গ্রান্ড ব্যাচ ডে

সমাজবিজ্ঞান; ৫৯ ব্যাচ। ২০২২ সালের ১ নভেম্বর ডিপার্টমেন্টে আমাদের পদচারণ শুরু, কারও প্রত্যাশিত কারও অপ্রত্যাশিত। ভালো লাগা, মন্দ লাগার মধ্যেও একটু সান্ত্বনা। দেখতে দেখতে দুটি বছরের পতন। বিশ্বাস করতেই অবিশ্বাস্য লাগে। মনে হচ্ছে এই তো সেদিন কত চড়াই-উতরাই পেরিয়ে এ ক্যাম্পাসে আগমন। সময় কতোই না দ্রুত যায়! আর যাবেই না কেন, ওর তো কাজই একটাই ; জলের ধারার মতো বয়ে চলা। জলকে বাঁধ দিয়ে থামানো গেলেও সময় এসব কিছুর ঊর্ধ্বে।

গতবার, বছর পূর্তি উপলক্ষে ঘরোয়া পরিবেশে শুধু কেক কেটেই ব্যাচ ডে পালিত হয়; জাঁকজমকহীন। প্রায় অর্ধেকই অনুপস্থিত ছিল। তবু থেমে থাকলে চলে? কোনোভাবেই না। এটুকুই স্মৃতি। স্মৃতির মূল্য অম্লান। স্মৃতি কখনো ভোলা যায় না, আমরা ভুলে থাকার অভিনয় করি মাত্র। হয়তো কখনো অজান্তেই ভেসে ওঠে সেই স্মৃতিটুকু, যা ব্যথিত অথবা আপ্লুত করে; একটু ভাবায়। ১ নভেম্বর শুক্রবার। ক্যাম্পাস এমনিতেই বন্ধ। টানা এক সপ্তাহ মিড শেষে অনেকেই ক্লান্ত। কেউ শুক্র-শনি ঘুমে কাটাবে নির্ভাবনায়, কেউ ঘুরতে যাবে দূরে বা কাছে, কেউ যাবে নাড়ির টানে। মাস শেষ ও শুরুর দিকে অনেকের হাত খালি; ছাত্রজীবনের কমন সমস্যা। তবু দিব্বি চলে দিনগুলো।

কেক কেটে ২য় বছর উদ্‌যাপন

নানা নাটকীতার পর ৯ তারিখ শনিবার ব্যাচ ডে পালনের তারিখ নির্ধারণ হয়। কিন্তু স্থান? যদিও প্রথমে মতিহার উদ্যানের কথা জানানো হয়। অনেকটা পাকাপোক্তও হয়। এখানে কিছু বিপত্তি; মশা–মাছি, ক্যাম্পাস থেকে একটু দূর, যাতায়াত কষ্ট, অনেকটা অন্ধকার পরিবেশ। মানুষজনের আনাগোনা খুবই কম। এদিকে বদ্ধভূমিতে কেউ আগ্রহী নয়। এর আগেও বেশ কয়েকবার করা হয়েছে। অবশেষে হবিবুর মাঠ ঝাউবাগান ফিক্সড। ক্যাম্পাসের মাঝামাঝি অবস্থান। পিকনিক স্পট হিসেবে স্থানটি বেশ খ্যাত। একটার পর একটা পিকনিক লেগেই থাকে। যেকোনো প্রয়োজন সহজেই আশপাশে থেকে মেটানো সম্ভব।

আমাদের ব্যাচে প্রায় ৯০ শিক্ষার্থী। একসপ্তাহ আগে থেকে চাঁদা সংগ্রহ চলছে। প্রথম দিকে খুব একটা আগ্রহ নেই, অল্প কয়েকজন ছাড়া। যতই দিন ঘনিয়ে আসছে সদস্যও বৃদ্ধি পাচ্ছে। হয়তো কাউকে জোরাজুরি করতে হচ্ছে, নয়তো পাশের বন্ধুর দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে। দ্বিতীয়টা আমার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। শেষ অবধি ৫৯ জনের অংশগ্রহণ নিশ্চিত। ডিপার্টমেন্টের দায়বদ্ধতার প্রশ্ন কজনই বা জানে বা মানে? আমরা সমাজবিজ্ঞানের শিক্ষার্থী হলেও, আসলেই কি সামাজিক, যতটা পিঁপড়া কিংবা মৌমাছি? সমমনায় বিভক্ত বহু গ্রুপে।

