাড়িয়ে যেত বৃহস্পতিবারের ‘জোড়’ আর শবগুজারির দিন। মসজিদভর্তি মুসল্লি। স্যার বয়ান করছেন। পিনপতন নিস্তব্ধতায় মুসল্লিরা শুনছেন। আবার কখনো অন্য কেউ বয়ান করছেন। সকালে মুসল্লিদের জামাতবদ্ধ করে পাঠিয়ে দিতেন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে।

প্রকৃত অর্থে শিক্ষক বলতে যা বোঝায়, স্যার তেমনই একজন মানুষ। ব্যক্তি পরিচয় ছাপিয়ে নিজেই একটা প্রতিষ্ঠানে রূপ নেন। কিন্তু কখনো তাঁর এমন অভিব্যক্তি প্রকাশ পায়নি। স্যার অবসরে গেছেন ৩০ বছর হলো। যদি ভয়ের বিষয় হয়, তাহলে স্যার এখনো পাশ দিয়ে রিকশা চড়ে অথবা হেঁটে গেলে বুকের ভেতরে কে যেন হাতুড়ি পেটায়! সবই শ্রদ্ধাবোধ ও ভালোবাসার অদ্ভুত রসায়ন। এটাকে ভাষা দিয়ে বর্ণনা করা খুব কঠিন; কিন্তু এর অস্তিত্ব আকাশ ছাড়িয়ে।

লেখক: মোবাশ্বির হাসান শিপন, লেখক: শিক্ষক, সংগঠক

**লিখতে পারবেন আপনিও। লেখার শিরোনামের ওপর ‘শিক্ষক দিবসের লেখা’ শব্দটি লিখবেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা [email protected]