২০৩০ সালে লাল–সবুজের পতাকা উড়বে বিশ্বকাপ ফুটবলে
আমার ফেলে আসা ছেলেবেলার দিনগুলো এখন অনেক দূরে। তবু মনে পড়ে গেল আজ অতীতের কিছু কথা। সকাল থেকে দুপুর, দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে গেল। প্রায় তিন মাস হলো স্টকহোম ছেড়ে স্টকহোমের অদূরে, কুংসেংয়েনে এসেছি কিছু নতুনত্বের খোঁজে।
পুরো বাংলাদেশ কেমন যেন হতাশার মধ্যে চলছে। ঠিক তেমন একটি সময় আজকের শুভ সকালে সুদূর সুইডেন থেকে কিছু আশা জাগানো আর ভালোবাসার মধ্য দিয়ে কিছু কথা, আশাকরি সবার ভালো লাগবে।
১৯৭৪ সালে আমার বড় ভাই ড. মান্নান মৃধা (বর্তমানে সুইডেনের কেটিএইচ-রয়েল ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের অধ্যাপক) বৃত্তি নিয়ে চলে গেলেন উচ্চ শিক্ষার্থে পোল্যান্ডে পড়াশোনা করতে।
তখন আমি বেশ ছোট। তবু আজও মনে রয়েছে সেই সময়ের কথা। এমনকি মনে পড়ছে যখন মা বলেছিলেন আকাশের দিকে চেয়ে প্লেন যখন উড়াল দিয়েছিল, ‘আমার মান্নান ওই প্লেনে যাচ্ছে’।
আমার মায়ের চোখে অশ্রু বয়ে গেল, চোখের সে জল ছিল নিশ্চিত ভালোবাসার ও আনন্দের। কবে মান্নান ভাই লেখাপড়া শেষ করে দেশে ফিরবেন, তাঁর জন্য অপেক্ষা। অপেক্ষা যখন দীর্ঘায়িত হয়, তখন তাকে বলে প্রতীক্ষা। জীবনে সেদিন প্রথম বুঝেছিলাম অপেক্ষা আর প্রতীক্ষা কত যন্ত্রণাময় এবং সেই সঙ্গে কত মধুময়!
বাড়িতে বড় ভাইয়ের প্রথম চিঠি এল পোল্যান্ডের লর্ডজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। কী জাদু ছিল সেই চিঠিতে, তা জানি না, তবে তা পড়েছিলাম আমার সেই হেয়ার অ্যান্ড নাও কনসেপ্ট দিয়ে, যা আজও ভুলিনি।
ভাইয়ের চিঠিগুলো সব সময় শিক্ষামূলক বর্ণনা দিয়ে ভরা থাকত। পড়াশোনোর পরিবেশও ছিল ভালো। কারণ, তিনি পড়তেন ক্যাডেট কলেজে। তাই সব মিলিয়ে তাঁর লেখার ভেতর ক্রিয়েটিভ ও মোটিভেটিভ চিন্তাধারা আমাকে তখন থেকেই আপ্লুত করে তুলেছে।
মাসে একটি চিঠির বেশি আসত না তখন, তাই কেন যেন একটি রুটিন তৈরি হয়ে গিয়েছিল আমার মধ্যে। মাসের শেষ সময় হলেই পোস্ট অফিসে হাজির এবং পিয়নের কাছ থেকে চিঠিখানা নিয়েই সবার আগে পড়া ছিল আমার প্রথম কাজ।
সে ছিল এক ভালোবাসার চিঠি এবং তা ছিল শুধু স্বপ্নে ভরা। তাই তো স্বপ্ন দেখা শুরু হলো, আমিও লেখাপড়া করে বিদেশে যাব। বড় ভাইয়ের মতো অল্প বয়সেই সুইডেনে এসেছিলাম। তবে তাঁর মতো লেখাপড়ায় মনোযোগী আমি কখনো ছিলাম না।
তবে তখনকার যুগে যা যা করণীয়, তার কিছুই করতে আমি বাকি রাখিনি। লেখাপড়ার সঙ্গে গানবাজনা করা, অভিনয় করা, মাঠে কাজ করা, মাছ ধরা, স্কুলজীবনে রাজনীতি করা, বাবার ব্যবসায় সাহায্য করা, গোপনে প্রেম করা, বাবা-মায়ের বকা খাওয়া—এমনকি বাড়ি থেকে পালিয়ে ঢাকায় গিয়ে মুভিস্টার হওয়ার চেষ্টা করা, এর সবকিছু করেছি।
এসব করতে ও সময় দিতে গিয়ে হয়তো স্কলারশিপে বিদেশে আসা হয়নি। তাই গাধার মতো খাটতে হয়েছে বিদেশে পড়াশোনা করতে এসে।
কেন আজ এসব কথা মনে পড়ে গেল কোনো কারণ ছাড়া? কারণ ছাড়া যেমন কিছুই ঘটে না, তেমন ঘটনা ছাড়া সেসব কথা মনে পড়ে না। কে জানত, সেদিন (১৯৮৫ সালে) বাংলাদেশের সব সুযোগ–সুবিধা ছেড়ে আমি সুইডেনে আসব? পড়াশোনা শেষে চাকরি থেকে শুরু করে বিয়েসহ আমার বসবাস হবে বিদেশে? কেউ না। এমনকি আমি নিজেও না। তাহলে বলতে হবে এটাই যে ‘what is lotted cannot be blotted’. ভাগ্যের লিখন না যায় খণ্ডন!
