অদেখা প্রহর

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

আফজাল সাহেব বেশ কিছুক্ষণ ধরে বসার ঘরের সোফায় নিঃশব্দে বসে আছেন। চারপাশে লোকজনের আসা-যাওয়া, তাদের কথাবার্তার টুকরো টুকরো শব্দ, ফোনের রিংটোন—সবকিছুই যেন এক অদ্ভুত অস্পষ্টতায় জড়ানো। দূরের কোনো ছায়াময় বাস্তবতা। তিনি ঠিক বুঝে উঠতে পারছেন না, ঠিক কী ঘটেছে। মাথায় ঝাপসা একটা স্মৃতি ভাসছে—ফজরের আজান দেওয়ার আগেই ঘুম ভেঙেছিল তার। প্রতিদিন তার ছেলের বউ এসে তাকে তুলে দিয়ে যায়। আজও এসেছিল সে, তবে আজ কোনো ডাক দেয়নি।

কী যেন ভুলে যাচ্ছেন! কোনো কিছুই স্পষ্ট নয়। যে জীবন এতদিন ধরে তার নিয়মিত ছিল, আজ যেন সেটা কোথাও থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।

এখন প্রায় সকাল ৯টা বাজে। প্রতিদিন সকাল ৮টার মধ্যে আফজাল সাহেবের টেবিলে চা দিয়ে যায় নিলু, তার ছেলের বউ। বছর দুই-এক আগে নিলুর সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল তার ছোট ছেলের। আজকে এখনো পর্যন্ত নিলু চা দেয়নি। এমনকি কাজের মেয়ে ফাতেমাও চা আনেনি। তিনি দু’বার ডেকে ছিলেন, কিন্তু কারো কোনো সাড়া নেই।

অসন্তুষ্ট মনে চেয়ার থেকে উঠে টেবিলের দিকে গেলেন। আজকের পত্রিকাটাও নেই। অথচ ফাতেমা প্রতিদিন সকালেই পত্রিকা টেবিলে রেখে যায়। আজ যেন চারপাশের সবকিছুই কেমন অদ্ভুত লাগছে তাকে। রান্নাঘরের কোণ থেকে একসময় কান্নার আওয়াজ এল। তিনি কৌতূহলী হয়ে সেখানে গেলেন। ফাতেমা চুপ করে রান্নাঘরের কোণে বসে কাঁদছে। ব্যাপারটা কী, কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছেন না। সারা বাড়িটা আজ যেন একটা অজানা শূন্যতায় ডুবে আছে।

তার ছেলে শরিফুল ফোনে বারবার কারো সঙ্গে কথা বলছে, তার কথাগুলো উদ্বেগের—‘ভাইয়া, আজ সকালে ফাতেমা এসে বাবাকে ডাকতে গিয়ে এই অবস্থায় পেয়েছে। আমি এখন দেখছি এখানে কী অবস্থা।’ পাশে দাঁড়িয়ে আছে নিলু, নিলু মাঝে মাঝে তার চোখের জল মুছছে, তার চেহারায় অস্থিরতা—কিছু যেন চেপে বসেছে তার উপর।

আফজাল সাহেব অবাক হয়ে লক্ষ্য করছেন, বাড়ির সবাই তার ছেলের কাছে এসে কেমন উৎকণ্ঠা নিয়ে কথা বলছে। ‘এভাবে কেন সবাই এত চিন্তিত?’—তিনিও বুঝতে চাইছেন, কিন্তু কিছুতেই মাথায় আসছে না।

এখন প্রায় বেলা ১১টা। আফজাল সাহেব প্রতিদিন এই সময় গোসল করেন। নিলু প্রতিদিনের মতো আজও গরম পানি রেডি করেছে। কিন্তু পুরো বাড়িতে একটা অদ্ভুত অস্বস্তি ছড়িয়ে আছে। তার মনে হলো, বাড়িতে এত মানুষের আনাগোনা, অথচ কেউই তার দিকে একবারও তাকাচ্ছে না। কেউ তার সঙ্গে কথা বলছে না।

আফজাল সাহেব রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসে ধীরে ধীরে ঘরের ভিতরে হাঁটতে থাকলেন। হঠাৎ তার নজর গেল ঘরের এক কোণে রাখা কাঠের খাটিয়ার দিকে। খাটিয়ার উপর ঢাকা একটি মৃতদেহ। তার চোখ বড় বড় হয়ে উঠল—এটা তার নিজের দেহ! তার শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। তিনি গত রাতে মারা গেছেন, আর এই বাড়ির সবাই তার মৃত্যুর জন্য শোক করছে।