সমাজবিজ্ঞানী

দুই দিন আগে থেকেই বেশ তোড়জোড়; চলছে আনুষঙ্গিক কার্যক্রম। ৭ তারিখ রাতে একটা ট্রেলার রিলিজ করে। আরে...! কী চমৎকার প্রদর্শনী; Hey Finally Tt's Happening, What? Batch Day, Of, SOC - 59th Batch, When? 9th November, Location? Hobibur Ground, Now Get Ready, For, A Grand Celebration। বাক্যের খণ্ড খণ্ড অংশ একেকজন একেক স্টাইলে ফুটিয়ে তোলে; প্লাকার্ডে, রিকশায়, পুকুরে, গাছের ডালে বসে, আড্ডার ফাঁকে আরও নানা ভঙ্গিতে। দেখে বোঝার বাকি নেই ব্যাচ–ডে আসলেই অনন্য হবে। হয়তো এ জন্য এবারের নাম দেওয়া হয়েছে গ্রান্ড ব্যাচ ডে। আকর্ষণ বেড়ে গেল যতটুকু কমতি ছিল।

মেয়েদের ক্রেডিট না দিয়ে উপায় নেই। বেশি শ্রম ওরাই দিয়েছে। বাহ্‌! কী আগ্রহ ওদের। যত ডেকোরেশন ওদের কাজ, নিজ দায়িত্বে নিয়েছে। কাটুন কেটে ফটোফ্রেম, প্ল্যাকার্ড  তৈরি, স্পট সাজানো, বাজার করা আরও কত কী। ওরা ফটোফ্রেমের ঠিক ওপরে ইংরেজিতে গ্রান্ড, নিচে ব্যাচ ডে ও তারিখ সুন্দর করে সেঁটে দিয়েছে। আর দুই পাশে সামসময়িক ভাইরাল উক্তিগুলো তুলে ধরে; উত্তেজিত হবেন না, নাটক কম করো পিও, দেখেন আপনারা যা ভালো মনে করেন; বেশ হাস্যরসের ছিল।

স্পটের প্রবেশ মুখে প্লাকার্ডে  ঝুলছে সমীক্ষণ- ৫৯। আমাদের ব্যাচের নাম। বাংলাদেশে সমাজবিজ্ঞানের পুরোধা ব্যক্তিত্ব নাজমুল করিম স্যারের একটি বইয়ের নাম ‘সমাজবিজ্ঞান সমীক্ষণ’। এই সমীক্ষণ থেকেই ব্যাচের নাম নেওয়া। দুই পাশে ঝাউগাছ। ছোট ছোট প্ল্যাকার্ডে লেখা সমাজবিজ্ঞানী ও বহুল ব্যবহৃত টার্ম। এবার একটু হাসি পেল Why Marriage?  শব্দটি দেখে। অন্য ডিপার্টমেন্টের শিক্ষার্থীরা হয়তো পাগল বলবে, বলবে এতে হাসার কী আছে। আর বলবেই না কেন, ওরা তো Why Marriage? এর আসল রহস্য জানে না। নয়তো বিয়ের শখটাই মিটে যেত।

একটা পত্রহীন বৃক্ষ আর্ট করা ছিল। যেন পোষ মাসে ঝড়ে যাওয়া কোনো মেহগনি কিংবা জিগাগাছ। প্রত্যেকের আঙুলের ছাপ নিয়ে লাল, সবুজ, হলুদ, ম্যাজেন্টা রঙের পত্র সেঁটে দিল। এবার বৃক্ষের পূর্ণতা। পূর্ণতা আসলে আর্টে, প্রকৃতিতে নয়। গাছের রং তো আর ম্যাজেন্টা নয়। রোল নম্বর দিয়ে পত্র চিহ্নিত করা হয়। অবশ্যই অসাধারণ এক নান্দনিকতার স্বাক্ষর রাখে। স্মৃতির মূল্য মর্যাদায় সংরক্ষণ। মেয়েরা প্রকৃতির মতো। ওরা আপনা থেকেই নন্দনতত্ত্বে  একটু বেশি সজাগ।

ফিঙ্গার প্রিন্টে বৃক্ষের পাতা

বেলা প্রায় দুইটা। ক্ষুধার সেকি তাড়না!  রান্নাবান্না কিছুক্ষণ আগেই শেষ। বিরিয়ানির গন্ধ নাকে সুড়সুড়ি দিচ্ছে। আর অপেক্ষার তর সইছে না। বিরিয়ানিটা দারুণ; স্বাদে- গন্ধে অনন্য। সঙ্গে ডিম ভুনা, সালাদ,  কমল পানীয়। আইটেম বেশি না হলেও খাবারের কমতি নেই। আর থাকবেই বা কেন, জোগান ছিল যথেষ্ট, পরিমাণের চেয়ে বেশি।