তবে এতটুকু জানি, মনের মধ্যে আমি আমার ধ্যানে–জ্ঞানে অনুপ্রাণিত হয়েছিলাম বড় ভাইয়ের বিদেশযাত্রা, সঙ্গে তাঁর সেই সময়কার চিঠি, যা আমার বাস্তব জীবনকে স্বপ্নের রাজ্যে নিয়ে যেত এবং আকৃষ্ট করত।
তাই মনে হয় আজ আমি আমার সেই স্বপ্নের রাজ্যেকে নিজের মতো করে রিয়েল বাসস্থান করে নিতে পেরেছি। আমরা জানি, ‘everything was impossible until someone makes it possible’.
কিন্তু স্বপ্ন দেখা, তা–ও জেগে জেগে স্বপ্ন দেখা, এটা কি অসম্ভব? না। ভাবুন, কে জানত বাংলাদেশ একদিন তার নিজ পতাকা লাল–সবুজের হয়ে ক্রিকেট খেলবে?
বাংলাদেশ ক্রিকেট দল আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে জাতীয় ক্রিকেট দল হিসেবে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করে। তারা ‘দ্য টাইগার’ নামেও পরিচিত। আরও মজার ব্যাপার তা এখনো কেউ জানে না যে সাকিব আল হাসানের বাবা আমার ছোটবেলার স্কুলবন্ধু। মাগুরা সরকারি মডেল স্কুলের ক্লাস ফাইভ-সিক্সে পড়ার সময় আমরা একই স্কুলে পড়েছি। শুধু কি তা–ই, ভাবতে পারেন কেউ, মাশরাফি বিন মুর্তজার বাবা, ডাক নাম স্বপন, সম্পর্কে আমার মামাতো ভাই? আমার নানাবাড়ি চারিখাদা, নড়াইল। স্বপন ভাই আমার দুই-তিন বছরের বড়, অথচ সেই চারিখাদার গোচরে ও চিত্রা নদীতে সারা দিন কাটিয়েছি আমরা একসঙ্গে খেলাধুলা করে।
পড়াশোনা বা খেলাধুলার মধ্যে কখনো ভাবিনি যে একদিন আমাদের ছেলেমেয়েরা স্পোর্টসের জগতে ঢুকবে বা লাল–সবুজের হয়ে খেলবে! এই দুই বাল্যসাথিদের ছেলেরা আজ বাংলার গর্ব।
আমার ছেলেমেয়ে রয়েছে টেনিসের জগতে, এ যেন অনেকটা মিরাকেল! সাকিব এবং মাশরাফির বাবারা হারিয়ে গেছে মনের অজান্তে, অনেক বছর আগে। তারা কীভাবে কোথায় কী করছে বা কখন বিয়ে থেকে সংসার, পরে ছেলেদের সাফল্য কিছুই জানা হয়নি। আমরা কেউ কাউকে এখন চিনিও না।
বন্ধুদের ছেলেদের আমি চোখে দেখিনি, তবে এখন বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্ত বেশি, তাই তাদের অনেক গল্প শুনি। গল্প শুনে তাদের আমি অল্প অল্প ভালোবেসে ফেলেছি।
সবে ফ্রেন্স ওপেন শেষ হয়ে গেল। এবারের ফাইনাল খেলা দেখে মনে হচ্ছিল, টেনিসের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের প্রতিনিধি সিৎসিপাসের হাতেই উঠবে এবারের ফ্রেঞ্চ ওপেন। কিন্তু নেটের ও পাশের মানুষটির নাম যে নোভাক জোকোভিচ। সবকিছু শেষ হয়ে যাওয়ার আগে হার মেনে নেওয়া যে তাঁর রক্তে নেই!
