১০ ইউরোয় জার্মানি ভ্রমণ
২০১৫ সালের ডিসেম্বর মাস। হঠাৎ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ই–মেইল এল ক্রিসমাস শপিং করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে জার্মানির একটি বিখ্যাত শহরে নিয়ে যাওয়া হবে, যেখানে ক্রিসমাস উপলক্ষে উৎসবের আমেজ তৈরি হয়। শুভেচ্ছামূল্য মাত্র ১০ ইউরো, যা ১ হাজার টাকার মতো পড়ে। নেদারল্যান্ডস আর জার্মানি পাশাপাশি দুটি রাষ্ট্র এবং আমার শহর থেকে জার্মানির সেই মোনেস্টার শহর প্রায় আশি কিলোমিটার দূরে, যেখানে প্রতিবছর ক্রিসমাসের সময় বিশেষ আয়োজন থাকে।
ইউরোপ আসছি প্রায় পাঁচ মাস হয়েছে। এখনো তেমন কোনো কাজের ব্যবস্থা হয়নি। নেদারল্যান্ডস ইউরোপের মধ্যে অন্যতম ব্যয়বহুল দেশ। এখানে মাসে একজন মানুষের গড়ে কমপক্ষে আশি–নব্বই হাজার টাকার মতো খরচ পড়ে। দেশ থেকে আসার সময় যা নিয়ে এসেছিলাম, তা ইতিমধ্যে ফুরিয়ে গেছে। পাশাপাশি ইউরোপের অন্যান্য দেশের বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে কিছু সহযোগিতাও নিয়েছি। তা ছাড়া কোনো কাজ পাওয়ার ত্বরিত কোনো লক্ষণও দেখছি না।
গত পাঁচ মাসে নেদারল্যান্ডসের বেশ কিছু শহরসহ আরও দুটি দেশ ভ্রমণ করেছি। তাই হাত অনেকটাই টানটান। তাই বলে ১০ ইউরো বা মাত্র এক হাজার টাকায় জার্মানি ভ্রমণ মিস করব! তা আমার পক্ষে কখনো মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। আরও যারা আছে, সবাইকে একসঙ্গে নিয়ে কী করা যায় আলোচনা করলাম। সবাই প্রথমে খরচের ভয়ে যেতে রাজি না হলেও পরে আমি পীড়াপীড়ি করে রাজি করালাম। কারণ তখন অর্থনৈতিক অবস্থা সবার করুণ ছিল।
পরিকল্পনা করলাম, আমাদের যেহেতু কাজকর্ম আর টাকাপয়সার আকাল চলছে, তাই দুপুরের খাবার এখান থেকে রেডি করে নিয়ে যাব। তাহলে অন্তত খাবারের জন্য ২০–২৫ ইউরো বেছে যাবে। তাতে পকেটের চাপ কিছুটা কমবে। আগের দিন সুপারশপ থেকে স্যান্ডুইচ তৈরির নানা উপকরণ সংগ্রহ করলাম এবং সকালে উঠে চারজনের জন্য আটটি স্যান্ডুইচ তৈরি করলাম। পাশাপাশি কোমল পানীয়ের বেশ কিছু ক্যান সঙ্গে নিলাম, যাতে করে কোনো কিছু কিনতে না হয়। কারণ, এর পূর্বে ইউরোপের দুই দেশসহ এশিয়ার বিভিন্ন দেশ ভ্রমণে পর্যটন শহরে জিনিসপত্রের দাম সম্পর্কে কিছুটা ধারণা হয়েছিল।
সকাল নয়টায় বাস ছেড়ে যাওয়ার কথা। তাই সাড়ে আটটার মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে চলে এলাম সবাই। তিন–চারটি বাস অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য। বিশ্বের ৪০টি দেশের প্রায় ২০০ ছাত্রছাত্রীকে নিয়ে এক দিনের এই আয়োজন। একসময় দেশে ছাত্রজীবনে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে না থাকতে পেরে ভীষণ মন খারাপ হতো। কিন্তু নেদারল্যান্ডসে এসে বিশ্বের সাত মহাদেশের ৪০টির বেশি দেশের তিন শ ছাত্রছাত্রীর সঙ্গে ডরমিটরিতে থেকে সেই আফসোসও কিছুটা কমেছে।
