দেশে নারীর প্রতি সহিংসতার উৎস অনুসন্ধান

নারী নির্যাতনপ্রতীকী ছবি

বাংলাদেশে অধিক জনসংখ্যার ঘনত্ব, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, সামাজিক নিরাপত্তা, সুষ্ঠু আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগের অভাবে বিভিন্ন ধরনের সামাজিক সমস্যা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। সম্প্রতি দেশে এ রকম একটি সমস্যা হলো নারীর প্রতি সহিংসতা। নারীর প্রতি সহিংস আচরণের দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে চতুর্থ। এটি দেশের অন্যতম সামাজিক সমস্যা হিসেবে বিবেচিত। নারীরা মোট জনসংখ্যার অর্ধেকেরও বেশি হওয়া সত্ত্বেও দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে তাঁদের অবদানকে স্বীকার করা হয় না। পরিবার থেকে শুরু করে জাতীয়, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক নীতিনির্ধারণ ইত্যাদি মানদণ্ডে দেশে নারীর অবস্থান পশ্চাৎপদ। দেশের সাংস্কৃতিক আদর্শ-মূল্যবোধ, রীতিনীতি, ধর্মীয় গোড়ামী ও সামাজিক বিধিনিষেধের বেড়াজাল নারীকে আবদ্ধ করে রেখেছে নানা অনুশাসনে। বাংলাদেশের ঘরে-বাইরে-কর্মক্ষেত্রে কোনো জায়গায়ই নারীরা নিরাপদ নয়। সব স্থানে নারীরা নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। এ দেশের পিতৃতান্ত্রিক সমাজে নারী নির্যাতন এবং অধস্তনতা একটি সাধারণ বেশিষ্ট্য। তাই নারী প্রগতির এই যুগেও বাংলাদেশ সমাজে নারীর অবস্থা মোটেও মর্যাদাপূর্ণ কিংবা নিরাপদ নয়। সারা দেশে প্রতিদিন নারী ধর্ষণ, অ্যাসিড নিক্ষেপ, যৌন হয়রানি, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন ও নিপীড়নের মতো অসংখ্য ঘটনা ঘটে চলেছে।

