বিটিএসের গান ও আমাদের তরুণ-তরুণীদের ওপর এর প্রভাব

কোরীয় গানের দল বিটিএস
ছবি: সংগৃহীত

বিটিএস বর্তমানের আলোচনা-সমালোচনার প্রথম সারিতে। কিন্তু কেন এ সমালোচনা, সেটা একটু পরে বিশ্লেষণ করছি। তার আগে একটু বলি, গান, ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি—এগুলোর প্রতিটি বিষয় অঞ্চল ও ভৌগোলিকভেদে ভিন্ন। তারই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশেরও রয়েছে নিজস্ব মানসম্মত ও কাঠামোগত সংস্কৃতি। যেমন লোকগীতি, ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া, লালনগীতি, ইসলামি গজল, জারিগানসহ অসংখ্য দেশাত্মবোধক গান। বেড়ে ওঠার মধ্য দিয়ে নিজ নিজ দেশের সংস্কৃতি শ্রেষ্ঠ বলে বিবেচিত হয়। আমরা তো বাংলাভাষী মানুষ, সে ক্ষেত্রে বাংলা গান আমাদের কাছে অতুলনীয়।

এবার বলি বিটিএস নিয়ে। কিছুদিন আগে এক ভিডিওতে বিটিএস সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা পেলেও পরে তা বিস্তারিত জানতে পারি। বিটিএস ‘বাংতান বয়েজ’ নামেও বেশ পরিচিত, যা সাত সদস্যের সমন্বয়ে দক্ষিণ কোরিয়ান বয় ব্যান্ড। এই সাত সদস্যের ব্যান্ড বিগহিট মিউজিকের অধীন ২০১০ সালে ট্রেইনি হিসেবে এবং ২০১৩ সালে ‘২ কুল ৪ স্কুল’ অ্যালবাম নিয়ে পুরো বিশ্বের সামনে আত্মপ্রকাশ করে। তারা মূলত হিপহপ গানের গ্রুপ হলেও তাদের গানগুলোয় বিভিন্ন সংগীতের ধরন প্রকাশ পায়। আর এই বিটিএস ইতিমধ্যে সারা বিশ্বে জনপ্রিয়তা অর্জন করে নিয়েছে; বিশেষ করে বাঙালি তরুণ প্রজন্মের কাছে। কিন্তু বাঙালি তরুণ-তরুণীদের ওপর এই হিপহপ গান নেতিবাচক প্রভাব নিয়ে আসবে।

বিটিএসদের আর্মি নামেও ডাকা হয়। বাংতান বয়েজের সদস্যরা টুইটারে বেশি সক্রিয়। টুইটারে বিটিএস অনুসারীদের সংখ্যা ৩১ মিলিয়নের বেশি। ২০১৭ সালে তাঁরা গিনেস বুকে রেকর্ড করে তারকাদের মধ্যে সর্বোচ্চ রিটুইট পেয়ে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও সংগীত তারকা জাস্টিন বিবারের রিটুইটকে পেছনে ফেলে এই রেকর্ড করেন। তাই সবার দৃষ্টি পড়ে ব্যান্ডটির ওপর। সোশ্যাল আর্টিস্ট অ্যাওয়ার্ড পাওয়ায় তাদের সমালোচনা বেড়ে যায়। অন্যদিকে, টাইম ম্যাগাজিন আর ফোর্বসের তালিকায় ২০১৮ সালে ম্যাগাজিনটির নেক্সট জেনারেশন লিডারসের তালিকায়ও স্থান পায়।

