হ্যালোইন ও জ্যাক ওভেলনটান কাহিনি

গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকে ইংল্যান্ডে এসে স্থায়ী হওয়ার প্রথম দিকে অদ্ভুত এক দিবস বা অনুষ্ঠান উদ্‌যাপন দেখে আমি আক্কেলগুড়ুম। এ অদ্ভুত দিবস বা উৎসব সম্বন্ধে আগে আমি একেবারে কিছুই জানতাম না। এ উৎসবকে কেন্দ্র করে দোকানপাট ভরে যায় ভয়ংকর সব মুখোশ ও পোশাকে, যা দেখলে রক্ত হিম হয়ে যায়, হেমন্তের সন্ধ্যায় ছোট ছোট বাচ্চারা মুখোশ পরে ভূত-প্রেত সেজে ঘরে ঘরে গিয়ে দরজায় নক করে বলে ‘ট্রিট অর ট্রিক’, তখন ওদের কিছু খুচরা পয়সা বা চকলেট দিতে হয়। ভয়ংকর এসব মুখোশ ও পোশাক পরে একজন অন্যজনকে ভয় দেখায়। এসব পোশাক, মুখোশ পরে আবার রাতভর পার্টি হয়। পার্টির হল সাজানো হয় ‘ভূত-প্রেতের বাড়ির’ মতো করে।

ইউরোপ, আমেরিকায় বিশাল আড়ম্বরে উদ্‌যাপিত এমন অদ্ভুত একটি উৎসবের কথা ইউরোপে আসার আগে আমি শুনিনি। আমি জানতাম না। নিজের এ অজ্ঞতার জন্য নিজেকে ধিক্কার দিই আর এর-ওর কাছে দিবসটির ‘শানে নুজুল’ কী, জিজ্ঞেস করি। দেখা গেল, সবার জ্ঞানই আমার থেকে একটি শব্দ বেশি, তাঁরা জানেন দিনটিকে হ্যালোইন বলে, আমি শব্দটি আগে শুনিনি। দিবসটির নাম ছাড়া কেউই হ্যালোইন সম্বন্ধে আমাকে তেমন কিছুই জানাতে পারলেন না। দু-একজন ইংলিশ ভদ্রলোক শুধু জানালেন, ‘এটা আমেরিকান কালচার, ট্র্যাডিশন, এটা আমেরিকা থেকে এসেছে।’ আজ আমি নিশ্চিত, জানি, এ কথাও শতভাগ সত্য নয়।

প্রাচীনকালে ইংল্যান্ড, ওয়েলস, আয়ারল্যান্ড ও পশ্চিম ইউরোপে কিছু অংশে ক্যালটিক নামের একটি পৌত্তলিক ধর্ম ছিল, আজও নাকি এ ধর্মের কিছু অনুসারী ইংল্যান্ড, আয়ারল্যান্ডে আছে। যদিও সংখ্যায় খুবই অল্প। এ ধর্মাবলম্বীরা বিশ্বাস করত, বছরের শেষে, শীতের বা ছোট দিনের শুরুতে পরজগৎ আর ইহজগৎ একাকার হয়ে যায়। এ সময় পরজগতের অশরীরী আত্মারা এ জগতে চলে আসে, ভালো আত্মার সঙ্গে অতৃপ্ত আত্মা, দুষ্ট আত্মা দুনিয়াতে চলে এসে জীবিত মানুষের ওপর, আমরা যাকে প্রেতাত্মা ভর করা বুঝি, অর্থাৎ তারা ক্ষতি করে। তখন ফসল কাটা ও সংগ্রহের সময়, তারা ফসল নষ্ট করাসহ জীবিতদের অনেক ক্ষয়ক্ষতি করে। তাই ৩১ অক্টোবর তারা এসব প্রেতাত্মা থেকে বাঁচার কৌশল হিসেবে নিজেরা ছদ্মবেশ ধারণ করত। আগুন জ্বালাত আর পশুপাখির চেহারা, আকৃতি ধারণ করে থাকত, ভূতশ্রেণির লেবাস ধরে থাকত। তারা মনে করত, অশুভ আত্মারা মানুষ হিসেবে তাদের চিনতে না পারলে তাদের ওপর ভর করতে পারবে না, কোনো ক্ষতিও করতে পারবে না। ৩১ অক্টোবর ক্যালটিকদের ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতার এদিনই হ্যালোইন। দিনটির আদি ও ধর্মীয় নাম সেমহেইন (Samhain)।