নারী নির্যাতন, নারীর নিগৃহীত হওয়া, সম–অধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়া, সমতা অর্জনের আকাঙ্ক্ষা অপূর্ণতা সম্ভবত পৃথিবীর আদিম সমস্যা, যা যুগের বিবর্তনে শেষ হয়ে যায়নি। নারীজীবনের উন্মেষ, বিকাশ এবং ক্রমপরিণতি পুরোটাই পুরুষ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। সমাজে কোনো অবস্থাতেই নারী পরিপূর্ণ স্বাধীন বা মুক্ত নয়। যুগ যুগ ধরে চলে আসছে একই নিয়ম, একই প্রথা। উনিশ শতকের কাল্পনিক সমাজতন্ত্রী চার্লস ফুরিয়ের ঘোষণা করেন, কোন একটা সমাজের সাধারণ মুক্তির স্বাভাবিক মাপকাঠি হলো সে সমাজের নারীমুক্তির মান। এ দৃষ্টিকোণ থেকেই নারীমুক্তির বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচিত হয়ে আসছে। আধুনিককালে উদারনৈতিক নারীবাদী এবং মার্ক্সবাদীরা ধারণাগত ভিন্নতা সাপেক্ষে পুঁজিবাদ বিকাশের সূত্রের মধ্যে নারীমুক্তির সম্ভাবনা চিহ্নিত করেছেন। উদারনৈতিক নারীবাদীদের মতে, আইনগত পদ্ধতি ও মনোভঙ্গি পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে পুরুষতন্ত্রের বর্তমান শৃঙ্খল ভেঙে ফেলা যাবে। তাদের ধারণায় ভোটাধিকার, সম–অধিকার আইন, ইতিবাচক কাজ ইত্যাদির ফলে নারী অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং স্বাধিকার, প্রশিক্ষণ এসবের মধ্য দিয়ে মনোভঙ্গির পরিবর্তন সম্ভব। অন্যদিকে মার্ক্সবাদীদের মতে, পুঁজিবাদ বিকাশের সাধারণ নিয়মশৃঙ্খলা নারী-পুরুষ উভয়কে মজুরি-শ্রমিকে পরিণত করে পুঁজির শাসনাধীনে আবদ্ধ করবে। ফলে পুরুষতান্ত্রিক শৃঙ্খল ও মূল্যবোধ ভেঙে যাবে। কিন্তু লক্ষ্য করলে দেখা যায় উদারনীতিবাদীদের পাশ্চাত্য আধুনিকীকরণ প্রক্রিয়া এবং মার্ক্সবাদীদের পুঁজির শাসনপ্রক্রিয়া কোনো ক্ষেত্রেই পুরুষতান্ত্রিক চরিত্র ধ্বংস হয়নি বরং আরও শক্তিশালী হয়েছে। পুরুষতান্ত্রিকতার ব্যাপক উপস্থিতি নারীকে অধস্তন করেছে। আধুনিক পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় নারী-পুরুষ উভয়েই শোষিত হয় সাধারণভাবে; কিন্তু নারী শোষিত হয় বিশেষভাবে তার সামাজিক অধস্তনতার কারণে। উদারনৈতিক নারীবাদী এবং চিরায়ত মার্ক্সবাদীদের একপাক্ষিক ধারণার আলোকে নারীমুক্তির বিষয়টি বিবেচনা করা হলে নারী মুক্তি ব্যাহত হবে বলেই ধারণা। মূলত নারীমুক্তি বিষয়টি গণ্য করা দরকার শ্রেণিদ্বন্দ্ব এবং লিঙ্গভিত্তিক দ্বন্দ্ব এই উভয় দ্বন্দ্বের আলোকে। শ্রেণিভিত্তিক পুঁজিবাদী সমাজে নারী এবং পুরুষ উভয়েই শোষিত হয় মজুরি-শ্রমিক হিসাবে। কাজেই শ্রেণিশোষণের শৃঙ্খল থেকে মুক্তি অর্জন ব্যতিরেকে নারীমুক্তির চিন্তা অর্থহীন। অন্যদিকে দেখা যায়, নারী ও পুরুষ উভয়েই মজুরি-শ্রমিক হিসেবে একই শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত হলেও উভয়ের সামাজিক অবস্থান বৈষম্যমুক্ত নয়। এ ক্ষেত্রে শ্রেণিশোষণের সঙ্গে পুরুষতন্ত্র যুক্ত হয়ে নারীর উপর বিশেষ ধরনের শৃঙ্খল তৈরি করে। ফলে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার নারী শ্রমের এবং নারীর সামাজিক মর্যাদার অধস্তনতা মূর্ত হয়ে ওঠে। এ পরিস্থিতিতে নারী মুক্তির লক্ষ্য হওয়া উচিত শ্রেণিশোষণ এবং পুরুষতন্ত্র এই উভয় শৃঙ্খলের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো।

