করোনা মহামারি-পরবর্তী বাস্তবতায় পৃথিবীতে নতুন সমাজব্যবস্থা তৈরি হচ্ছে। নতুন নতুন বিষয়কে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রার পরিপ্রেক্ষিত ও প্রভাবকে আরও গভীর থেকে বিশ্লেষণের চেষ্টা করা হচ্ছে। এখনো মানবস্বাস্থ্য ও সামাজিক স্বাস্থ্য কাঠামোর শক্তিশালীকরণ নিয়ে নানা ধরনের কাজ চলছে সারা বিশ্বে। তারপরও বিভিন্ন প্রাচীন রোগ, যা ৫০ বছর আগে পৃথিবীতে প্রভাব রাখে, আজও সেসব রোগের প্রভাব আমরা দেখতে পাই। এমনই একটি রোগের নাম যক্ষ্মা। বিশ্ব যক্ষ্মা দিবস উপলক্ষে স্টপ টিবি পার্টনারশিপের সহযোগিতায় আইসিডিডিআরবি ও প্রথম আলোর আয়োজনে ‘বিশ্ব যক্ষ্মা দিবস: যক্ষ্মা ও জনস্বাস্থ্য উন্নয়নে বেসরকারি অংশীদারত্ব’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে ২৩ মার্চ ২০২৪ তারিখে তরুণেরা নিজেদের ভাবনার কথা প্রকাশ করেন।
ঝুঁকির মধ্যে বাংলাদেশ
বাংলাদেশসহ বিশ্বের ৩০টি দেশে এখনো সাধারণ মানুষের জনজীবনে আতঙ্কের নাম যক্ষ্মা। বিশ্বের শীর্ষ ও অন্যতম সংক্রামক রোগ হিসেবে যক্ষ্মায় এখনো অনেক মানুষ মারা যাচ্ছেন। ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি থাকার পরও বিশ্বের যে ৩০টি দেশে যক্ষ্মারোগী বেশি, বাংলাদেশ তার মধ্যে রয়েছে। আইসিডিডিআরবির সহকারী বিজ্ঞানী ডা. শাহরিয়ার আহমেদ বলেন, বাংলাদেশে যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণে নানা ধরনের সাফল্য আছে। যদিও সাধারণ মানুষের অসচেতনতা ও কার্যকর চিকিৎসা গ্রহণ না করার কারণে যক্ষ্মা এখনো বড় একটি জনস্বাস্থ্য সমস্যা। এখনো প্রতিবছর বহু মানুষ যক্ষ্মায় আক্রান্ত হচ্ছেন এবং মারাও যাচ্ছেন। পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতে যক্ষ্মারোগী শনাক্ত ও চিকিৎসার আওতায় আনা এবং জনসচেতনতা বাড়াতে হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী, বাংলাদেশে ২০২২ সালে আনুমানিক ৩ লাখ ৭৯ হাজার মানুষ যক্ষ্মায় আক্রান্ত হন এবং ৪২ হাজার মানুষ যক্ষ্মায় মারা যান। সাধারণ মানুষের অসচেতনতার কারণে এখন ৩১ শতাংশ ব্যক্তি রোগ শনাক্তের বাইরে রয়ে যায় এবং এমডিআর টিবি আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে প্রায় ৩ হাজার ৫০০ জন শনাক্ত হচ্ছেন না।
জনস্বাস্থ্য গবেষক রুবিনা হক বলেন, ‘যেকোনো রোগের ক্ষেত্রে ভয়াবহতার কথা যদি সমাজে ছড়িয়ে দেওয়া যায়, তা হলে সে রোগ নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হয়। আমি বিশ্বাস করি, প্রতিরোধের চেয়ে প্রতিকার উত্তম। এখন তরুণসমাজ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোয় বেশ সক্রিয়। সে ক্ষেত্রে তরুণ প্রতিনিধি যাঁরা আছেন, তাঁদের মাধ্যমে যদি কোনো সহায়ক প্রকল্প নেওয়া যায়, সেটি কাজে দেবে।’
সচেতনতা এখনো কম
