মশকনাশক মশক, না মোটেই মশকরা নয়। অচিরে এমনটি হতে যাচ্ছে। যদি প্রশ্ন করা হয়, আমাদের এই পৃথিবীতে সবচেয়ে ভয়াবহ, বিপজ্জনক প্রাণীটি কী? তাহলে অনেকেই করোনাভাইরাসের কথা বলতে চাইবেন। না, কোনো ভাইরাসকে এ জন্য দায়ী করা যাবে না। কারণ, বিজ্ঞানীরা ভাইরাসকে জীব ও জড়র মাঝখানে স্থান দিয়েছেন। তাঁরা যেখানে ভাইরাসকে জীবিত বলতে নারাজ, সেখানে ‘প্রাণী’ বলা তো দূরের কথা।
এ মুহূর্তে পৃথিবীতে সবচেয়ে ভয়াবহ প্রাণীটি হচ্ছে মশা। পূর্ণ বয়সে লম্বায় মাত্র ৩ থেকে ৬ মিলিমিটার হয়। সবচেয়ে ছোট আকৃতির মশা মাত্র ২ মিলিমিটার (০.১ ইঞ্চি) সবচেয়ে বড় মশাটি লম্বায় ১৯ মিলিমিটার (০.৭ ইঞ্চি) পর্যন্ত হয়। আর ওজনে গড়ে মাত্র ৫ মিলিগ্রামের মধ্যে মাথা, বুক আর পেট নিয়ে তিন অংশের সমস্ত শরীর। মশাকে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কিছু নেই। কেননা, মশা চেনে না, এমন ব্যক্তি খুঁজে পেতে হলে অ্যান্টার্কটিকা বা আইসল্যান্ড যেতে হবে। অতি ঠান্ডার দেশ মশাদের মোটেই পছন্দ নয়।
দাঁত, নখ, এমনকি নির্বিষ মশা মানুষ এবং আরও অনেক প্রাণীর জন্য, বাঘ, চিতা বা বিষাক্ত রাজগোখরার চেয়েও অনেক বেশি ভয়াবহ। কারণ, মশার মধ্যে স্ত্রী মশা রক্ত চোষে এবং সেই সঙ্গে মানুষ ও অন্য অনেক প্রাণীর দেহে মরণব্যাধির ভাইরাস, অণুজীব, পরজীবী প্রবেশ করিয়ে দেয়।
বিজ্ঞানীরা বলেন, পৃথিবীতে মানুষের আগমন ৬০ লাখ বছর আগে। অথচ মশারা সেই ডাইনোসরদের সময় প্রায় ২৩ কোটি বছর আগে থেকেই ডাইনোসরদের সুবিশাল শরীরে কামড় বসিয়ে পৃথিবী দাপিয়ে বেরিয়েছে। এ গ্রহ থেকে ডাইনোসরের বিলুপ্তি ঘটেছে সাড়ে ছয় কোটি বছর আগে। অথচ এই ক্ষুদ্র সন্ধিপদী পতঙ্গটি নানা বাধাবিপত্তি সয়ে আজও বহাল তবিয়তে টিকে আছে এবং ত্রাস সৃষ্টি করছে।
মশাকে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কিছু নেই। কেননা, মশা চেনে না, এমন ব্যক্তি খুঁজে পেতে হলে অ্যান্টার্কটিকা বা আইসল্যান্ড যেতে হবে। অতি ঠান্ডার দেশ মশাদের মোটেই পছন্দ নয়।
দাঁত, নখ, এমনকি নির্বিষ মশা মানুষ এবং আরও অনেক প্রাণীর জন্য, বাঘ, চিতা বা বিষাক্ত রাজগোখরার চেয়েও অনেক বেশি ভয়াবহ। কারণ, মশার মধ্যে স্ত্রী মশা রক্ত চোষে এবং সেই সঙ্গে মানুষ ও অন্য অনেক প্রাণীর দেহে মরণব্যাধির ভাইরাস, অণুজীব, পরজীবী প্রবেশ করিয়ে দেয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে মশার কারণে ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, ফাইলেরিয়া, জিকা ভাইরাস, পীতজ্বর, গোদ ইত্যাদি ভয়াবহ রোগে প্রতিবছর সমগ্র পৃথিবীতে মৃত্যু ঘটে ১০ লাখেরও অধিক মানুষের। এক ম্যালেরিয়ার কারণে প্রতি ৩০ সেকেন্ডে প্রাণ হারায় একটি শিশু। মশার কাছে মানুষ আজও বড় অসহায়।
বিজ্ঞানীরা মশার বিষকামড় থেকে মানুষকে বাঁচাতে অবিরত চেষ্টা করে যাচ্ছেন। পৃথিবীর দেশে দেশে মশকনিধনের জন্য নানাভাবে চেষ্টা করা হচ্ছে, খরচ করা হচ্ছে বিপুল পরিমাণ অর্থ। আর তা করতে গিয়ে সৃষ্টি হচ্ছে অনেক অনর্থ।
অথচ অন্যদিকে প্রচুর অর্থ খরচ করে মশার ব্যাপক আবাদ হচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, নির্দ্বিধায় সেই মশাকে ছেড়ে দেওয়া হবে প্রকৃতিতে, সে রকমই খবর এসেছে। বহু দেনদরবারের পর ১৮ আগস্ট যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার কিজ অঞ্চলের মশক নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ সে রকম একটি বিশাল পরিকল্পনায় চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে। ২০২১ সাল থেকে দুই বছর পর্যন্ত ফ্লোরিডার কিজ দ্বীপপুঞ্জে গুনে গুনে ৭৫ কোটি পুরুষ এডিস ইজিপ্টি মশা প্রকৃতিতে ছেড়ে দেওয়া হবে।