নারী নির্যাতন
প্রতীকী ছবি

নারীর প্রতি সহিংস আচরণের দিক থেকে বাংলাদেশ বিশ্বে চতুর্থ। সরকারি হিসেবেই ৭২ শতাংশ নারী তাদের ঘনিষ্ঠজন কর্তৃক শারীরিক, মানসিক, অর্থনৈতিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার হন। নিপোর্ট-এর এক গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী দেশের ৬০ ভাগ স্বামীই তাঁদের স্ত্রীদের নির্যাতন করে থাকে। এমনকি শহরাঞ্চলেও প্রায় ৬০ শতাংশ নারী স্বামীর হাতে মার খায়, ২০ শতাংশ নারী মৌখিক নিপীড়নের শিকার হয়ে থাকে। অন্য এক গবেষণায় দেখা যায়, সমাজের প্রতি চতুর্থ মেয়েটি তার বয়ঃসন্ধিকালে পরিবারের কারো দ্বারা শারীরিকভাবে হয়রানির শিকার হয়। এ দেশে ৯৬ শতাংশ নারী গণপরিবহনে এবং ৮২ শতাংশ নারী জনসমাগমস্থলে যৌন হয়রানির শিকার হন। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহারকারী নারীদের প্রায় ৫৩ শতাংশই এ দেশে সাইবার অপরাধের শিকার হন। এসব তথ্য থেকে সহজেই অনুমান করা যায় বাংলাদেশে নারী নির্যাতনের সংখ্যা ক্রমেই ভয়াবহ হয়ে উঠছে। নির্যাতনের এই হার অত্যন্ত উদ্বেগজনক হলেও এটাই কিন্তু চূড়ান্ত পরিসংখ্যান নয়। পারিবারিক সম্মান, লোকলজ্জা, ভয়ভীতি, বিদ্যমান বিচারব্যবস্থার প্রতি অনাস্থা, রাজনৈতিক প্রভাব ইত্যাদি কারণে দেশে বিপুলসংখ্যক নারী নির্যাতনের ঘটনা অজানা থেকে যায়। আর মামলা হলেও তার সংখ্যা একেবারে নগণ্য। মামলাকারীদের মধ্যে সমাজের নিম্ন¤শ্রেণির নারীদের প্রাধান্যই বেশি। লোকচক্ষু কিংবা সামাজিক মর্যাদাহানির ভয়ে দেশের উচ্চ ও মধ্যবিত্ত ঘরের নারীরা মামলা করতে উৎসাহিত হয় না। তারা নীরবে, নিভৃতে এ নির্যাতন সহ্য করে থাকে।

বয়স

দেশে নির্যাতনের শিকার নারীদের কোনো বয়সসীমা নেই। অর্থাৎ যেকোনো বয়সেই নারীরা নির্যাতনের শিকার হয়ে থাকেন। তবে নারীরা বয়ঃসন্ধিকালে পৌঁছার পর থেকে পরিবারে বা পরিবারের বাইরে বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার হয়ে থাকেন। ইউনিসেফের এক পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে বয়ঃসন্ধিকালে পৌঁছানোর পর মেয়েরা সামাজিকভাবে নানা বৈষম্যের শিকার হয়। তবে পঞ্চম জন্মদিন পর্যন্ত মেয়েশিশুরা নিজগৃহে বৈষম্যের শিকার হয় না। জরিপে আরও দেখা যায় ২৫-২৯ বছরের নারীদের মধ্যে ৫৪ দশমিক ৫ শতাংশ স্বামীর হাতে শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার হন। আবার ৫৫ দশমিক ২ শতাংশ নারী যাঁদের বয়স ৩০-৩৪ বছরের মধ্যে এবং ৩৫-৩৯ বছর বয়সের ৫৭ দশমিক ৮ শতাংশ নারী এই নির্যাতনের শিকার হয়ে থাকেন।

বৈবাহিক মর্যাদা

বিবাহিত ও অবিবাহিত উভয় প্রকার নারীদের মধ্যে সহিংসতার ঘটনা ঘটলেও বিবাহিতদের মধ্যেই এ সংখ্যা সর্বাধিক। কারণ হিসেবে জানা যায়, বিবাহিত নারী ও পুরুষদের মধ্যে বিভিন্ন প্রকার পারিবারিক ও মানসিক জটিলতা সৃষ্টির সুযোগ অবিবাহিতদের থেকে বেশি থাকে। ১৯৬১ সালে মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ প্রণয়ন করে মেয়েদের ন্যূনতম বিয়ের বয়স ১৬ করা হয়েছিল। ১৯৮৪ সালে আর এক সংশোধনী এনে দেশে ছেলে ও মেয়ের বয়স বাড়িয়ে যথাক্রমে ২১ এবং ১৮ বছর করা হলেও বাস্তবে নারীর বিয়ের গড় বয়স ১৫ বছর ৩ মাস। ফলে বিবাহিত নারীদের মধ্যে নির্যাতনের হার অনেক বেশি। নিপোর্ট-এর এক গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী দেশের ৬০ ভাগ স্বামীই তাদের স্ত্রীদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নির্যাতন করে থাকে। নির্যাতনের শিকার নারীদের মধ্যে বিবাহিতের সংখ্যা শতকরা ৫৬ ভাগ, অবিবাহিতা ৩৯ ভাগ, বিধবা ৩ ভাগ এবং বিধবার পুনঃবিবাহিত ২ ভাগ। দেশে নারী নির্যাতনের শিকারের সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে, বিশেষ করে অশিক্ষা, অসচেতনতা, বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, যৌতুক প্রথা ইত্যাদি কারণে বিবাহিতা নারীদের মধ্যে নির্যাতনের হার দিনকে দিন বেড়েই চলেছে।