ইউরোপে সেনজেনভুক্ত দেশগুলো এক দেশের সঙ্গে অন্য দেশ অবাধে চলাচল করতে পারে। তাই এমন পরিকল্পনা, বিশেষ করে বিশেষ দিনের কেনাকাটার জন্য অন্য কোনো দেশের বিশেষ শহরে গিয়ে আবার দিনে দিনে ফিরে আসা সত্যিই অপূর্ব। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে চলে এলাম জার্মানির সেই শহরে। এখনে এতটাই যাতায়াত সহজ হয়েছে যে টেরই পাইনি কখন অন্য দেশের বিশেষ কোনো শহরে পৌঁছে গেলাম। নামার আগে সবাইকে নির্দেশনা দিয়ে দেওয়া হয়েছে সন্ধ্যা আটটার মধ্যে সবাই যেন এখানে উপস্থিত থাকি।
বাস থেকে নেমেই স্টেশনের বাইরে চোখ পড়ল বড় করে সাঁটানো ডিজিটাল একটি মানচিত্রের দিকে, যেখানে পুরো শহরের কোথায় কী আছে, তা সুন্দরভাবে দেখানো হয়েছে। বিশেষ করে আমাদের অবস্থান, পাবলিক টয়লেট, সিটি সেন্টার, পর্যটন আকর্ষণীয় স্থান, ক্রিসমাস শপিং সেন্টার, ঐতিহাসিক গির্জা এবং শহরের বাস রুটগুলো। মানচিত্রে যে কেউ একনজর দিলে সহজে পুরো শহরের ধারণা পেয়ে যাবে এবং কারও সহযোগিতা ছাড়াই শহরটি চষে বেড়াতে পারবে। মজার বিষয় ছিল, এ ধরনের মানচিত্র শহরে একটু পর পর লক্ষ করা গেল।
তাতেই বোঝা যায় এই শহরে প্রচুরসংখ্যক পর্যটক ভিড় করেন এবং তাদের যেন চলাচলে কোনো অসুবিধা না হয়, সে জন্য এই সুন্দর ব্যবস্থাপনা। বোঝা যাচ্ছে যথেষ্ট পর্যটনবান্ধব শহর এবং প্রতিটি সড়কে বিভিন্ন দেশের মানুষে মুখর। আমাদের প্রথম গন্তব্য ছিল ক্রিসমাস মার্কেট, যার উদ্দেশ্যে এই ভ্রমণ। অল্প কিছু সময়ের মধ্যে পৌঁছে গেলাম কাঙ্ক্ষিত সেই স্থানে। অনেকটা আমাদের দেশের শিল্প ও বাণিজ্য মেলাগুলোর মতো কিন্তু এখানে আয়োজন এবং সাজসজ্জা ছিল ব্যাপক। তাই এটির আলাদা সৌন্দর্য প্রকাশ পেয়েছে।
মূলত এখানে সবাই ক্রিসমাসের উপহারসামগ্রী কিনছে এবং পাশাপাশি শপিং মলগুলো থেকে প্রিয়জনের জন্য পোশাক কেনাকাটা করছেন। আমাদের যেমন ঈদের আমেজ, তেমন তাদের এই ক্রিসমাস এবং সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব। শহরটির বেশ প্রাচীন ইতিহাস রয়েছে এবং এখানে ইউরোপের কয়েকটি প্রাচীন গির্জা রয়েছে। তাই সমগ্র ইউরোপ থেকে প্রাচীন ও পবিত্র এ শহরে প্রচুরসংখ্যক মানুষের সমাগম ঘটে। একটু পরপর বিশাল বিশাল গির্জা চোখে পড়ছে। আমরা উৎসাহী হয়ে একটি পরিদর্শনের সিদ্ধান্ত নিলাম।
যেহেতু এখনো আমাদের তেমন কোনো স্থানীয় মানুষের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি, তাই এসব উপহারসামগ্রী নেওয়ার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। তা ছাড়া হাতে তেমন অতিরিক্ত অর্থ নেই, যা দিয়ে শখের কিছু কিনব। তবে ছোট ছোট দোকানে যেসব সামগ্রীর সমারোহ রয়েছে, তা বেশ চটকদার এবং শোপিস হিসেবে দারুণ। বিশেষ করে বাচ্চাদের বাহারি রকমের জিনিসপত্র রয়েছে এখানে যা সত্যিই অপূর্ব এবং বৈচিত্র্যময়!