২০১৯ সালে ব্ল্যাকপিংকের কাছে প্রথম স্থানটি হারালেও ২০২১-২২ সালে আবারও সেটি ফিরে পায় তারা। ব্যান্ড দলটি পশ্চিমা সংস্কৃতির অনুসারী হওয়ায় তাদের গানে সে সংস্কৃতির দৃশ্য দেখতে পাওয়া যায়, যা বাঙালিদের ওপর চরম নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে; বিশেষ করে তরুণ-তরুণীদের মধ্যে। এর একটি বৃহৎ অংশজুড়ে রয়েছে বাংলাদেশি যুবকেরা। সাধারণত বাঙালি হুজুগে বিশ্বাসী। বিটিএস অনেক জনপ্রিয় হলেও অধিকাংশ মানুষই এই ভাষা বুঝতে পারে না। কিন্তু কেন বিটিএসদের দিকে এত ঝোঁক, তা বলা মুশকিল। ভাষাটা মূলত কোরিয়ান। সেদিন এক সাক্ষাৎকারে দেখলাম, এক যুবক বলছে, ভাষা তো তেমন বুঝতে পারি না। সেটা না বুঝেই গানের তালে মাথা ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে ড্যান্স করতে বেশ ভালো লাগে; মেয়েরাও তা-ই করে থাকে। শুধু গানে নয়, আচার-আচরণ, পোশাকে—সব ক্ষেত্রে তাদের অনুসরণ করে চলছে। বাহ্যিক স্টাইলে ছেলে-মেয়ে দেখতে প্রায় একই। কারণ, চুলের কাটিং, লিপস্টিক, মেকআপ বা সাজসজ্জা একই ধরনের প্রায়। আর এই স্টাইল নষ্ট করছে আমাদের ঐতিহ্যমণ্ডিত বাঙালির সংস্কৃতি। অন্যদিকে, কোরিয়ান ভাষা তো আমরা খুব কমই বুঝি। হাতে গোনা হয়তোবা দু-একজন হবে। এতে সমালোচকেরা মনে করেন, বিটিএস গানের কথাও নাকি খাপছাড়া এবং বেশির ভাগ গানের সারমর্ম এক। ভিন্নতা তেমন নেই।

বিটিএসদের মূল সমস্যা হলো পোশাক বা চেহারায়। কোরিয়ান ব্যান্ড সদস্যদের সাজগোজ করার ব্যাপারটাই বেশির ভাগ বাংলাদেশি সংস্কৃতির ওপর চরম ক্ষতিকর দিক বয়ে নিয়ে আসবে।

তাদের ফেস আর্ট সবই প্রায় এক লিঙ্গের শামিল। মানে নারী-পুরুষের ভেদাভেদ বুঝতে পারা যায় না। এ জন্য তরুণ প্রজন্ম যখন তাদের অনুসরণ করছে, তখন থেকেই পোশাক-আশাকে তাদের নীতিমালা মেনে চলছে। এ বিষয়গুলোই বাংলাদেশের সংস্কৃতির সঙ্গে মানানসই নয়। সংস্কৃতির চরম বাস্তব উদাহরণ দিয়ে যদি বলি, পশ্চিমারা শর্টপিস পোশাকে অভ্যস্ত বা এটাই তারা পছন্দ করে বা তাদের সংস্কৃতি। অপর পক্ষে বাঙালিরা শাড়ি, লুঙ্গি, টিপ ও পাঞ্জাবিতেই বেশি মানানসই। এ জন্য আমাদের দেশে এটাই প্রচলিত ও প্রশংসনীয়। এটাই হলো সংস্কৃতিগত পার্থক্য। তাই আমাদের উচিত নয় হাজার বছরের ঐতিহ্যকে হারিয়ে দেওয়া। আমাদের শ্রেষ্ঠ সংস্কৃতিকে ধরে রাখতে না পারলে হয়তো হারিয়ে ফেলতে হবে বাঙালি গান, সুর, ইতিহাস ও ঐতিহ্য। যে সংস্কৃতি বিশ্বের মানচিত্রে শ্রেষ্ঠ আসন গেঁড়ে বসে আছে, তা এভাবে বিলুপ্ত হতে দেওয়া যায় না। উপরিউক্ত সমস্যা সমাধানের জন্য তরুণ প্রজন্মকে মানসম্মত গান, সিনেমা ও নাটক উপহার দিতে হবে। বাড়াতে হবে সুশীল সামাজিক আচরণবিধি, যেন কোনোভাবেই আমাদের সংস্কৃতি খর্বিত না হয়।

লেখক: শিক্ষার্থী; সরকারি আকবর আলী কলেজ উল্লাপাড়া, সিরাজগঞ্জ।