ধীরে ধীরে তার মনে পড়তে লাগল—রাতের সেই অন্ধকার মুহূর্তে নিলু এসে তার মুখের উপর বালিশ চেপে ধরে রেখেছিল। কিছুতেই সে কথা বলতে পারেননি। এখন তিনি বুঝতে পারছেন, তিনি মারা গেছেন, আর নিলু যেন সেই গোপন অপরাধের ভার বইছে। বাড়ির সবাই তার শোক প্রকাশ করছে কিন্তু কেউ জানে না কীভাবে আফজাল সাহেবের মৃত্যু হয়েছে।

এখন নিলু সামনে দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু তার ভেতরে আতঙ্ক আর অপরাধবোধ লুকানো। তার চোখে অনবরত জল ঝরছে, কিন্তু কেউ তার আসল অপরাধ বুঝতে পারছে না। সে যেন তার আত্মার দিকে তাকিয়ে, আফজাল সাহেবের কাছে প্রমাণ করতে চাইছে যে সে অপরাধী নয়।

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

একদিন বিকেলে,

বৃষ্টির ধারা ধীরে ধীরে বাড়ছে। নিলু জানালার বাইরে তাকিয়ে দেখতে পাচ্ছে রাস্তার বাতিগুলো বৃষ্টির ফোঁটায় ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। শরিফুল আজও অফিস থেকে ফিরতে দেরি করছে। এ সময়ে বেশিরভাগ দিনই সে ফিরত, কিন্তু আজ বৃষ্টির জন্য হয়তো কিছুটা দেরি হচ্ছে। নিলুর মনের মধ্যে একটা অজানা অস্থিরতা।

ঘরের ভেতর সবকিছু নীরব। হঠাৎ করেই জানালার কাঁচে এক ঝাপটা বাতাসের আঘাত লাগে। নিলু চমকে উঠল। ঘরের আলো মৃদু, ঘুমানোর প্রস্তুতি নিয়ে বিছানায় শুয়ে আছে। কিন্তু কেন যেন আজ তার চোখে ঘুম আসছে না। চারপাশে যেন একটা অদ্ভুত অনুভূতি। মনে হচ্ছে, কিছু একটা ঠিক নয়।

কিছুক্ষণ পর তার নজর পড়ল জানালার দিকে। জানালার পর্দা একটু সরে আছে। হঠাৎ করে সেখান দিয়ে সে দেখতে পেল একটা ছায়া। অন্ধকার ঘরটা হঠাৎ করে আরও ঠাণ্ডা হয়ে গেল। বাতাসের শব্দে যেন কেমন এক শিরশিরে অনুভূতি ছড়িয়ে পড়ল তার শরীরে। নিলু কিছু বুঝে ওঠার আগেই একটা শীতল অনুভূতি তাকে ঘিরে ফেলল।

সে ধীরে ধীরে উঠে বসে। তার চোখ ধীরে ধীরে মানিয়ে নিলো অন্ধকারের সঙ্গে। তার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে আফজাল সাহেব—একদম স্পষ্ট, অথচ তিনি যে আর বেঁচে নেই, সেটা নিলু জানে। তবু আজ তিনি যেন জীবিত।

‘সবকিছু কি এত সহজে শেষ হয়, নিলু?’ আফজাল সাহেবের গলায় হালকা বিদ্রূপ।

নিলু কথা বলতে চাইল, কিন্তু তার গলা শুকিয়ে গেছে। এক ফোঁটা শব্দও বের হলো না। আফজাল সাহেব ধীরে ধীরে তার দিকে এগিয়ে আসছেন। নিলুর শ্বাস যেন আটকে আসছে, চারপাশের বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে। তার সমস্ত শরীর অবশ হয়ে গেছে।

আফজাল সাহেব আবার বললেন, ‘সবকিছুর একটা শেষ আছে, নিলু। কিন্তু সেটা কীভাবে হবে, সেটা আমি ঠিক করে দেব।’

নিলু কিছু বলতে পারছে না, তার চোখের সামনে ভেসে উঠছে সেই রাতের স্মৃতি—যখন সে আফজাল সাহেবের মুখে বালিশ চেপে ধরেছিল। মুহূর্তের জন্য সবকিছু থমকে গেল, তারপর আবার ঘরের সমস্ত আলো নিভে গেল।

নিলু বিছানায় চুপচাপ বসে রইল। জানালা দিয়ে হালকা বৃষ্টি পড়ার শব্দটা আবার স্পষ্ট হলো। কিন্তু আফজাল সাহেব কোথায়? সবকিছু কি সত্যিই ঘটেছিল, নাকি সেটা কেবল তার মনের খেলা?

ঘরের নীরবতা ভেদ করে ঘড়ির টিকটিক আওয়াজ ভেসে আসছে।

লেখক: কে এম ফারহাত স্নিগ্ধ, সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার, ঢাকা