ডুবন্ত ফেনীর বৃহস্পতিবার
বৃহস্পতিবার সকালে কারও সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পেরে ট্রাংক রোডে চলে যাই। সেখানে গিয়ে দেখি হাজারো মানুষ কাঁদছে। তখন ফেনীর চারদিক বন্যার পানিতে ডুবে গেছে। বোট তখনো ঢোকা শুরু হয়নি। তাই কেউ বন্যাকবলিত এলাকায় যেতে পারছিল না। সবাই পরিবারের খোঁজে স্বেচ্ছাসেবকদের পেছনে ঘুরছে।
হঠাৎ এই আহাজারির মধ্যে এক বন্ধুকে পাই। তার মামার সঙ্গে কোনোভাবে যোগাযোগ হয়েছে। তার মামার কান্না ওপার থেকে তার প্যারালাইজড নানা, মামাদের উদ্ধার করার জন্য। এ সময় বন্ধুর চোখ দিয়ে পানি পড়বে, এমন অবস্থা। এমন পরিস্থিতিতে ট্রাংক রোডে বোটের জন্য অনেক মানুষের কাছে যাই এবং একটা টিম বোট নিয়ে বন্ধুর নানার বাড়ি যাওয়ার কথা ছিল।
এটা শুনে কোমরপানিতে তাদের পেছন থেকে অনুসরণ করে এক ঘণ্টা হেঁটে যাওয়ার পর জানতে পারি, তারা অন্যদিকে যাবে। এরপর আবার ট্রাংক রোডে এসে জোহরের নামাজ পড়ে বের হতেই একটা ট্রাকে রওনা দিই লালপোল হাইওয়ের দিকে। যেখানেই উদ্ধার করার আশা দেখছি, সেখানেই আমরা দৌড়েছি। লালপোল যাওয়ার পথে কী ভয়াবহ দৃশ্য—পানি দোতলা ছুঁই ছুঁই, হাজারো মানুষ নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য পরিবারের বৃদ্ধ ও বাচ্চাদের বেলায় ভাসিয়ে নিয়ে চলছে। এমন দৃশ্য ফেনীতে বিশ্বাস হচ্ছিল না।
লালপোলে গিয়ে দেখি হাইওয়ে পুরো ডুবে আছে, আর পানির স্রোত এত তীব্র যে মানুষ ও প্রাইভেট কার ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। শত শত মানুষ ধরে ধরে গাড়ি পার করছে। এখানকার এই ভয়াবহতা দেখে আমরা নীরব হয়ে যাই। আমাদের গন্তব্যও পাল্টে যায় ফেনী শহরের দিকে। এ অবস্থায় আমাদের ওই দিকে মুভ করাটা হয়তো ভুল হতো।
এর মধ্যে চারদিক থেকে কল আসে পাঁচ মিনিটের জন্য, অনেকে বোট নিয়ে আসছেন ফেনীর বাইরে থেকে পরিবার উদ্ধারের জন্য, কয়েকজনকে কথা দিই আপনাদের সঙ্গে যাচ্ছি। পরে আর কাউকেই চার দিন ফোনে পাওয়া হয়নি।
ট্রাংক রোডের দিকে আসতে আসতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। একই অবস্থা ট্রাংক রোডে, হাঁটু থেকে কোমরসমান পানি। কয়েকজন বন্ধু এক হতে পারি, আরেক বন্ধুর ছোট বোন আটকা পড়ে আছে গ্রামে। তখন ফেনীতে কিছুসংখ্যক বোট আসে। এমন কোনো বোট বাদ নেই যাদের আমরা অনুরোধ করিনি। আমাদের একজনকেও যেন তাদের সঙ্গে বোটে নেয়।
অবস্থা এত খারাপ যে জিরো পয়েন্ট থেকেই বড় নৌকা ছেড়েছে সব জায়গায়। সবাই চাচ্ছে, যেকোনোভাবে তার পরিবারের খোঁজটা পেতে। এদিকে পুরো ফেনী ব্ল্যাকআউট, সবাই ছুটছে।
ফেনী শহরের ৫০ শতাংশ তখনো ডুবেনি। কিন্তু সন্ধ্যা হতে না হতেই এত পানি ঢুকছে যে ৯০ শতাংশ পানির নিচে ছিল এবং বুক ও গলাসমান পানি। কেউ বাসা থেকে মুভ করারই সময় পায়নি। এটা অকল্পনীয় ও অবাস্তব একটা বিষয় ছিল।
বন্ধু একটি নৌকা ম্যানেজ করেছে। নৌকাটি যানজটের কারণে ফেনীতে ঢুকতে পারছে না, তাই সে নিশ্চিত করল নৌকা লালপোল থেকে নামাবে। তার কাছে গুগল ম্যাপ ডাউনলোড আছে। সময় রাত সাড়ে ১১টা। যাদের কাছে নৌকা ছিল তারা বলল, নিজেদের জন্য দুই দিনের খাবার নিয়ে নৌকার দিকে চলে আসতে।
আমি সকালে যে অবস্থা দেখছি, তাকে বারবার বোঝানোর চেষ্টা করছি, এটা চরম রিস্ক। কিন্তু ও যাবেই। পরে খাবার কেনার জন্য বাসা থেকে টাকা আনতে গিয়ে সে আধা ঘণ্টায়ও আসেনি। যোগাযোগ করা যাচ্ছিল না, তাই আমরাও বাসায় চলে যাই।
সারা দিন বাসায় ছিলাম না। রাতে বাসায় এসে দেখি চারপাশ পানির নিচে, হাজারো মানুষ রাস্তায়। গ্রামের দিকের সবাই চলে এসেছে গরু ও ছাগল নিয়ে। এ দৃশ্য একদম অচেনা। আমাদের ভবনে অনেক মানুষ আশ্রয় নেয়। রাস্তায় গাড়িতে শুধু নৌকা ঢুকছিল, এ কেমন দৃশ্য!
পরে জানতে পারি, আমাদের একজনকে দিবাগত রাত দেড়টায় ম্যাসেজে জানিয়েছে নৌকা ম্যানেজ হয়েছে আরেকটা ট্রাংক রোড থেকে। ও এখন চলে যাচ্ছে...
গত চার থেকে পাঁচ দিন তার আর খোঁজ নেই। তার বাসায় কান্নাকাটি। বিষয়টি অনেক কমপ্লিকেটেড ছিল; যেহেতু নৌকা নিয়ে যায়, তাহলে ফিরে আসেনি কেন? অনেক চিন্তাই মাথাই আসছিল। সাঁতার পারত না, তাই আমাদের চিন্তাও বাজে ছিল। তাকে খোঁজার জন্য আজ আমাদের রওনা দেওয়ার কথা ছিল। কিন্ত গতকাল রাতেই তার কল আসে, ওখানে আটকে গেছে। ওর বোনের সঙ্গে ওখানেই আছে, আলহামদুলিল্লাহ।
আর ওই দিন—বৃহস্পতিবার রাতেই প্রথম ঘটনার বন্ধুর নানা-মামাদের উদ্ধার করা হয় চট্টগ্রাম থেকে বোট আসার পর।
এই চার দিন বছরের সমান ছিল। বাকি দিনগুলো নিয়েও সময় হলে বলা হবে। তবে শুনেছি, বন্যা–পরবর্তী সময় নাকি আরও খারাপ হয়। ইয়া আল্লাহ, সহায় হোন।
যাঁরা ফেনীর মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন, আপনাদের কাছে চিরকৃতজ্ঞ।
*লেখক: ইফতেখায়রুল ইসলাম মুন্না, ফেনী
**নাগরিক সংবাদে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]