ভাষা দিবস: লাল গোলাপের জন্য ভালোবাসা

ভাষার স্কুলে ক্লাস নিচ্ছেন শিক্ষক। সম্প্রতি মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলার হোসনাবাদ পানপুঞ্জিতে
ছবি: প্রথম আলো

বাংলাদেশ যেন একটি সুন্দর সুবাসিত ফুলের বাগান। সে বাগানের লাল গোলাপ আমাদের মধুর বাংলা ভাষা। বাগানের গোলাপি, হলুদ, কমলা গোলাপগুলো প্রিয় বাংলার আঞ্চলিক বৈচিত্র্য। বাগানে রয়েছে আরও বাহারি ফুল। টগর, জবা, বেলি, কামিনী, মালতীরা হলো এ দেশের অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর ভাষা। রঙে সুবাসে এমনই বৈচিত্র্যময় আমাদের ভাষার ফুলের বাগান।

আমাদের বাগানের লাল গোলাপ গাছটি বহু বছরের নিপীড়নের সাক্ষী। গোলাপ গাছটিকে পার করতে হয়েছে বায়ান্নর রক্ত নদী। একাত্তরের মহাসমুদ্র পাড়ি দিয়ে এসে সে হয়েছে আরও প্রস্ফুটিত নব যৌবনা। ৫০ বছর পেরিয়ে কী এমন বিপত্তি ঘটল যে সুবাসে-সৌরভে বিমোহিত হয়ে গোলাপ গাছটিকে আমরা লালন করতেই ভুলে গেছি। আলো-বাতাস আর জলাভাবে লাল গোলাপ হারাতে বসেছে তার আপন সৌন্দর্য।

একটি ভাষার আলো হলো ভাষার সুন্দর উচ্চারণ, বাতাস হলো সঠিক বানান আর জল হলো ভাষার যথাযথ ব্যবহার। প্রতিটি ভাষার একটি সুনির্দিষ্ট আন্তশৃঙ্খলা রয়েছে। এই আন্তশৃঙ্খলা ভাষাকে বিশেষত্ব ও সৌন্দর্য দান করে। তাই বাংলা থেকে ইংরেজি কিংবা ইংরেজি থেকে জার্মান উচ্চারণে, শাব্দিক বৈচিত্র্যে ও ভাষিক ব্যবহারে আলাদা। বিষয়টা কিছুটা ছাঁচের মতো। গোলাকৃতির ছাঁচে বলজোরে কি আর চারকোনা ছাঁচ বসানো যায়? তাতে বরং গোলাকৃতির ছাঁচটাই অসুন্দর হয়। ইংরেজি ঢঙে বাংলা উচ্চারণের বেলাতেও তাই হয়।

অন্তত ভাষার দিক থেকে বলা যায়, আমরা সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মেছি। পৃথিবীর অন্যতম মধুরতম ভাষা আমাদের বাংলা ভাষা। বাংলা ভাষার অতিরিক্ত ধ্বনিমূলীয় বৈশিষ্ট্য ভাষাকে মধুর করেছে। আমি হলফ করে বলতে পারি ‘ভালোবাসি প্রিয়তম’ এই দুই শব্দের উচ্চারণের আকুল কণ্ঠের কম্পনের যত বৈচিত্র্য বাংলা ভাষায় আছে, তা পৃথিবীর আর কোনো ভাষায় নেই!

আরও একটি কারণে আমরা ভাগ্যবান, সেটি হলো বাংলা ভাষার সমৃদ্ধ ধ্বনিভান্ডার। পৃথিবীর খুব কম ভাষাই আছে যাদের বাংলা ভাষার মতো সমৃদ্ধ ধ্বনিভান্ডার আছে। সে কারণে গুটিকয় ভাষা বাদে প্রায় সব ভাষার উচ্চারণ প্রায় আয়ত্ত করা সম্ভব। সে কারণে চীনা ও জাপানি ভাষাভাষীরা ইংরেজি ভাষার বিশেষ কিছু ধ্বনি চেষ্টা করেও উচ্চারণ করতে পারে না। বাংলা ভাষা উদ্ভবের সমৃদ্ধ ইতিহাসের কথা নতুন করে বলার কিছু নেই।

বাংলা ভাষা নিয়ে এত কিছু বলার কারণ একটাই। আমাদের পরিচয় আমাদের সত্তাকে আমরাই কলুষিত করে ফেলছি দিন দিন। ভাষা পরিবর্তনশীল। একে ধরেবেঁধে রাখা সম্ভব নয়, ঠিকও নয়। কিন্তু খেয়াল রাখতে হবে আমাদের অবহেলা-অযত্নে যেন আমাদের লাল গোলাপ তার আপন সৌন্দর্য না হারায়।

আমরা যখন বাংলাকে অন্য একটি ভাষার আদলে উচ্চারণ করি, তখন ঝরতে থাকে লাল গোলাপের একেকটি পাপড়ি। আমাদের অসচেতনায় বাংলা ভুল বানানে গোলাপের পাপড়ির শিশির বিন্দুগুলো শুকিয়ে যায়। যখন বাংলা ভাষার বাক্যের মানচিত্রে ছিটমহলের মতো বসিয়ে দেই অন্য ভাষার শব্দাবলি, তখন দম বন্ধ হয়ে মারা যায় একটি লাল গোলাপ! ভাষার মাসে আমরা একটি লাল গোলাপের কান্না সইব কী করে?

তাওহিদা জাহান: সহকারী অধ্যাপক, কমিউনিকেশন ডিজঅর্ডারস বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়