শিক্ষা

শিক্ষার সঙ্গে নারী নির্যাতনের একটি গভীর সম্পর্ক রয়েছে। এক গবেষণায় দেখা যায়, গত ১০ বছরে দেশে নারী শিক্ষার হার বেড়েছে ৩ দশমিক ৫৭ শতাংশ। শিক্ষার ক্ষেত্রে সরকারের নানা সুযোগ-সুবিধার কারণে নারী শিক্ষার হার বেড়েছে। নারী নির্যাতনবিষয়ক বিভিন্ন প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, দেশে শিক্ষিত ও সচেতন নারীদের চেয়ে অশিক্ষিতদের মধ্যে নারী নির্যাতনের হার বেশি। কারণ, সমাজে কোনো নারী শিক্ষিত হলেই সে কোনো না কোনো পেশার সঙ্গে যুক্ত হয়।

পারিবারিক কাঠামো

পরিবারিক কাঠামোর সঙ্গেও নারী নির্যাতনের সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া যায়। সম্প্রতি এক গবেষণায় দেখা যায়, দেশে নারীর প্রতি যত ধরনের সহিংস ঘটনা ঘটে, তার প্রায় শতকরা ৮০ ভাগই সংঘটিত হয় পরিবারের মধ্যে। উন্নয়ন অন্বেষণের এক প্রতিবেদনে দেখা যায়—বিবাহিত নারীদের ক্ষেত্রে প্রতি ৪ জনে ১ জন স্বামী কর্তৃক নির্যাতনের শিকার। সমাজবিজ্ঞানীরা বলেন, যৌথ পরিবার নারী নির্যাতনের অন্তরায়। ছেলেমেয়েদের সংখ্যাধিক্য পরিবারে সংহতি বৃদ্ধি করে। অর্থাৎ পারিবারিক স্থায়িত্ব এবং সংহতি নারী নির্যাতনকে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম।

পেশার ধরন

দেশে বর্তমানে নারীরা বিভিন্ন ধরনের বৈচিত্র্যপূর্ণ পেশার সঙ্গে জড়িত। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০১০ সালের শ্রমশক্তি জরিপের প্রাথমিক ফলাফলে দেখা যায়, কৃষি, শিল্প, অফিস আদালতসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ১ কোটি ৬২ লাখ নারী নিযুক্ত আছে। অন্য এক গবেষণায় দেখা যায়, দেশে কর্মজীবী নারীরা তুলনামুলকভাবে কম নির্যাতনের শিকার হন। তবে নারীরা পুরুষের চেয়ে অধিক উপার্জন করলেও পুরুষের বর্তমানে নারী সাধারণত পরিবার প্রধান হিসেবে স্বীকৃতি ও সিদ্ধান্ত দানের ক্ষমতা পায় না। তবে পরিবারে পুরুষের অনুপস্থিতিতে নারীকে পরিপূর্ণ পরিবার প্রধান হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। তবে আশার বাণী হলো ২০০৫ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত নারীপ্রধান পরিবারের সংখ্যা বার্ষিক ৪ দশমিক ৮১ হারে বৃদ্ধি পেয়েছে।

