এবারের পাঠ্যপুস্তক উৎসব জমে উঠুক
আমাদের দেশে বছর শুরু হয় খুব মহৎ একটা উৎসবের মধ্য দিয়ে। বছরের প্রথম দিন শিশু থেকে নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেওয়া হয় নতুন বই। লাখো শিক্ষার্থীর হাতে নতুন বই তুলে দেওয়ার মতো মহান দায়িত্ব পালন করে বেশ সুনাম কুড়িয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। নতুন বইয়ের গন্ধটা একটু ভিন্ন, আমেজটাও একটু আলাদা। নতুন বই বিতরণ কেন্দ্র করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে উৎসবমুখর পরিবেশ তৈরি হয়। শীতের পরশমাখা স্নিগ্ধ সকালে হাতে পাওয়া নতুন বইয়ের গন্ধ শুঁকে এসব শিশু-কিশোর যেন আকাশে পাখনা মেলে। মুক্ত বিহঙ্গের মতো নীল আকাশে উড়তে চায় ডানা মেলে। গত বছর নতুন বই পাওয়ার আনন্দে উল্লসিত শিশুদের হৃদয়কাড়া ছবি আমরা দেখেছি। তাদের চোখেমুখে ছিল হৃদয়কাড়া উচ্ছ্বাস। এই উচ্ছ্বাস যেন সারা বছর থাকে। এই উৎসব বড় আনন্দের উৎসব।
আজকাল প্রতিবেশীর দরজায় কান পাতলেই একটা কথা খুব শোনা যায়, ‘আমার বাচ্চাটা মোবাইল ছাড়া কিচ্ছু বোঝে না।’ আরও একটু বাড়িয়ে যদি বলি, ‘কার্টুন না দেখে আমার বাচ্চাটা থাকতেই পারে না, খেলতে চায় না, কারও সঙ্গে মেশে না।’ এমনিভাবে সদা ব্যস্ত জীবনে জড়িয়ে থাকা মা-বাবার সন্তান নিয়ে গল্পের প্রায় বড় একটা অংশজুড়ে থাকে প্রযুক্তির প্রতি আসক্তির কথা। কখনো আক্ষেপ-হাহাকার, আবার কখনো ঔদ্ধত্য-অহমিকা ঝরে পড়ে সে আলাপে, গল্পে। কিন্তু এভাবে একটু একটু করে প্রতিদিন আমরা সন্তানদের মনোজগতের বিকাশের পথকে রুদ্ধ করে দিচ্ছি। তার কারণ খোঁজা এখনই প্রয়োজন মনে করছি।
লীলা মজুমদার লিখেছেন, ‘নতুন বইতে নাক ডুবিয়ে যে ছোট ছেলেমেয়ে পাঁচ মিনিট তার গন্ধ উপভোগ করেনি, সে বড় হতভাগা।’ পরীক্ষা পাসের মুহুর্মুহু চাপে ক্লিষ্ট যে জীবন ‘আউট বই’ ছুঁতে পারে না, তাকে তো হতভাগ্য বলতেই হয়। বোকাবাক্সের সামনে কাটানো রিক্ত-নিরানন্দ, আবেগ-উচ্ছ্বাসহীন শৈশব ভবিষ্যতের কেমন বড় মানুষ উপহার দিতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়। এ আসক্ত প্রজন্মকে বাঁচানোর জন্য আমাদের বিপ্লবই করতে হবে (সমাজের আমূল পরিবর্তন করতে সপ্তদশ শতক থেকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বিপ্লবের ইতিহাস আমরা পাঠ্যপুস্তকে পড়েছি)।
চিন্তা করছি একটি বিপ্লবের। যদি বিপ্লবটা হতো আমাদের দেশে, বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলাদেশে ‘পাঠবিপ্লব’। যে বিপ্লবে দেখা যেত কাজী নজরুল ইসলাম, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জীবনানন্দ দাশ, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক ও চণ্ডীদাসকে সরাসরি। শোনা যেত—অ, আ—চিৎকার সব আর্য ও শ্লোকের চেয়ে পবিত্র অজর স্লোগান। বিপ্লবটি ছড়িয়ে পড়ুক স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে। এই মাসে সব ছাত্রছাত্রী অথবা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের হোক এই প্রতিজ্ঞা। পাঠ করার প্রতিজ্ঞা।
যাকে আমরা বলি ‘পাঠবিপ্লব’। বিপ্লবে বিপ্লবে আলোকিত হোক পুরো জাতি। যে জাতির জন্য অপেক্ষমাণ এ বিশ্ব।
আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পাঠের প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন। এই জন্য বলি, বইয়ের কাছে যেতে হবে বারবার। বই হচ্ছে জ্ঞানের বাহক। বই ছাড়া জ্ঞান অর্জন সম্ভব নয়। তাই আমাদের বেশি বেশি বই পড়তে হবে। যখন লেখা ছাপার অক্ষরে, বই আকারে প্রকাশিত হয়নি, তখনো জ্ঞানপিপাসু মানুষ জ্ঞানার্জনের জন্য এক দেশ থেকে আর এক দেশে ছুটে বেরিয়েছেন, অর্থ ব্যয় করে জ্ঞানী মানুষদের একসঙ্গে জড়ো করে একেকটি বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তুলেছেন। এখন আর সে প্রয়োজন নেই। মানুষ তার লব্ধ জ্ঞান যুগ যুগ ধরে কাজে লাগিয়ে গড়ে তুলেছে বিপুল জ্ঞানের আধার গ্রন্থাগার। তবে মানুষ যেমন খাবারের জন্য বেঁচে থাকে না, বেঁচে থাকার জন্যই খায়, তেমনি মানুষ বই পড়ার জন্য বেঁচে থাকে না, বেঁচে থাকার জন্য বই পড়ে। কাজেই বেশি করে বই পড়তে হবে।
প্রিয় লেখক সৈয়দ মুজতবা আলীর লেখায় ওমর খৈয়ামের কথা জেনেছি। তিনি বলেছিলেন:
Here with a loaf of bread
beneath the bough.