চিকিৎসার সুযোগ বাড়লেও মানুষ সহজে যক্ষ্মা পরীক্ষা করান না। পরিস্থিতি অনেক খারাপ হওয়ার পর পরীক্ষা করাতে বা চিকিৎসকের কাছে আসেন। সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা বেশ কম বলা যায়। বিপদে না পড়লে মানুষ চিকিৎসা নিতে চান না। নিম্নবিত্ত ও খেটে খাওয়া মানুষের জন্য সচেতনতা কর্মসূচি অনেক কম। স্থপতি ফওজিয়া জাহান বলেন, ‘নির্মাণশিল্পের ক্ষেত্রে শ্রমিকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। তবে খুব অল্প কিছু প্রতিষ্ঠান এ কাজ করে। হিসাবে মাত্র ১০ শতাংশ প্রতিষ্ঠান। ব্যক্তিগতভাবে আমি যত দূর জানি, ৯০ শতাংশ ডেভেলপার প্রতিষ্ঠান শ্রমিকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করে না। তাদের সচেতন করার জন্যও কিছু করে না। এখানে অনেক বড় একটি গোষ্ঠী আছে, যারা কাজ হারানোর ভয়ে রোগের বিষয়টি প্রকাশ করে না। আমি মনে করি, এই জায়গায় কাজ করার অনেক সুযোগ আছে।’
চিকিৎসার সুযোগ বেড়েছে
সাধারণভাবে বলা হয়, দুই কারণে ওষুধপ্রতিরোধী যক্ষ্মায় মানুষ আক্রান্ত হন। প্রথমত, যক্ষ্মায় আক্রান্ত ব্যক্তি যদি নিয়মিত সঠিক মাত্রায় পূর্ণ মেয়াদে ওষুধ সেবন না করেন, ব্যক্তির শরীরে থাকা জীবাণু ওষুধপ্রতিরোধী হয়ে ওঠে। দ্বিতীয়ত, ওষুধপ্রতিরোধী জীবাণু সরাসরি অন্য ব্যক্তির শরীরে যেতে পারে। আগে যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়ে এখন সুস্থ আছেন চিকিৎসক ডা. শারমিন আহমেদ। তিনি বলেন, ‘যক্ষ্মা শুধু নিম্নবিত্ত পর্যায়ে হয়, বিষয়টি ঠিক তা নয়। আমি নিজেও যক্ষ্মারোগী ছিলাম। আমি ভালো পরিবেশে বড় হয়েছি। আমারও কিন্তু যক্ষ্মা হয়েছিল। সুতরাং যক্ষ্মা শুধু নিম্নস্তরেই হয়, তা ঠিক নয়। ২৪ বছর আগে আমি যক্ষ্মারোগে আক্রান্ত হয়েছিলাম। আমার চিকিৎসাপ্রক্রিয়ায় অনেক দেরি হয়েছিল। কারণ, আমি অনেক ছোট ছিলাম। আমার কফ ছিল না। ছোট ছিলাম বলে জোর করে কফ আনার বিষয়টিও সম্ভব ছিল না। সে সময় এখনকার মতো যথাযথ পরীক্ষার সুযোগ ছিল না। ফলস্বরূপ, অনুমাননির্ভর চিকিৎসা দিয়েই শুরু করতে হয়েছে। দেরি হওয়ার ফলাফল আমি এখনো ভোগ করি।’
তরুণদের ভূমিকা রাখতে হবে
কিছু মানুষের এখনো এই ধারণা আছে যে যক্ষ্মা শুধু ফুসফুসের রোগ। ২৫ শতাংশ যক্ষ্মা ফুসফুসবহির্ভূত। শহর ও গ্রামে রোগনির্ণয়ে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করা যাচ্ছে না। তরুণদের এ ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখার সুযোগ আছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সৈয়দ গিয়াস উদ্দীন বলেন, ‘ঢাকার বাইরে বিভিন্ন পর্যায়ের মানুষের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ আমার হয়েছে। আমরা অনেকে কী করতে হবে জানি, কিন্তু মানছি না। কিন্তু দুই-তৃতীয়াংশ শিশুর কথা বলা হচ্ছে, যারা আসলে জানেই না কী করতে হবে। ইউনিয়ন পরিষদ পর্যায়ে যে চিকিৎসাসেবার ব্যবস্থা রয়েছে, তা অপ্রতুল। যক্ষ্মার ক্ষেত্রে তো একেবারেই কম। আমি মনে করি, এখানে আন্তরিকতার অভাব রয়েছে। কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে উদ্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর মধ্যে বড় ঘাটতি রয়েছে। এটি মূলত আন্তরিকতার অভাবে হয়েছে। তরুণ সমাজ বড় ভূমিকা রাখতে পারে। কিন্তু কাজ করার জায়গাগুলো প্রস্তুত কি না, সেটিও দেখা প্রয়োজন।’
সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে
যক্ষ্মা সচেতনতার জন্য তরুণদের সচেতন করতে সরকারি সংস্থা, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, করপোরেট, উন্নয়ন সংস্থাসহ সবাই এক হয়ে কৌশলপত্র তৈরি করা প্রয়োজন। প্রযুক্তিনির্ভর সেবার মাধ্যমে তরুণদের সংযুক্ত করতে হবে। প্রযুক্তি-বিশ্লেষক ও আইসিটি ডিভিশনের এটুআইয়ের ন্যাশনাল কনসালট্যান্ট শাহরিয়ার হাসান জিসান বলেন, ‘ছোটবেলা থেকে শুনে এসেছি—“যক্ষ্মা হলে রক্ষা নাই, এ কথার ভিত্তি নাই।” এটি কিন্তু খুবই শক্তিশালী একটি বার্তা। এটি আশার বাণী। আমি মনে করি বিভিন্ন করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিজ্ঞাপনের মতো করে এ বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে পারে। এ ছাড়া টেলিকমিউনিকেশন কোম্পানিগুলোর কাছে অনেক মানুষের তথ্য আছে। তারা চাইলে এ ধরনের শক্তিশালী বার্তাগুলো মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে পারে। শিক্ষার যে মাধ্যমগুলো আছে, সেগুলোতে “কী মানতে হবে আমাদের”—এ বিষয়ে সচেতন করা জরুরি। কারণ, আগে আমাদের জানতে হবে। তারপর মানার প্রসঙ্গ আসবে।’
সামাজিক সচেতনতা প্রয়োজন
সামাজিকভাবে সচেতনতা গড়ে তোলার বিষয়টিকে গুরুত্ব দিচ্ছেন তরুণ পেশাজীবীরা। আইনজীবী নিশাত আনজুম বলেন, ‘প্রকৃত অর্থে আমাদের দেশে এখনো অনেক মানুষ জানেন না যে সরকার যক্ষ্মার চিকিৎসা বিনা মূল্যে দিচ্ছে। সরকারের সেবা বিষয়ে সারা দেশের মানুষের ধারণা কম, মানুষ নিজে থেকে জানতে চায় না। বেসরকারি খাতের প্রবৃদ্ধি বাংলাদেশে বেশি। এ ক্ষেত্রে প্রাইভেট হাসপাতাল-ক্লিনিক ও চিকিৎসকদের ভূমিকা বাড়ানো প্রয়োজন। আর্থসামাজিক পরিপ্রেক্ষিতে সচেতনতার ঘাটতি আছে বলে আমি মনে করি।’
করোনা-পরবর্তী বাস্তবতায় কাজ করতে হবে
একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় করোনা মহামারি-পরবর্তী নতুন আর্থসামাজিক ব্যবস্থায় যক্ষ্মার মতো রোগের বিরুদ্ধে যুদ্ধে বৈজ্ঞানিক গবেষক, বিনিয়োগ, সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ ও সামাজিক আন্দোলন ভীষণভাবে দরকার। প্রাতিষ্ঠানিক সচেতনতা বাড়ানোর পাশাপাশি চিকিৎসায় বড় আকারের বিনিয়োগ প্রয়োজন। বাংলাদেশের অনেক সাফল্য আছে স্বাস্থ্য খাত নিয়ে। এশিয়ার অন্যান্য দরিদ্র দেশে ও আফ্রিকায় আমরা সেই সব সাফল্য ছড়িয়ে দিতে পাড়ি।
লেখক: বিজ্ঞান লেখক ও জনস্বাস্থ্য অধিকারকর্মী