অঞ্চলভেদ

দেশে নারী নির্যাতনের মাত্রা ও প্রকার স্থান-কাল-পাত্রভেদে বিভিন্ন হয়ে থাকে। গ্রামাঞ্চল থেকে শহরাঞ্চলে নারী নির্যাতনের হার বেশি। অন্য এক জরিপে দেখা যায়, শহরে বসবাসরত ৪০ ভাগ শিক্ষিত নারী স্বামীর হাতে নির্যাতনের শিকার হন। শহরের শিক্ষিত পরিবারের ভেতরে নারী নির্যাতনের কারণ প্রথমত ও প্রধানত নারীকে অধস্তন ভাবা বা লৈঙ্গিক বৈষম্য ও যৌতুক বা সম্পদ সম্পৃক্ততা। এসবের মধ্যে যে মেয়েশিশু জন্মে ও বেড়ে ওঠে সে নিঃসন্দেহে একধরনের নির্যাতনের মধ্য দিয়ে বেড়ে ওঠে। তাকে বৈষম্যমূলক শিক্ষা-সংস্কার-চিন্তা-চেতনায় গড়ে তোলা হয়। বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার জরিপে দেখা যায়, গ্রাম ও শহর উভয় ক্ষেত্রে নারী নির্যাতনের ঘটনার ব্যাপকতা শতকরা ৪০ থেকে ৭০ ভাগ।

নারী নির্যাতনের কারণ

দেশে নারী নির্যাতনের একাধিক আর্থসামাজিক, সাংস্কৃতিক কারণ বিদ্যমান। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের পুরুষতান্ত্রিক আদর্শ এবং চর্চার মধ্যে জন্ম নেয় এবং বেড়ে ওঠে নারীর প্রতি বিদ্বেষ আর ঘৃণা। এই অনুভূতি দ্বারা শুধু যে পুরুষ আক্রান্ত হন, তা কিন্তু নয়। নারীরাও প্রভাবিত হন। এ প্রসঙ্গে অ্যাডাম জিউস বলেন, সমাজে আমরা নারীদের মূলত সেবাদানকারীর ভূমিকাতেই দেখি। মূলত পিতৃতান্ত্রিক সমাজের নারী ও পুরুষের মধ্যকার সম্পদ, ক্ষমতা ও মর্যাদার পার্থক্যের ফলশ্রুতি হচ্ছে নারী নির্যাতন। সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে সম্পদ ও বিনিময় তত্ত্বে বলা হয়েছে ক্ষমতা সম্পদ নির্ভর এবং সহিংসতা হল সম্মতি অর্জনের চূড়ান্ত সম্পদ। এই মডেল অনুযায়ী পরিবারে পুরুষ কর্তৃক নারীর প্রতি সহিংসতা একটি সাধারণ ঘটনা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক প্রতিবেদন অনুয়ায়ী, বাংলাদেশে প্রতি ঘণ্টায় ১ জন করে নারী নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। আত্মরক্ষার অভাব, অ্যাসিড নিক্ষেপ, যৌতুক, বাল্যবিবাহ, শিক্ষার অভাব, অর্থনৈতিক নির্ভরশীলতা, নারীর নিরাপত্তার অভাব, ধর্মীয় কুসংস্কার প্রভৃতি বিষয়কে এ অবস্থার জন্য দায়ী মনে করা হলেও নারী নির্যাতনের মূল কারণ আসলে নারী-পুরুষের মধ্যকার বিদ্যমান আর্থসামাজিক বৈষম্যমূলক সম্পর্কের কারণে নারীর অধস্তন অবস্থান।