বিজ্ঞানীরা মশার বিষকামড় থেকে মানুষকে বাঁচাতে অবিরত চেষ্টা করে যাচ্ছেন। পৃথিবীর দেশে দেশে মশকনিধনের জন্য নানাভাবে চেষ্টা করা হচ্ছে, খরচ করা হচ্ছে বিপুল পরিমাণ অর্থ। আর তা করতে গিয়ে সৃষ্টি হচ্ছে অনেক অনর্থ।
তবে মশা আবাদকারী এবং সরবরাহকারী মার্কিন মালিকানায় যুক্তরাজ্যভিত্তিক কোম্পানি অক্সিটেক জানিয়েছে যে তাদের উৎপাদিত এডিস মশারা সাধারণ মশা নয়। এগুলো হবে সব পুরুষ এডিস মশা। বিজ্ঞানীরা এদের বংশগতির কলকবজা খানিকটা পরিবর্তন (রূপান্তর) করে দিয়েছেন। ফলে, স্ত্রী এডিস মশার সঙ্গে এই রূপান্তরিত পুরুষ এডিস মশা মিলিত হয়ে যেসব ছানাপোনার জন্ম দেবে, তার মধ্যে স্ত্রী মশা রক্ত চোষার মতো বয়সে পৌঁছানোর আগেই মারা যাবে।
বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এ পর্যন্ত ৩ হাজার ৫০০ প্রজাতির মশার বর্ণনা পাওয়া গেছে, যার মধ্যে মাত্র ২০০ প্রজাতির স্ত্রী মশা রক্ত চোষে। পুরুষ মশারা রক্ত চোষে না, ফুলের নেকটার হচ্ছে তাদের আসল খাদ্য। তাই বেছে বেছে স্ত্রী মশা নিধনের এমন উপায় বের করেছেন বিজ্ঞানীরা।
তবে পরিবেশবাদীরা এমন মহাপ্রকল্পের মহাবিরোধিতা করছেন। তাঁদের ভাষ্য হচ্ছে, এমন ‘জুরাসিক পার্ক এক্সপেরিমেন্ট’ পরিবেশের জন্য হিতে বিপরীত হবে। অর্থাৎ জিন বদলে মশার কারণে হাইব্রিড, কীটনাশক প্রতিরোধী মশারও জন্ম হতে পারে। ঢালাওভাবে মশকনিধন বাস্তুসংস্থানের সম্ভাব্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। কারণ, মশার লার্ভা মিঠা পানির মাছের খাদ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস। এ ছাড়া পাখি, বাদুড়, ফড়িংয়ের খাবার মেন্যুতে মশা রয়েছে। অন্য অনেক পতঙ্গের মতো অর্থকরী ফসলের পরাগায়নে মশার ভূমিকা মোটেও কম নয়।
সর্বশেষে, বিজ্ঞানীরা সম্ভাব্য চিকিৎসার জন্য মশাকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করছেন। তাঁরা মনে করেন, মশার লালায় লুকিয়ে আছে বিশ্বব্যাপী এক নম্বর ঘাতক হৃদ্রোগের মহৌষধ। মশার লালা যেহেতু রক্ত জমাট বাঁধতে বাধা দেয়, এদিকে খেয়াল রেখে বিজ্ঞানীরা আশা করছেন যে মশার লালা থেকে হৃদ্রোগ সারাতে কার্যকর ওষুধ খুঁজে পাবেন। এ ছাড়া মশা যে সুচালো শুঁড়টি দিয়ে রক্ত চুষে নেয়, বিজ্ঞানীরা তা পর্যবেক্ষণ করে হাইপোডার্মিক সুচ ডিজাইন করেছেন। এ সুচ ব্যবহারে রোগী খুব কম ব্যথা অনুভব করবেন। মশার লম্বা ও সূক্ষ্ম শুঁড় থেকে ধারণা নিয়ে মানুষের মস্তিষ্কে স্থাপন করা যেতে পারে—এমন খুবই ছোট ইলেকট্রোড উদ্ভাবনের জন্য উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন অনেকেই।
পরিবেশবাদীরা এমন মহাপ্রকল্পের মহাবিরোধিতা করছেন। তাঁদের ভাষ্য হচ্ছে, এমন ‘জুরাসিক পার্ক এক্সপেরিমেন্ট’ পরিবেশের জন্য হিতে বিপরীত হবে। অর্থাৎ জিন বদলে মশার কারণে হাইব্রিড, কীটনাশক প্রতিরোধী মশারও জন্ম হতে পারে।
পরিবেশবাদীদের এমন যুক্তি খণ্ডন করতে গিয়ে মশা আবাদকারী প্রতিষ্ঠান অক্সিটেক ব্রাজিলে জিন বদলে দেওয়া মশা ব্যবহার করে সফলতা মিলেছে বলে দাবি করছে। তাদের দাবি, তারা এমন প্রাণীটিকে নির্মূল করতে চাইছে না, শুধু মশকনাশক মশক উৎপাদন করছে এবং তা হবে একাধারে পরিবেশবান্ধব। অন্যদিকে, এই মশকনাশক মশক মানুষের জীবন রক্ষা করবে।