নয়া বউ
আম্মা এক ভাবিকে আমার জন্য মেয়ে দেখতে বলেছেন। ভাবি এই দায়িত্ব পেয়ে মহাখুশি। খুশির কোনো অন্ত নেই। ভাবি আমাকে চুপিচুপি ডাকল। আমি দোতলার বারান্দা থেকে হাত নেড়ে জানান দিলাম, আছি।
মেয়ের ফটো দেখিয়ে বলল, এই তুই নিচে আয়। তোর সঙ্গে প্রাইভেট কথা আছে।
আমি এক মুহূর্ত দেরি না করে সিঁড়ি ভেঙে তরতর করে নিচে নেমে এলাম। ইচ্ছা করছিল দোতলা থেকেই লাফ দিই। পরে ভাবলাম আমার কিছু হয়ে গেলে মেয়েটার কী দশা হবে!
ভাবি বলল, নাদিম দ্যাখ, মেয়ে ঠিক আছে কি না। আমি মাথা থেকে পা পর্যন্ত দেখলাম। নাহ, মেয়ে মাশা আল্লাহ যথেষ্ট সুন্দরী। চুলগুলো বেশ বড়সড়। চোখ দুটিও গরুর চোখের মতো টানা টানা। ঠোঁট দুটি গোলাপের পাপড়ির মতো পিনপিনে। সবই তো ঠিক আছে ভাবি, দাঁত তো দেখলাম না। দাঁতের ছবি নাই? দাঁত বড় না ছোট।=
ভাবি ছবিটা আমার হাত থেকে বাজপাখির মতো ছোঁ মেরে নিয়ে বলল, এইটা আমার বোন। পছন্দ হয়েছে কি না আগে ক। দাঁত বিয়ের পরও দেখা যাবে। ওটা কোনো বিষয়ই না।
আমি নিরাশ হয়ে বললাম, পছন্দ হয়েছে। কিন্তু...
কোনো কিন্তুটিন্তু নাই। পছন্দই সবচেয়ে বড় জিনিস। আমি তাহলে কথা পাকা করে ফেলি?
এখনই? পরিবারের আরও তো সদস্য আছে। ওদের সঙ্গে আলোচনা–সমালোচনা করতে হবে না?
বিয়ে করবি তুই। পরিবারের সঙ্গে আলোচনা করার দরকার কী? তা ছাড়া তোর ভাইকে যা বোঝানোর আমি গতকাল রাতেই বুঝিয়ে ফেলেছি।
আমি একটু ট্যারা চোখে তাকালাম। তাকিয়ে বললাম, আয় হায়, তাহলে তো কাম আরেকটা হয়ে গেছে।
কী কাম?
আপনে ভাইয়াকে যখনই কোনো বিষয়ে বোঝাতে যান, তার কিছুদিন পরই আমাদের ভাইস্তে–ভাস্তির আগমনের খবরটবর চলে আসে। এই টেকনিকটা আমি আজও বুঝলম না ভাবি। কাহিনি কী?
ভাবি অন্যদিকে ফিরে ঠোঁটের কোণে দুষ্ট হাসি ঝুলিয়ে বলল, যাহ, দুষ্টু কোথাকার!
পরদিন পাত্রীর বাড়ি থেকে দাদিশাশুড়ি আমাকে দেখতে এলেন। বাজার-সদাই দেখে মনে হচ্ছে বিয়ে হয়ে যাবে হয়তো। আমি আমার রুমে অন্যদিকে ফিরে জামা আয়রন করছি। দাদিশাশুড়ি দরজা ধরে দাঁড়িয়ে বললেন, ওগো নওশা, মুখটা একটু ফিরাও, তোমারে একটু দেহি।
আমি ঘুরে দাঁড়ালাম।
ছেলে তো মাশা আল্লাহ খুবই সুন্দর। আমগো নাতনির লগে মানাইব!
হাতে পাঁচ শ টাকার একটা ছেঁড়া, তেলতেলে নোট ও পাঁচ টাকার একটা শেখ মুজিবমার্কা কয়েন ধরিয়ে দিলেন। আমি নিতে চাচ্ছি না, জোর করে দিয়ে বললেন, মুরব্বিরা এসব দিলে নিতে হয়। এটা হইল গিয়া মুরব্বিদের দোয়া।
আমি কিছু বোঝার আগেই রুম থেকে বের হয়ে গেলেন।
এ রকম দোয়া কে না চায়! আমি বারবার দেখতে লাগলাম। দোয়ার এপিঠ-ওপিঠ। নাহ, জাল টাকা না। পাঁচ শ টাকার রহস্য খুব সহজে বুঝতে পারলাম। কিন্তু পাঁচ টাকার রহস্য বুঝতে পারলাম না। থাক, সবকিছু বোঝার দরকারও নেই।
বিকেলে ভাইয়া বাসায় এল। হাত পেতে টাকা চাইল। আমি ওয়াক থু আওয়াজ করলাম। ভাইয়া দ্রুত হাত সরিয়ে ফেলল।
বললাম, কিসের জন্য হাত পেতেছ?