জাতিসংঘের জেন্ডারবিষয়ক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বাংলাদেশে ৪১ শতাংশ নারীর মৃত্যুর কারণ পারিবারিক নির্যাতন। নারী নির্যাতনের ১০ বছরের ঘটনার ওপর এক গবেষণা জরিপে দেখা গেছে, ৩১ শতাংশ নারী হত্যার কারণ পারিবারিক কলহ। এই কলহের প্রধান দিক হচ্ছে যৌতুক, শাশুড়ি-ননদের অত্যাচার, গয়না বিক্রি নিয়ে কিংবা সম্পত্তিসংক্রান্ত বিবাদ। যে মহিলা সম্পত্তিহীন তার ওপর অত্যাচার ঘটে নাকের ফুল, কানের দুল, গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি, মুরগির ডিম ইত্যাদি নিয়ে....। অনেক স্বামীর অভ্যাস হলো স্ত্রীকে অহেতুক হেনস্থা করা, সন্দেহ করা, এমনকি শারীরিক নির্যাতন করা। স্বামীর আদেশ অমান্য করলে, যৌতুকের কারণে, সন্তানের দেখভাল ঠিকমতো না করলে, স্বামীকে না বলে বাইরে গেলে, যথাসময়ে খাবার পরিবেশন না করলে, স্বামীর ইচ্ছানুযায়ী শারীরিক সম্পর্কে না গেলে এবং ঝগড়া করলে নারীরা শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন। এ ছাড়া ৫৪ শতাংশ পুরুষ মনে করেন, স্ত্রীকে মারধর করা তাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার। নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির নারীরা সাধারণত পারিবারিক নির্যাতন নিয়ে আলোচনা করেন। কিন্তু উচ্চবিত্ত ও উচ্চমধ্যবিত্ত শ্রেণির নারীরা সামাজিক ও লোকলজ্জার ভয়ে স্বামী কিংবা শ্বশুরবাড়ির নির্যাতন নীরবে সহ্য করতে থাকেন। পরিসংখ্যানে দেখা যায় স্বামীর দ্বারা নির্যাতনের শিকার ৬৬ শতাংশ নারী ওই সহিংসতার কথা কখনো কাউকে বলেন না। দেশে নারী নির্যাতন প্রতিরোধে সরকারের ব্যাপক প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ থাকা সত্ত্বেও আইনের দুর্বল প্রয়োগ ও পুরুষতান্ত্রিক সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে অব্যাহত নারী নির্যাতন নারীর মানবাধিকারের প্রতি হুমকিস্বরূপ।

নারীর প্রতি সহিংসতারোধে গৃহীত পদক্ষেপ

দেশে নারী নির্যাতন রোধে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। দেশে নির্যাতনের শিকার নারী ও শিশুর সহায়তার জন্য প্রতিটি বিভাগীয় শহরে মহিলা সহায়তা কেন্দ্র চালু রয়েছে। এখানে চালু আছে আশ্রয়, আইনি পরামর্শ ও আর্থিক সহায়তার ব্যবস্থা। দেশে ছয়টি বিভাগীয় শহরে রয়েছে ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার (ওসিসি), নির্যাতনের শিকার নারীকে ট্রমা সেন্টারে কাউন্সেলিং সেবাদানের ব্যবস্থা। সারা দেশে স্থাপিত হয়েছে ৪৪টি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল, জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন পর্যায়ে রয়েছে নারী সহিংসতা প্রতিরোধ কমিটি, সক্রিয় রয়েছে ভ্রাম্যমাণ আদালত। প্রতিবছর ৮ মার্চ পালিত হয় বিশ্ব নারী দিবস। ১৯৯৯ সালে জাতিসংঘ ২৫ নভেম্বরকে আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন বিলোপ দিবস এবং ২৫ নভেম্বর থেকে ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিবাদ পক্ষ হিসেবে ঘোষণা করে। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে নির্যাতনের শিকার এবং নিরাপত্তা হেফাজতে থাকা নারীদের জন্য আশ্রয়কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। নারী নির্যাতন (বিশেষ বিধান) আইনের ধারা অনুযায়ী, মামলাপ্রাপ্তির তারিখ থেকে ৯০ দিনের মধ্যে বিচারকাজ সম্পন্ন করার জন্য বিভিন্ন জেলায় সামারি ট্রায়াল গঠন করা হয়েছে।

