যাত্রাপথের গল্প

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

কলেজে যাচ্ছিলাম। বাসা থেকে কলেজের দূরত্ব অনেক। এ জন্য আগে বের হতে হয়। বাসা থেকে অটোরিকশায় করে বাসস্ট্যান্ডে এসে পৌঁছালাম। এমনিতেই আজ দেরি হয়ে গিয়েছে; তার ওপর আজ বাস পাচ্ছি না। অনেকক্ষণ পর সিএনজিচালিত একটি অটোরিকশা পেলাম। চালকের মুখটা দেখে পরিচিত মনে হলো। যতটা মনে হচ্ছিল, কোনো ব্যানার-ফেস্টুনে দেখেছি! আমার হাতে সময় নেই, তাই কোনো কিছু না ভেবেই উঠে পড়লাম। চালক সাহেবের পাশে সামনে বসতে হলো আমাকে।

গাড়ি স্টার্ট দেওয়ার সময়ই স্ট্যান্ড থেকে একজন চালক সাহেবের উদ্দেশে সিলেটের আঞ্চলিক ভাষায় বললেন, ‘মেম্বার নি বা? ভালা আছোনি?’ (মেম্বার সাহেব নাকি? কেমন আছেন?) চালক জবাব দিলেন, ‘আছি ভালাউ’। স্ট্যান্ড থেকে তখন আরেকজন বলে উঠলেন, ‘মেম্বার অইয়া সিএনজি চালাইতরায়, ইতা তো ঠিক নায়’ (মেম্বার হয়ে সিএনজি চালাচ্ছ, এটা তো উচিত নয়) আমি চালক সাহেবের মুখে বিরক্তির রেখা দেখতে পেলাম, তিনি বললেন, ‘ভাই, আমার পরিবার চালাইতে অইবো তো’ (ভাই, আমার পরিবার চালাতে হবে তো) বলেই তিনি আর কোনো কথা না বলেই গাড়ি চালাতে শুরু করলেন! চালক সাহেব অপর পাশের যাত্রীর উদ্দেশে বললেন, ‘বুচ্চইননি ভাই, ইবার ভোটও মাইনষে আমারে মেম্বার বানাইছইন। আমি গরিব মানুষ! আমার পরিবার বড়, অউ ইউনিয়নও যেদিন কাম থাকে না, এদিন সিএনজি চালাই, চাইলে তো ইউনিয়ন ওর ওতা হতাত মাইনষর নাম হারাইয়া দিয়া টেখা নিতে পারি, আমি আমার হরুতারে হারাম খাওয়াইতে চাই না। এরবাদে আমার আল্লায় তো আমারে দেখরা। আমি সিএনজি ড্রাইভার মানুষ, মাইনষে তারার সেবা করার সুযোগ দিছে, আমিও চেষ্টা করি মাইনষর সেবা করার। বউ সিএনজি চালাই দেখিয়া আমারে লইয়া হাসে আর কয়, তুমি মেম্বার মানুষ, সিএনজি চালাও কেনে? আমি কাম করিয়া খাই ভাই। আর কাম করাত কোনো শরম নাই!

(বুঝেছেন ভাই, আমার পরিবার বড়, আমি সিএনজি চালিয়ে পরিবার চালাই, যেদিন ইউনিয়নে কাজ থাকে না, সেদিন সিএনজি চালাই। চাইলে বিভিন্ন তালিকায় মানুষের নাম ঢুকিয়ে আমি ঘুষ খেতে পারি, কিন্তু আমার সন্তানদের হারাম খাওয়াতে চাই না। আমার আল্লাহ তো সব দেখছেন, মানুষ আমাকে তাদের সেবা করার সুযোগ দিয়েছে, আমি  তাদের সেবা করার চেষ্টা করি। অনেকে সিএনজি চালাই দেখে বিদ্রূপ করে, আমি কাজ করে খাই ভাই, আর কাজ করে খেতে কোনো লজ্জা নেই।)

চালকের কথাগুলো আমি মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনছিলাম!

কত সুন্দর কথাগুলো! কী সুন্দর মনস্তাত্ত্বিক ভাবনা! আত্মসম্মানের প্রতি কত যত্নশীল তিনি। চালকের এ কথাগুলো আমার হৃদয় ছুঁয়ে গেল! ভাবলাম, পৃথিবীর সব মানুষের মানসিকতা যদি এমন সুন্দর হতো! ভাবতে ভাবতেই দেখি কলেজের সামনে চলে এসেছি। গাড়ি থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে এক অন্য রকম ভালো লাগা নিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম ক্যাম্পাসের দিকে!

*লেখক: মো.আবীর আল নাহিয়ান, শিক্ষার্থী, মালিক নাহার মেমোরিয়াল একাডেমি, সিলেট