ট্যাকা দে।
কিসের ট্যাকা?
দুপুরে এক ভদ্রমহিলা তোরে জোর করে দিয়ে গেল যে, ওই ট্যাকা। তাড়াতাড়ি দে।
ওই ট্যাকা আমি তোমারে দিমু ক্যান? আমারে দেখতে এসেছিল, খুশি হয়ে দিয়ে গেছে।
বকশিশ দে কিছু ট্যাকা!
আমি মুখের ওপর বললাম, জি না, ভাইজান।
দিবি না?
নাহ!
আরেকবার চাইব, দিবি না?
একবার না বললাম, নাহ!
বিয়ে তাইলে তুই একাই কর। আমিও নাই তোর ভাবিও নাই।
আম্মা...ভাইয়া খালি কানের কাছে কী যেন বলে!
এই না না, থাম। আমি চলে যাচ্ছি। ছাগলের মতো আর ভ্যা ভ্যা করিস না।
আম্মা...
আম্মা রান্নাঘর থেকে চেঁচিয়ে বলল, এই কী হয়েছে তোদের? এত জ্বালাতন সহ্য হয় না। দুজনকে কিন্তু ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দেব, মনে রাখিস কইলাম!
ভাইয়া আর কোনো কথা বলল না। বিড়ালের মতো নিঃশব্দে চলে গেল।
আমি শব্দ করে হা হা করে হেসে উঠলাম।
আমি কখনো কোনো মেয়ের দিকে তাকাইনি। সামনে বসা যে মেয়েটি বসে আছে সে আমার হবু বউ। হবু বউ বলা হয়তো ঠিক হচ্ছে না। এখনো আমাদের বিয়ে হয়নি। এর মধ্যে বউ বলার অধিকারও আমার নেই। তবে কথাবার্তা সব শেষ। সবাই দেখে ফেলেছে, শুধু আমিই দেখিনি। বাসায় মন খারাপ করে বসে আছি দেখে দাদি এসে বলল, চল নাদিম, বউ দেখায়ে নিয়ে আসি, মন ভালো হয়ে যাইব। আমি উদাস হয়ে দাদিকে বললাম, দাদি, বউ আমার, অথচ আমিই দেখলাম না। হায়রে কপাল।
আমরা মুখোমুখি বসে আছি। কেউ কোনো কথা বলছি না। অনেক কিছু জিজ্ঞেস করব বলে ইয়া বড় লিস্ট জামার পকেটে রেখে দিয়েছিলাম। কিন্তু দাদি এত তাড়াহুড়া করে নিয়ে এল যে ওই জামাটাই পরতেই ভুলে গেছি। কী কী জিজ্ঞেস করব, সবকিছু মনে মনে গুছিয়ে নিচ্ছি।
এমন সময় পেছন থেকে দাদিজান কানে কানে ফিসফিস করে বলল, এই গাধা, তুই তোর দাদার মতো ভিজে দরবেশ হলি কবে থেইক্কা? প্রথম যেদিন আমাকে তোর দাদা দেখতে এল, আমার দিকে ফিরেও তাকাল না। আমি ফ্যালফ্যাল করে তাকাই রইলাম। মানুষটারে একপলক দেইখেই মনে ধরে গেল। উনি একটাবারও তাকাল না দেখে আমার মনটা ভেঙে গেল। আঁচলে মুখ ঢেকে শব্দ করে কাঁদতে কাঁদতে বললাম, আমি বিয়েই বসব না!
আমার কান্না দেখে তোর দাদাজান অবাক হয়ে তাকাল। আমি সোফা থেকে উঠে বললাম, আমি একেই বিয়ে করব।
‘কী লজ্জার কথা, ক? নাদিম, এই নাদিম, দ্যাখ না একটু!’
আমি লজ্জায় মরে যাচ্ছি। বুড়ি কী বলে! আমি তাকাই, সেও তাকায়। আমি চোখ বুঝে ফেলি সেও বুজে ফেলে। দুজন চুপচাপ বসে আছি। কেউ কারও দিকে তাকাচ্ছি না। দাদিজান ওদের বাড়ির আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে এটা-সেটা নিয়ে কথা বলছে। আমি এই ফাঁকে তাকিয়ে দেখি সেও তাকিয়ে আছে। চোখে চোখ পড়তেই দুজনেই শব্দ করে হেসে উঠলাম!
দাদিজান বলল, তোরা নিজেরাই তো কাম সাইরে ফেললি। কবুলের জন্য আর আলাদা তোষামোদ করা লাগব না। যাক, বাঁচা গেল।
ফুলশয্যার রাত। মেহেরুন লম্বা ঘোমটা টেনে বসে আছে খাটে। নাদিম খাটের এক কোণে বসে বলল, বসতে পারি?