সমাজে নারীর প্রতি সহিংসতার প্রভাব

বিশ্বব্যাংকের এক তথ্যসূত্র মতে, ৪২ শতাংশ নারী ও কিশোরী অহরহ নির্যাতনের শিকার হচ্ছে, যা নারীর দৈহিক নিরাপত্তা ও উৎপাদন শক্তি বিঘ্নিত করছে। নারী নির্যাতন কেবল নারীর অর্থনৈতিক, সামাজিক গতিকেই রুদ্ধ করছে না, এর কুফল ভোগ করছে সমাজের সব মানুষ। এক গবেষণায় দেখা যায়, নারীর প্রতি সহিংসতার কারণে বছরে ১৪ হাজার কোটি টাকা অপচয় হচ্ছে। অন্য এক তথ্যমতে, নারী নির্যাতনে দেশের ২ শতাংশ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ব্যাহত হয়। নির্যাতন নারীর শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। নারীর প্রতি সহিংসতার ফলে নারীর আত্মবিশ্বাস, নিজের প্রতি সম্মান অথবা নিজেকে চালনা করার ক্ষমতা অনেক কমে যায়। মূল কথা হল নির্যাতনে নারীর যে মানসিক বিপর্যয় দেখা দেয়, তার প্রভাব হতে পারে সুদূরপ্রসারী। এই যন্ত্রণার স্মৃতি নারীকে স্থায়ীভাবে বয়ে বেড়াতে হয় সারাজীবন। যেসব পরিবারে নারীরা অধিক হারে নির্যাতনের শিকার, সেসব পরিবারের সন্তানদের পরিপূর্ণ শারীরিক ও মানসিক বিকাশ ঘটে না। সমাজ গবেষকরা বলেন, নির্যাতনের ফলে বাংলাদেশে নারীরা নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে এবং দীর্ঘদিন ধরে সে রোগ বয়ে বেড়াচ্ছে। আইসিডিডিআরবির এক গবেষণায় নারী নির্যাতনকে বাংলাদেশের জন্য মারাত্মক জনস্বাস্থ্য ঝুঁকি বলে মন্তব্য করা হয়েছে। নারী নির্যাতন চরম বিষণ্নতা, উচ্চ রক্তচাপ ও হৃদ্‌রোগ, আন্ত্রিক ও যৌনরোগ, গর্ভধারণে জটিলতা ও গর্ভস্থ শিশুর মৃত্যু ইত্যাদির অন্যতম কারণ। অনেক ক্ষেত্রেই সহিংসতার ফলে নারী ও শিশুরা মানসিক ও শারীরিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে এবং সমাজে খাপখাইয়ে চলতে পারে না। দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় এর একটি নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।

সমাজ ও সভ্যতা বিকাশে যেমন নারীর অবদানকে অস্বীকার করার উপায় নেই, তেমনি উন্নয়নকে স্থায়ী ও ফলপ্রসূ করতে হলে নারীর পূর্ণ অংশগ্রহণের বিকল্প নেই। এ প্রসঙ্গে ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ লিখেছেন, ‘মানবদেহের দুই চোখ, দুই হাত, দুই পা, সমাজদেহে তেমনি নর ও নারী। যে দেহে এক চোখ কানা, এক হাত নুলা, এক পা খোঁড়া, সে দেহ বিকলাঙ্গ। নারী জাতির সুষ্ঠু উন্নতি ব্যতীত সমাজকে সমুন্নতই বলা যায় না’। বাংলাদেশে উন্নত সমাজ গড়ে তুলতে, উন্নয়নকে স্থায়ী রূপ দিতে এবং অন্যায় প্রতিরোধ করতে নারী পুরুষের মধ্যকার সব বৈষম্য দূর করে সমতা প্রতিষ্ঠা করা দরকার। নারী নির্যাতন নারী পুরুষের অসমতারই একধরনের বহিঃপ্রকাশ। নারী নির্যাতন বন্ধে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক শক্তিগুলোকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। আর এ বোধ থেকে পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় দায়বদ্ধতা তৈরি করতে হবে। বিশ্বায়নের জন্যই হোক আর অর্থনৈতিক কারণেই হোক, নারী কিন্তু ঘরের বাইরে বেরিয়ে এসেছে। পরিশ্রমী নারী শ্রমিকও তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশের জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেকের বেশি নারী, এ নারীকে অধস্তন অবস্থান থেকে পুরুষের সমান্তরালে তুলে আনতে হলে, তার সামাজিক, অর্থনৈতিক ও ক্ষমতার সম্পর্ককে একটা ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থায় নিয়ে যেতে হবে। যে সমাজ নারী-পুরুষের অসম সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে সহায়তা করছে, সেই সমাজ ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কাঠামোগত পরিবর্তন প্রয়োজন সর্বাগ্রে।

*লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, সরকারি মাইকেল মধুসূদন কলেজ, যশোর-৭৪০০, বাংলাদেশ