হিমু ও বিশ্বকাপ
হিমুর পকেটে একটা কানাকড়িও নেই। অবশ্য তার হলুদ পাঞ্জাবিতে কখনো পকেট থাকে না। হিমুর বাবা তাকে মহাপুরুষ বানানোর যে শর্তগুলো লিখে গিয়েছেন, এটা তার মধ্যে একটি। হিমু ওই শর্ত কঠিনভাবে মেনে চলে। আজ মাসের ২৬ তারিখ। তার খালাতো ভাই বাদলের ধারেকাছে না ভিড়তে তাকে মাসে ৩ হাজার টাকা দেওয়া হয়। খালুর অফিস থেকে মাসের ১ তারিখে টাকা নেওয়ার নিয়ম। এ মাসের টাকা অগ্রিম নিতে হবে। উপায় নেই। হিমু নিউমার্কেট এলাকা দিয়ে ধানমন্ডির দিকে খালার বাসার উদ্দেশে যাচ্ছে। এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। চারদিকে এত ভিনদেশি পতাকা কেন! ব্রাজিল, আর্জেন্টিনার পতাকাই বেশি। কিছু অন্য দেশের পতাকাও পতপত করে উড়ছে। হিমু বিভ্রান্তিতে পড়ে গেল।
রাস্তার পাশের আর্জেন্টিনার জার্সি গায়ে দেওয়া শরবত বিক্রেতাকে জিজ্ঞেস করল, বিষয় কিছু জানেন? এত দেশের পতাকা কেন?
শরবত বিক্রেতা ঝাড়ি দিয়ে বলল, মিয়া আইজকাই পাহাড় থেইক্যা নামলেন নাকি? বিশ্বকাপ খেলার খবর জানেন না?
-তাই তো, মহা অপরাধ হয়ে গেছে। হিমু লক্ষ করল, ফুটপাতে পাশাপাশি দুই গ্রুপ গলা ফাটাচ্ছে।
এক গ্রুপের চিৎকার, লইয়া যান আর্জেন্টিনা, বাইচ্ছা নেন আর্জেন্টিনা, ১২০ আর্জেন্টিনা, চ্যাম্পিয়ন আর্জেন্টিনা।
আরেক গ্রুপের চিৎকার, লইয়া যান ব্রাজিল, বাইচ্ছা নেন ব্রাজিল, ১২০ ব্রাজিল...।
আহ! বেচাবিক্রিও খারাপ হচ্ছে না। ক্ষুধায় পেট চিনচিন করে উঠল।
হিমু লম্বা পায়ে মাজেদা খালার বাসার দিকে হাঁটা ধরল। বাসায় পৌঁছতে পৌঁছতে রাত নয়টা।
কল বেল টিপতেই মাজেদা খালা দরজা খুলে দিলেন। গম্ভীর গলায় বললেন, তোর না বাসায় আসা নিষেধ!
-হাত খালি, এ জন্য বাধ্য হয়ে এলাম। আগে ভাত দাও। পেটে আলসার হয়ে যাবে।
ভাত খেতে খেতে হিমু খালাকে জিজ্ঞেস করল, খালুর কোন সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। বাসায় নেই নাকি?
-আছে। ছাদে বসে গিলছে।
-ও, তাহলে সেখানেই যাই।
হিমুকে দেখে খালু দরাজ গলায় বলল, ইউ আর মোস্ট ওয়েলকাম, হিমু। মাঝেমধ্যে মনে হয় তুমি লোক খারাপ না।
খালুর পেটে কিছুটা পড়েছে বোঝা যায়।
হিমু উৎসাহ নিয়ে জিজ্ঞেস করল, খালু, বিশ্বকাপে আপনি কোন দলের সমর্থক।
খালু শান্ত স্বরে বললেন, শোনো, আমি বিশেষ কোনো দেশের সমর্থক নই। সামনে পড়ে গেলে খেলা দেখি। যার খেলা ভালো লাগে, তাকেই বাহবা দিই।
-তুমি কি জানো, খেলার সৃষ্টি কী জন্য?
