গবেষক হিসেবে ক্যারিয়ার গঠন: কী করতে হবে, কী করা যাবে না

গবেষণা
প্রতীকী ছবি

বর্তমান সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা শেষ করে অধিকাংশ তরুণ-তরুণী সরকারি বা বেসরকারি উচ্চপর্যায়ের চাকরি পাওয়ায় মনোনিবেশ করলেও কিছু শিক্ষার্থী ঝুঁকছে গবেষক হিসেবে ক্যারিয়ার গঠনে। পারতপক্ষে, যেকোনো অফিশিয়াল কাজ করার ক্ষেত্রেও গবেষণা অনেক সময় প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে।

সেই উদ্দেশ্যে বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক পর্যায়ে গবেষণার ব্যাপারে বিস্তারিত পড়ানো হয়ে থাকে। কিন্তু নির্দিষ্ট কিছু মানুষ আছে, যারা এ কোর্সের মধ্যেই নিজের জ্ঞান সীমাবদ্ধ রাখে না; পছন্দমতো বিষয়ে আরও জ্ঞান লাভ করার উদ্দেশ্যে এবং সে বিষয়ে সেই জ্ঞান ব্যবহারের জন্য গবেষক হিসেবে ক্যারিয়ার গঠন করে। সত্যি কথা বলতে, যেকোনো বিষয়ে সুষ্ঠু সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে গবেষণার বিকল্প নেই এবং এ ক্ষেত্রে সব দেশেই গবেষকদের ইনসেনটিভ দিয়ে নানা বিষয়ে গবেষণার জন্য উৎসাহিত করা হয়।

গবেষণার ক্ষেত্রে বেশির ভাগ পড়ুয়া যুক্ত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে এর প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করে মার্কিন অর্থনীতিবিদ বেন বারনেকে বলেছেন, ‘আসলে বিশ্বে আরও পড়ুয়া ব্যক্তি প্রয়োজন।’

লেখক

কিন্তু অন্য যেকোনো কাজের মতোই একজন গবেষণা-উৎসাহীকে জানতে হবে, সে কীভাবে তার কাজ করবে, কোনো বিষয়গুলো মাথায় রাখতে হবে, কী করা যাবে, আর এ সিদ্ধান্ত তাকে কত দূর নিয়ে যাবে। সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, এ সিদ্ধান্ত কি আদৌ তার রুটিরুজি জোগাবে?

যদিও জার্মান-আমেরিকান পদার্থবিজ্ঞানী ওয়েনার ভন ব্রাওন বলেছেন, ‘গবেষণা হচ্ছে তা-ই, যা আমি করছি, কিন্তু একই সঙ্গে জানি না আসলে কী করছি।’ আপনাকে জানতে হবে আপনি কী করার চেষ্টা করছেন এবং কাজগুলো করার ক্ষমতা আপনার আছে কি না। বিভিন্ন খাতে গবেষণার ধাঁচ, মেথড, প্রসেস আলাদা হলেও কিছু মৌলিক গুণ যেকোনো ধরনের গবেষণা করতে প্রয়োজন হয়। চলুন দেখে নিই গবেষক হিসেবে এগোনোর আগে কোনো প্রশ্নগুলো নিজেকে করা উচিত এবং তার উত্তর কী হওয়া উচিত।

আপনার কি অনেক পড়াশোনা করার ক্ষমতা আছে

গবেষক হতে হলে অন্যতম শর্ত হচ্ছে আপনাকে পড়তে হবে। না পড়েও গবেষক হওয়া যায়, কিন্তু তার মান স্বাভাবিকভাবেই হয় খুবই খারাপ এবং এমন গবেষকদের দিয়ে কেউ কাজও করাতে চায় না। পড়তে হবে; কারণ এক কথায় আপনাকে জানতে হবে। শুধু বিষয়ভিত্তিক পড়াশোনা করলেই হবে না, আপনাকে জানতে হবে গবেষণার বিভিন্ন কার্যক্রম কীভাবে করতে হবে।

এ ক্ষেত্রে বই থেকে শুরু করে জার্নাল আর্টিকেল, রিপোর্ট, নিউজ আর্টিকেল রিভিউ করা বাধ্যতামূলক। এমনকি, আপনি কী নিয়ে গবেষণা করতে চান, এটা বুঝতে হলে আপনাকে পড়তে হবে। তা না হলে আপনি জানবেন না এ বিষয় নিয়ে আগে কাজ হয়েছে কি না এবং হলেও কেমন কাজ হয়েছে ও আপনার এখানে কতটুকু অবদান রাখার সুযোগ আছে।