খাবারের বিশ্রাম শেষে বিনোদন পর্ব। কেউ গান, কেউ কবিতা পাঠ, কেউ রংঢং, কেউবা হকারের অভিনব কথাবার্তা বলেন। আমি নিজের লেখা একটা কবিতা পাঠ করি বেসুরো গলায়। অঙ্কুর; একজনকে উৎসর্গ করে লেখা। আজও তাকেই উৎসর্গ করলাম। চাইলে লিখতে পারি কিন্তু পাঠ করার মতো রসবোধ আমার নেই। কখনো পাঠও করিনি ; করার  চেষ্টাও করিনি। বন্ধু সুজন ত্রিপুরা, ত্রিপুরা ভাষায় দুটো গান গায় কয়েক লাইন করে। কিছুই না বোঝা আমি, আমার মতো সবাই।  বুঝব কেমনে, এ ভাষার সঙ্গে কেউ পরিচিত নই। ছোট্ট একটা দেশ অথচ ভাষার কী বৈচিত্র্য ! এর মধ্যেই কেক কাটার কাজটা সারা হয়।

এবার শাড়ি পরানোর প্রতিযোগিতা । মেয়েরা ছেলেদের পরাবে। যে যত কম সময়ে পরাবে, সেই  বিজয়ী।  শুধু কম সময়ে পরালেই  চলবে না, সুন্দরও হতে হবে। এ অংশটা বেশ মজার ছিল, শেষ পর্যন্ত। কোনো ছেলে কি চায় শাড়ি পরে বউ সাজতে?  হ্যাঁ, আর কেউ না চাইলেও বন্ধু মেহেদী ঠিকই চায়। কয়েকজন মেয়ে একে একে শাড়ি পরালো। বোঝা গেল ওরা অনেকে বেশ দক্ষ। অনেকে নাকি নিজেরাই পরতে জানে না, অন্যের হেল্প লাগে। বধূর সাজে মেহেদীকে খারাপ লাগছে না। কেউ কেউ তো ওর সঙ্গে মজা নিতেও শুরু করল ; বউ হবে কি না।

আমাদের ডিপার্টমেন্টের নামে কোনো চত্বর নেই।  যদিও সামাজিক বিজ্ঞানের অনেক ডিপার্টমেন্টেরই আছে। যেখানে ক্লাস শেষে একটু আড্ডা দেব। পুরো ক্যাম্পাসই আড্ডা দেওয়ার মতো হলেও নিজের বলে কিছু নেই। এখন ৬১ ব্যাচ রানিং। এর আগে কোনো ব্যাচ চত্বর স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছিল কি না জানা নেই। অনেক আগে থেকেই এ বিষয়ে আলোচনা করছিল সিআররা।  মমতাজ উদদীন ভবনের সামনে শাহরুখ ভাইয়ের চায়ের দোকান। দোকানের আমগাছটাই আমাদের চত্বর । ব্যাচ ডে উপলক্ষে আজই সাইনবোর্ড লাগানোর কথা।  যদিও সারাদিন পিকনিক করতেই চলে যায়,  সাইনবোর্ড লাগানো সম্ভব হয়নি। পরদিন রোববার লাগানো হবে বলে জানানো হয়। ‘সমাজবিজ্ঞান চত্বর’ নামটা সবার কাছে অর্থবহুল না হলেও সমাজবিজ্ঞানের শিক্ষার্থী হিসেবে আমাদের কাছে মূল্যাতীত। হয়তো কোনো দিন ক্যাম্পাসে এলে দেখতে ইচ্ছা করবে ওই আমগাছটা, ইচ্ছা করবে সেই আবেগপ্রবণ লেখাটা। ততদিন কি থাকবে ওই গাছ অথবা সাইনবোর্ডটা?

অবশেষে সমাজবিজ্ঞান চত্বর’–এর উন্মোচন

ব্যাচ ডে বছরে একবারই আসবে।  হয়তো আগামী তিন বছর পালন করার সৌভাগ্য হবে; বড়সড় নয়তো ছোট্ট পরিসরে। এরপর বছর বদলাবে  ঠিকই কিন্তু ব্যাচ ডে পালন আর হবে না। আজকের এই সাদামাটা আয়োজনটাও সেদিন স্মৃতিতে নাড়া দেবে। এই স্মৃতিটুকুই বেঁচে থাকুক হৃদয়ে যত্নে–সম্মানে। স্মৃতির মূল অম্লান।

মো সবুজ আহমেদ, শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়