-জি না খালু।
-গ্রিস সভ্যতা অনেক পুরোনো, তা তো জানো।
-জি খালু।
-প্রাচীন গ্রিসে অলিম্পাস পর্বতমালার পাদদেশে অলিম্পিক গেমসের প্রথম শুরু। উদ্দেশ্য ছিল খেলাধুলার মাধ্যমে অন্য দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন। এখন পর্যন্ত সব খেলাধুলার উদ্দেশ্য ওই একটাই। কিন্তু আমাদের দেশে হচ্ছে উল্টো।
-হিমু, তুমি কি ফেসবুক চালাও?
-জি না, আমি তো মোবাইল ফোনই চালাই না।
-ও, ভুল হয়ে গেছে। তুমি তো আবার মহাপুরুষ!
-জি না। চেষ্টা করছি।
–আমি একটু–আধটু চালাই ইদানীং। ফেসবুকটা আর্জেন্টিনা আর ব্রাজিল সাপোর্টাররা দখল করে নিছে। শুধু নিছে বললে ভুল হবে। এক গ্রুপ আরেক গ্রুপের সমর্থকদের গুষ্টি উদ্ধার করছে; কেউ মেসির আর কেউ নেইমারের গুষ্টি উদ্ধার করছে। ওদের দেশও বাদ যাচ্ছে না। পত্রিকায় দেখলাম কেউ ব্রাজিলের পতাকার রঙের ঘর করছে; কেউ আর্জেন্টিনার পতাকার রঙের। আবার অন্ধ সাপোর্টাররা কেউ ২ হাজার ফুটের পতাকা বানিয়ে র্যালি করছে। এটা দেখে অন্যরা আড়াই হাজার ফুটের পতাকা বানাচ্ছে। অদ্ভুত বিষয়!
–হিমু, তুমি কী কখনো মেসি বা নেইমারকে পরস্পরের বিরুদ্ধে কোনো ফাউল টক করতে শুনেছ।
-জি না খালু।
–আমি নিশ্চিত, ওদের সরকারপ্রধান আমাদের এ ফাউল উন্মাদনা জানে না। জানলে নির্ঘাত আমাদের সরকারপ্রধানের কাছে বিস্ময়বার্তা পাঠাত। হিমু, আরও বিস্ময়ের ব্যাপার কী, তা জানো?
-কোনটা খালু?
–আমাদের দেশের মানুষের পাঁচটা মৌলিক চাহিদার কোনটা ফুলফিল আছে। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা। কোনোটাই নেই। এদের দেখে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, দেশ সংকটে, এটা বোঝার উপায় নেই। খেলাধুলা তো বিনোদনের একটা মাধ্যম মাত্র। অতি উর্বর মস্তিষ্কের সমর্থকদের উন্মাদনা দেখলে আমার মাথায় রক্ত চড়ে যায়। এদের গাছের সঙ্গে টাঙিয়ে চাবকানো উচিত। শরীর থেকে চামড়া আলাদা করে ফেলা উচিত। দেশে আর যেন কাজ নেই। অপদার্থ কোথাকার।
-খালু, এখন চাবুকের যুগ নেই। অন্য কিছু দিয়ে সারতে হবে।
–আমাকে জ্ঞান দিচ্ছিস! চাবকে তোর মহাপুরুষগিরি ছাড়ানো উচিত।
হিমুকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে খালু হড়হড়িয়ে বমি করে চিৎকার করে উঠলেন,
–কইগো আমার মাথা ছিঁড়ে যাচ্ছে।
তিন হাজার টাকা আজ আর হবে না জেনে হিমু খালুকে রেখে পগারপার হয়ে গেল।
খালুর খেদমতে খালা তো আছেনই!
লেখক: শিক্ষক