আমরা শহরের সবচেয়ে বড় গির্জার দিকে রওনা হলাম এবং সেই রাস্তাটিতে মানুষের প্রচণ্ড ভিড় লক্ষ করলাম। পথিমধ্যে কয়েকটি শপিং সেন্টার চোখে পড়ল এবং সেগুলোতেও মানুষের উপচে পড়া ভিড় লক্ষ করলাম। সব কটি রাস্তা, ভবন এবং শপিং মল ক্রিসমাস এবং ইংরেজি নববর্ষের সাজে সজ্জিত হয়েছে। পুরো শহরটি আমার কাছে বিয়েবাড়ির মতো মনে হচ্ছে। কিছু সময়ের মধ্যে আমরা একটি গির্জায় এসে হাজির এবং এটি প্রায় সাত শ বছরের পুরোনো।
ভেতরে সবাই নীরবে বসে প্রার্থনা করছে। যিশুখ্রিষ্টের বড় প্রতিকৃতির সমানে রয়েছে বেশ কিছু পুরোনো এবং ঐতিহাসিক ধর্মীয় মিথোলজির ওপর আঁকা দেয়ালচিত্র। যেখানে নানা ঘটনার বর্ণনার পাশাপাশি উপদেশমূলক কথাবার্তা চিত্রায়িত হয়েছে। বিশাল পরিসরে সেই গির্জার ভেতরে সবকিছু পরিদর্শন করি এবং এটিই ছিল আমার জীবনে প্রথম কোনো গির্জার ভেতরে প্রবেশ।
ইতিমধ্যে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে লাগল। আমরা সবকিছু এত উপভোগ করছিলাম যে খাওয়ার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। সবাই মিলে পার্ক কোন দিকে আছে তা মানচিত্রে আবিষ্কার করলাম এবং পার্শ্ববর্তী একটি পার্কে এসে তৈরি করা স্যান্ডুইচ হটপট থেকে বের করলাম। সঙ্গে নেদারল্যান্ডস থেকে নিয়ে আসা কোমল পানীয় এবং চিপস খেলাম। ভিন্ন রকমের লাঞ্চ অভিজ্ঞতা। যদিও এমন হালকা খাবার তখন নিয়মিত খেতে হতো, বিশেষ করে যে চার দিন বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস থাকত।
তেমন কোনো অসুবিধা হয়নি আমাদের খাবার নিয়ে। তা ছাড়া রাতে গিয়ে সবাই রান্না করে খেয়ে ঘুমানোর পরিকল্পনা ছিল। গত মাসে পুরো এক সপ্তাহের ফ্রান্স ভ্রমণে অনেক টেকনিক শিখেছিলাম। বিশেষ করে ইউরোপিয়ান মানুষের খাদ্যাভ্যাস রপ্ত করতে। কারণ, এখানে চলতে হলে তাদের মতো করে বাঁচতে শিখতে হবে। মূলত তারা সকাল ও দুপুরে হালকা খাবার খায় এবং রাতে ভারী খাবার গ্রহণ করে। মজার বিষয় ছিল, দুপুরের খাবার বেশ অনানুষ্ঠানিকভাবে সম্পূর্ণ করে। কাজের ফাঁকে বা চলার পথে অতিসাধারণ হালকা ধরনের খাবার খায়।
আমিও সেই অভ্যাস কিছুটা রপ্ত করার চেষ্টা করছি এবং বিষয়টি আমার কাছে উপভোগ্য মনে হয়েছে। বাকি তিনজনের কাছে ভ্রমণটি কিছুটা বিরক্তিকর মনে হলেও আমি কিন্তু ভালোই উপভোগ করছিলাম। আমাদের মধ্যে এমন একজন ছিল, যে ফ্রান্স ভ্রমণের ৩০০ ইউরো জমা দিয়েও শেষ পর্যন্ত যায়নি। কারণ, তার ভ্রমণের প্রতি তেমন আগ্রহ নেই কিন্তু আমি তার বিপরীত। দিন শেষে আমাদের সহপাঠীদের দেখে রীতিমতো চোখ কপালে ওঠার কথা। সবার হাতে বড় বড় শপিংয়ের ব্যাগ এবং একেকজন বিপুল পরিমাণ কেনাকাটা করেছে।
পরক্ষণেই মনকে সান্ত্বনা দিলাম, এমন কেনাকাটা আমরাও করি আমাদের উৎসবের সময়। কিন্তু তা দেখে আমার সহপাঠীদের মন কিছুটা খারাপ হয়ে পড়েছে। তাদের মধ্যে কিছুটা সংকোচ কাজ করছে হয়তো আমরা কিছু না কেনায়। আমি বোঝানোর চেষ্টা করলাম, এটি আমাদের উৎসব নয়, সুতরাং এটিকে নিয়ে মন খারাপের কিছু নেই। আমরা শুধু এখানে ১০ ইউরোতে ভিন্ন দেশে ভ্রমণের আনন্দ নিতে এসেছি!