A flash of wine, a book of
verse and thou,
Beside me singing in the wilderness
And wilderness is paradise enow.
‘রুটি মদ ফুরিয়ে যাবে, প্রিয়ার কালো চোখ ঘোলাটে হয়ে আসবে, কিন্তু বইখানা অনন্ত-যৌবনা—যদি তেমন বই হয়।’
সুতরাং বইয়ের কাছে যেতে হবে আমাদের। চলুন, উপহার হিসেবে বই বেছে নিই। বই উপহার দিই।
একবার অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, মানুষের চেতনাজগতে নাড়া বা হৃদয়সম্পন্ন মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার কাজটা করছেন কীভাবে? শুধু বই পড়িয়ে? তিনি বলেছিলেন, হ্যাঁ। বইয়ের দিকে আমাদের এত যেতে হলো কেন? আমাদের সমাজ অনেক পিছিয়ে গেছে। আমাদের ছোটবেলা যদি জিজ্ঞেস করা হতো, তুমি কার মতো হবে? তখন নাম আসত বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের। আজ আমরা চোখের সামনে কাকে উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরব? কার নাম বলব? শিক্ষকদের দেখে ছাত্রছাত্রীরা অনুপ্রাণিত হবে, বড় স্বপ্নে উদ্দীপ্ত হবে। আজকে শিক্ষকদের কাছ থেকে ছাত্রছাত্রীরা তো সেটা পাচ্ছে না। অথচ মনে রাখতে হবে, জৈবিকভাবে যেমন, আত্মিকভাবেও তেমনি, মানুষ মানুষের কাছ থেকেই জন্মায়। এখন আমাদের নতুন প্রজন্ম আগের যে মানুষের কাছ থেকে জন্মাবে, সেই মানুষ তো নেই। তাই আমাদের চলে যেতে হলো বইয়ের কাছে।
বেশ আগে খবরের কাগজে দেখেছিলাম, ভেনেজুয়েলার বামপন্থী রাষ্ট্রনায়ক হুগো চাভেজ তাঁর দেশে ‘পাঠবিপ্লব’ শুরু করেছিলেন। এর অংশ হিসেবে তিনি মার্কিন সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাকে একটি বাম বিপ্লবাত্মক বইও উপহার দিয়ে বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন। বারাক ওবামাকে তিনি যে বইটি উপহার দিয়েছেন তা এডুয়ার্ড গ্যালিয়ানোর একটি বিখ্যাত বাম বিপ্লব ক্ল্যাসিক বই। হুগো চাভেজ বেশ আগে রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে সরাসরি প্রচারিত এক ভাষণে তাঁর দেশের জনগণকে পাঠে উদ্বুদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। তিনি তাঁর বিপ্লবে, ভাষণে নির্দিষ্ট করে একটি স্লোগান জনগণের সামনে তুলে ধরেছিলেন। তা হলো ‘পাঠ’ এবং ‘পাঠ’।
এত দিন বিশ্বনেতারা তাঁদের জনগণকে কাজ করতে উৎসাহিত করেছেন, কৃষিতে সবুজ বিপ্লবের মাধ্যমে, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন, কিন্তু কোনো নেতা জনগণকে পড়াশোনার নির্দেশ দিয়েছেন, তা-ও আবার সরাসরি প্রচারিত ভাষণে। এমনটা বিশ্ব আর কখনো অবলোকন করেনি।
আমাদের দেশে ও রাষ্ট্রীয়ভাবে পাঠবিপ্লব খুবই প্রয়োজন। আসুন আমরা শপথ করি, আমাদের সোনামণিরা, ভবিষ্যতের নায়কেরা যাতে নিয়মিত পাঠ করে, অভিভাবক হিসেবে তাদের আমরা নজরে রাখব। প্রত্যেক শিশু আলোকিত মানুষ হয়ে গড়ে উঠুক। সেই স্বপ্ন দেখি।
লেখক: বদরুল আলম, প্রভাষক, তাজপুর ডিগ্রি কলেজ, সিলেট