পড়ার ক্ষেত্রে আমরা প্রায়ই ভয় পাই যে এত লিটারেচার কোথায় পাব বা এত বই কেনা অনেকের জন্যই সম্ভব নয়। সে ক্ষেত্রে সবচেয়ে সহজ সমাধান হচ্ছে বিভিন্ন প্রক্সি লিটারেচার সার্ভার, যেমন লিবজেন, জেড-লাইব্রেরি, সাই-হাব ইত্যাদি ওয়েবসাইট ব্যবহার করে হাজারো সাভারে প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা। যদিও এগুলো পাইরেটেড সার্ভিস, নতুন গবেষক, যাদের ফান্ডিং থাকে না বা খুবই কম, তাদের জন্য এগুলো খুবই উপকারী।

মনে রাখতে হবে, পড়ার ক্ষেত্রে শুধু গৎবাঁধা মুখস্থ করা যাবে না, এটা বার্ষিক পরীক্ষার জন্য পড়া নয়। পড়তে হবে বুঝে বুঝে, দরকার হলে নোট করে। আপনার পদ্ধতি বিভিন্ন রকম হতে পারে, কিন্তু তা অবশ্যই আপনার গবেষণার জন্য কার্যকর হতে হবে।

আপনার কি রিসার্চ শেখার সুযোগ আছে

বইপুস্তক পড়ে যতই জানা হোক না কেন, গবেষণায় পাকাপোক্ত হওয়া যায় শুধু হাতে-কলমে কাজের মাধ্যমে। বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণা শেখানোর জন্য আলাদা কোর্স থাকে, কিন্তু সময়স্বল্পতা ও যথাযথ ব্যবস্থা না থাকার কারণে সেসব থেকে শেখা যায় খুবই কম।

আপনি যদি শুরুতেই বুঝতে পারেন যে আপনি গবেষক হবেন, তবে কাজ শুরু করে দিন ছাত্রজীবন থেকেই। রিসার্চ মেথড পড়ার পাশাপাশি আপনার পছন্দসই বিষয়ে কাজ করুন। সে ক্ষেত্রে আপনি কোন শিক্ষকের সঙ্গে কাজ করে শিখতে পারেন, কোন প্রজেক্টে ফ্রিল্যান্সিং করতে পারেন, এমনকি নিজে একটি বিষয় ঠিক করে কাজ শুরু করতে পারেন। গবেষণার নানা কার্যক্রম, যেমন লিটারেচার রিভিউ, স্যাম্পলিং, কোডিং, অ্যানালাইসিস, ফ্রেমওয়ার্ক বিল্ড আপ, ইত্যাদি কাজ যত বেশি নিজ হাতে করা যায়, তত বেশি দক্ষতা বাড়ে।

আপনি কি পরিশ্রম করতে পারেন

গবেষণা মানে কিন্তু শুধু টেবিলে বসে বই দাগিয়ে দাগিয়ে পড়ে নোট করা নয়, আপনাকে মাঠেঘাটে ঘুরে বেড়াতে হবে, ইন্টারভিউ নিতে হবে, সার্ভে করতে হবে, ট্রান্সক্রিপশন করতে হবে, কোডিং করে ডেটা অ্যানালাইসিস করতে হবে। শুনে অনেক বেশি মনে হলেও কমবেশি সব রিসার্চেই এই ধাপগুলো করতে হয়।

এ ক্ষেত্রে যেমন থাকতে হবে আপনার কমিউনিকেশন করার দক্ষতা, তেমন একই সঙ্গে চার-পাঁচটা কাজ করার ক্ষমতা, যাকে বলে মাল্টিটাস্কিং। সাধারণত, একজন গবেষক একই সঙ্গে কয়েকটি কাজে যুক্ত থাকে এবং প্রতিটি কাজের গবেষণা কার্যক্রম আলাদাভাবে করতে হয়। তাই এ রাস্তায় হাঁটার আগে মাথায় রাখতে হবে, এ কাজে এক হাতে যেমন লাগে ব্রেন-ওয়ার্ক, তেমন লাগে কমিউনিকেশন স্কিলস, পরিশ্রম করার ক্ষমতা, অন্যকে ও নিজেকে গাইড করার দক্ষতা।

আপনি কি লিখতে পারেন

একটি গবেষণাকর্মের সবচেয়ে বড় স্বীকৃতি হচ্ছে, তা থেকে বের হয়ে আসা লেখাটা কোনো স্বনামধন্য হাই কিউআর জার্নাল বা বইয়ে অথবা রিপোর্ট হিসেবে প্রকাশিত হওয়া। সে ক্ষেত্রে আপনাকে খুব স্বাভাবিকভাবেই, লিখতে হবে। এতে ভয় পাওয়ার কিছু নেই, অন্য সব স্কিলস এর মতো লিখতে পারাও একটি শিক্ষণীয় স্কিলস।