শেষ পর্যন্ত টেনিসের ‘ভবিষ্যৎ’কে হারিয়ে জিতল বর্তমানই। উইম্বলডন আর ফুটবল প্রতিযোগিতা হয়ে গেল। খেলা দেখছি এবং আলাপ করছি এদের খেলাধুলার ওপরে, কেন তারা খেলাধুলাকে এত ভালোবাসে এবং কেনই–বা তারা বিশ্বকাপের ওপর এত আকৃষ্ট? কারণ একটাই, তা হলো খেলাধুলার মধ্য দিয়ে তারা খুঁজে পায় তাদের একে অপরের প্রতি বিশ্বাস, ভালোবাসা, একতা এবং পারস্পরিক সম্মান।
শুনে আপ্লুত হলাম। আজ এসব পুরোনো ও নতুন কথা তুলে ধরার কারণ একটাই, তা হলো বাংলাদেশ ২০৩০ সালে লাল–সবুজের হয়ে বিশ্বকাপ ফুটবল খেলবে। আমি আবার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছি এবং তা দেখছি আমার মনের মধ্যে।
কেন স্বপ্ন দেখছি জানেন? কারণ, নতুন প্রজন্মের মধ্যে নতুন রঙের ছোঁয়া তাদের হৃদয়ে সোনার বাংলা গড়ার কনফিডেন্স এবং নতুন আলোর জোয়ারে তারা বেঙ্গল টাইগারের মতো খপ করে ফুটবল গোলে ঢুকিয়ে দেবে, আর ১৮ কোটি বাংলাদেশির মতো আমিও আনন্দে আত্মহারা হব। তাই এই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে চাই।
আমার বন্ধু সামসুদ্দিন সুনি, একই স্বপ্নে আকৃষ্ট। সে ঢাকা থেকে প্রতিদিন কথা বলছে কীভাবে কী করতে হবে। আমার অনেক বন্ধু আমাকে অনুপ্রেরণা দিচ্ছে প্রতিদিন তাদের চিন্তাভাবনা থেকে। মনে হচ্ছে ভালোলাগা যেমন ভালোবাসায় পরিণত হয়, ঠিক তেমনি ২০৩০ সালের ফুটবল বিশ্বকাপে বাংলাদেশের অংশগ্রহণের স্বপ্ন বাস্তবে পরিণত হওয়া সম্ভব।
সম্ভব হবে না এমনটি না ভেবে বরং ভাবতে হবে কীভাবে এ স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করা যায়। প্রিয় দেশবাসী আসুন, শুধু চার বছর পরপর এক মাস শয়নে–স্বপনে বা জাগরণে নয়, এবার সত্যিকারে ফুটবল খেলি এবং আসুন খেলি প্রতিযোগিতার মধ্যে ২০৩০ সালের বিশ্বকাপে।
এই মুহূর্তে দূর পরবাস থেকে আমি নহাটার কথা ভাবছি, আমি ৬৮ হাজার গ্রামের কথা ভাবছি। আমি মাগুরার কথা ভাবছি, ভাবছি ৬৪ জেলার কথা। আমি নতুন প্রজন্মের কথা ভাবছি, আমি সোনার বাংলার কথা ভাবছি। আমি মানুষের কথা ভাবছি। ওই যে নবগঙ্গা নদী আর ইছামতীর বিল, তার কথা ভাবছি। এর আশপাশে বসেই তোমরা কেউ হয়তো আমার এই লেখা পড়বে! আমি তোমাদের কথা ভাবছি। তোমরা চেষ্টা করলে অবশ্যই পারবে। চলছে এখন জাগ্রত জনতার একান্ত প্রচেষ্টা সোনার বাংলা গড়ার। আমার মতো তোমাদের মধ্যে নতুন চেতনার বন্যা আসুক। তোমরাও একদিন অনেক বড় হবে আর তোমাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য আমার মতো করে এমনই আশার কথা শোনাবে।
লেখক: রহমান মৃধা, সুইডেন