মেহেরুন নিচু স্বরে বলল, বসেই তো পড়েছেন। আবার নতুন করে অনুমতি নেওয়ার কী আছে!
আমাকে কিছু বললেন?
‘নাহ, আপনাকে না, আরেকজনকে বলেছি।’
নাদিম আশপাশে চোখ ঘুরিয়ে আরেকটু কাছে আসার চেষ্টা করল। মেহেরুন মুচকি হেসে দূরে সরে গেল।
নাদিম বোকার মতো হাসতে হাসতে বলল, জীবনের প্রথম বিয়ে তো, এই জন্য একটু নার্ভাস লাগছে। এ নিয়ে তুমি চিন্তা কইরো না। দুয়েকবার বিয়ে করলে অবশ্য নার্ভাসটা কেটে যাবে।
এই কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে মেহেরুন সাপের মতো ফণা তুলে ফুঁস করে উঠল।
‘কী কন, আপনে আরও বিয়ে করবেন? তওবা তওবা।
‘না মানে...নার্ভাসটা দূর করার জন্য চাইছিলাম আরকি!’
চারদিকে পিনপতন নীরবতা বিরাজ করছে। দূরে কোথাও একটা রাতজাগা পাখি বিরামহীন ডেকে যাচ্ছে। ঘরের পেছনের পেয়ারার গাছটার ডাল ভেঙে পড়ার শব্দ হলো।
মেহেরুনের একটু ভয় ভয় লাগল।
নাদিম বলল, মেহেরুন, আমি কি তোমার হাতটা একটু ধরতে পারি?
কপাল ভাঁজ করে বলল, ছি ছি, এসব কী বলছেন, মেয়ে লোকের হাত ধরা ঠিক না। আমি আপনারে কত ভালো ভাবতাম, আর আপনি কি না...
‘আজ তো ফুলশয্যার রাত। তাই ভাবছিলাম...’
মেহেরুন লাফ দিয়ে উঠে বলল, কী ভাবছিলেন? চাঁদের কথা? চাঁদ দেখতে যাবেন? চলুন, চাঁদ দেখে আসি?
নাদিম হাসি হাসি মুখ করে বলল, আপনি ঘরে থাকতে, আমি বাইরের চাঁদ দেখতে যাব কোন দুঃখে?
আহা, আপনি কত সুন্দর করে কথা বলেন।
আচ্ছা, আমাকে একটা গল্প শোনান। আমার না খুব ঘুম পাচ্ছে!
আজ তোমার ঘুম পাচ্ছে? আজ না আমাদের ফুলশয্যার রাত।
ওমা, এটা কেমন কথা! মানুষের কী ঘুম পেতে পারে না? তা ছাড়া আমি শুনেছি ফুলশয্যার রাতে জেগে থাকা মহাপাপ।
কে বলেছে?
আমি!
আমিটা কে?
আমি আপনি, আপনি আমি! হি হি হি হি।
দুজনেই হাসল।
মেহেরুন হাসি থামিয়ে বলল, একটা গল্প বলেন শুনি।
মাথায় কোনো গল্প নেই!
তাহলে আমি ঘুমিয়ে পড়ি, হ্যাঁ?
না না, বলছি...
এক দেশে ছিল এক রাজা। রাজার একটা রাজকন্যা ছিল। দেখতে ভারি মিষ্টি। সেই রাজকন্যা দেখতে দেখতে হঠাৎ বড় হয়ে গেল। রাজা রাজকন্যাকে বিয়ে দিলেন পাশের রাজ্যের রাজকুমারের সঙ্গে। তারপর একদিন...
এই মেহেরুন, ঘুমিয়ে গেলে?
ডান হাতের উল্টো পিঠ মুখে রেখে লম্বা একটা হাই তুলে বলল, হুম।
তারপর শোনো না কী হলো!
শুনছি তো।
তারপর একদিন... আহা, আবার ঘুমিয়ে গেলে?
মেহেরুন কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, আপনে এত কথা বলেন ক্যান, হ্যাঁ? আমারে একটু শান্তিতে ঘুমাতেও দিবেন না? ঘুমানোর জন্য বিয়ে বসতে রাজি হলাম। আর এখানে এসে ঘুমোতেই পারছি না। ঘুম বাদ দিয়ে সারা রাত গল্প করে সময় নষ্ট করা ঠিক হবে কন? কাল সকালে আপনার সব গল্প শুনব। এখন ঘুম পাচ্ছে, একটু ঘুমাই, প্লিজ?
মেহেরুন গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল। নাদিম তার দিকে তাকিয়ে হাসল। জানালা গলে চাঁদের আলো এসে পড়ছে মেহেরুনের মুখে। ভীষণ মিষ্টি লাগছে তাকে। যেন একটা হালকা হাসি ওর চোখ-মুখ জুড়ে বিস্তৃত হয়ে আছে। ঘুমন্ত মেহেরুনকে এখন নাদিমের কাছে সেই গল্পের রাজকন্যার মতো লাগছে!