নানা ভাবে সাহায্য নিয়ে আপনি সহজেই আপনার লেখার স্টাইল বের করে আনতে পারেন। এ ক্ষেত্রে শুরু থেকেই আপনি ছোটখাটো লেখা, যেমন পত্রিকায় অপ-এড, ব্লগে লেখা, ওয়েবসাইটে কনটেন্ট দেওয়া, কোন বিষয় নিয়ে নিজের মতামত লিখে ফেলা ইত্যাদি কাজ করতে পারেন। খেয়াল রাখতে হবে, ফ্যাক্ট বেজড লেখার পাশাপাশি আপনাকে অ্যানালিটিক্যাল লেখায় পারদর্শী হতে হবে। কারণ, আপনার গবেষণাপত্র আপনার ক্রিটিক্যাল অ্যানালিসিসেরই প্রতিচ্ছবি।

আপনার ধৈর্য আছে তো

বুঝতেই পারছেন, এসব কাজ করতে দরকার অপরিসীম ধৈর্য। ঘণ্টার পর ঘণ্টা একটা বিষয় নিয়ে চিন্তা করা, তা নিয়ে পড়া, ঘুরে ঘুরে রিসোর্স জোগাড় করা, তা একসঙ্গে গোছানো, পাবলিকেশনের জন্য আবার লেখা, তা সাবমিট করে বসে থাকা যে কবে প্রকাশনার জন্য গৃহীত হবে—এককোথায় অনেক ধৈর্যের কাজ। গবেষক হওয়ার আগে চিন্তা করুন, আপনি এসব ব্যাপার মেনে নিচ্ছেন কি না।

খুব স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে, এত কিছু করে আমার কী লাভ?     গবেষণার চাহিদা নেই, এমন কোনো ক্ষেত্র নেই। একটি সফটওয়্যার তৈরি থেকে শুরু করে চায়না-আমেরিকার মতিগতি বুঝে পলিসি নির্মাণ, সবক্ষেত্রেই গবেষণার দরকার হয়। আজকাল বড় বড় মাল্টিন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ও ইন্টারন্যাশনাল এনজিও হাই লেভেলে রিসার্চার পদে নিয়োগ দিচ্ছে বেশ ভালো বেতনে।

এ ছাড়া আপনি যদি শিক্ষক হন বা হতে চান, বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, আপনাকে অবশ্যই গবেষণায় পারদর্শী হতে হবে এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে কাজ থাকতে হবে। তা ছাড়া বর্তমানে বাংলাদেশেই অনেক গবেষণাধর্মী ইনস্টিটিউট গড়ে উঠেছে, যারা প্রজেক্ট ভিত্তিতে গবেষণার কাজ করে এবং পুরোপুরি রিসার্চকে কেন্দ্র করেই নিজেদের অর্গানাইজেশন সাজায়। তাই গবেষণাকর্মী হলে হয়তো শুরুতেই আপনার স্যালারি লাখে হবে না, কিন্তু কাজ শিখতে শিখতে ঝানু গবেষক হয়ে যেতে পারলে নির্দিষ্ট সেক্টরে আপনার বেশ চাহিদা থাকবে।

গবেষণা খাতে আসতে চাইলে কিছু অভ্যাস একদম বাদ দিন। হালকার ওপরে পড়াশোনা করে গবেষণা করা যায় নয়। আপনাকে গভীরভাবে জানতে হবে এবং চিন্তা করতে হবে। কোনো নির্দিষ্ট মেথডে নিজেকে সীমাবদ্ধ না রেখে বিভিন্ন উপায় শিখুন। আজকাল কোয়ান্টিটেটিভ স্টাডির অনেক চাহিদা। কোয়ালিটেটিভ থেকে এটি কঠিন হলেও কয়েকটি কোর্স করে শিখে নিতে পারলে অনেকের মধ্যে আপনাকে প্রাধান্য দেওয়া হবে।

ইন্টারভিউয়ের ধরনগুলো কী, কীভাবে নানা ধরনের স্যাম্পলিং করা যায়, সফটওয়্যারে ব্যবহার করে কীভাবে ডেটা অ্যানালাইসিস করা যায়, বিভিন্ন মেথডলজি ব্যবহার করে কীভাবে ফাইন্ডিংস বের করে আনা যায়—এসব শিখুন, না হলে বর্তমান প্রতিযোগিতার বিশ্বে পুরোনো দীক্ষা দিয়ে টিকে থাকা খুব কঠিন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, প্লেজারিজম বা কুম্ভিলকবৃত্তি অনুসরণ করবেন না।

এতে আপনার ক্যারিয়ারই শুধু নষ্ট হবে না, আপনি কোনো খাতেই একজন ভালো গবেষক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারবেন না। সবশেষে, ধৈর্য ধরুন, মাঝপথে ছেড়ে না দিয়ে চেষ্টা করে যান, নিজের মূল্য কাজের মাধ্যমে তৈরি করুন, তবেই একজন সার্থক গবেষক হওয়া সম্ভব।

লেখক: যুবাইদা অহনা ফারুক, গবেষক, সাবেক শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

**নাগরিক সংবাদে লেখা ও ছবি পাঠাতে পারেন [email protected]–এ