আঠারো শ শতাব্দী থেকে আইরিশ অভিবাসীরা আমেরিকায় বসতি স্থাপন শুরু করে, আইরিশ ক্যালটিকরাও যায় আমেরিকায়, নিয়ে যায় হ্যালোইনের আনুষ্ঠানিকতা। আমেরিকাতে তখন শিল্পায়নের ডামাডোল চলছে, আর এ কারণেই হয়তো ইহজগৎ আর পরজগতের একাকার হওয়ার সুযোগ ছিল না, অতৃপ্ত, দুষ্ট আত্মারা তাই ধরাধামে নেমে আসতে পারছিল না। আমেরিকায় তাই হ্যালোইনের ধর্মীয় এ অনুষ্ঠান রূপান্তরিত হয় একটি সামাজিক আচার অনুষ্ঠানে। প্রথম অবস্থায় পাড়া-প্রতিবেশী নিয়ে হ্যালোইন পালন করা হতো। আমেরিকাতেই প্রথম একে অন্যকে ভয় দেখানো, ভূত-প্রেত সেজে ঘরে ঘরে গিয়ে ‘ট্রিক অর ট্রিট’ বলে শুরু হয় খাদ্য, অর্থ সংগ্রহ করার আনুষ্ঠানিকতা, প্রচলন। আয়ারল্যান্ডের ক্যালটিকরা শালগম, ওল, কপিজাতীয় সবজি দিয়ে ‘জেক ওভলেনটান’ বা সংক্ষেপে ‘জ্যাক ওভলেনটান’ বা জ্যাকের বাতি বানাত। আমেরিকাতে প্রাপ্তির সহজলভ্যতার জন্য মিষ্টিকুমড়া (পাম্পকিন) নকশা করে লেনটান বানানোর প্রচলন হয়, নকশা করা ‘পাম্পকিনের লেনটান’ হয়ে ওঠে হ্যালোইন অনুষ্ঠানের অপরিহার্য বিষয়।

জেক ওভলেনটানের একটি দীর্ঘ মজার কাহিনি প্রচলিত আছে। সংক্ষেপে গল্পটি হলো, ধান্দাবাজ, কৃপণ জ্যাকের সঙ্গে এক অমানিশা রাতে দেখা হয়ে যায় শয়তানের। জ্যাক শয়তানকে পানে আপ্যায়ন করে, দুজনে নেশা করে। কিন্তু পয়সা না থাকায় দাম পরিশোধ করতে পারে না জ্যাক। জ্যাক তাই পটিয়ে-পাটিয়ে শয়তানকে রাজি করায় একটি পয়সায় রূপান্তরিত হয়ে যেতে, শয়তান পয়সা হয়ে গেলে সে পানীয়ের দাম দিয়ে দেবে, পরে শয়তানের পূর্ণরূপে ফিরে যাবে। শয়তান রাজি হলে জ্যাক দাম না দিয়ে পয়সাটি তার পকেটে পুরে ফেলে। জ্যাকের পকেটে একটি রুপালি ক্রস থাকায় শয়তান তার পূর্বরূপ ধারণ করতে পারে না। জ্যাক তাকে এক বছর কোনো জ্বালাতন না করা ও প্রাণে না মারার শর্তে শয়তানকে পূর্বরূপে ফিরে আসার সুযোগ দেয়।

এক বছর পর শয়তানকে জ্যাক আবার ঠকায়, ফল পাড়তে গাছে উঠিয়ে আঙুল দিয়ে ক্রস বানিয়ে গাছে আটকে রাখে। এবার মৃত্যুর পর তার আত্মা না নেওয়ার শর্তে তাকে গাছ থেকে নামতে দেয় জ্যাক।

জ্যাক মারা যাওয়ার পর প্রতারণার জন্য স্বর্গে তার স্থান হয় না। ওদিকে শয়তানও তার কথা রাখে, সে কথা দিয়েছিল, তার আত্মা নেবে না, সে-ও তাকে নরকে ঢুকতে দেয় না। বেচারা জ্যাকের আত্মা বাধ্য হয়ে ঘুরে বেড়ায় মর্ত্যে। অন্ধকার রাতে একটি জ্বলন্ত কয়লা ওলের খোলের মধ্যে নিয়ে ঘুরে বেড়ায় এদিক-ওদিক দিক্‌শূন্যভাবে।

এটাই জ্যাক ওভলেনটান বা জ্যাকের বাতির কাহিনি।

এ জ্যাক ওভলেনটান আমেরিকায় আইরিশ অভিবাসীরা আরও জনপ্রিয় করে তোলেন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পাড়া-প্রতিবেশী নিয়ে উদ্‌যাপন করা আচার-অনুষ্ঠানটি একসময় একটি সর্বজনীন জাতীয় উৎসবে পরিণত হয়। অবশ্য নেপথ্যে কাজ করে ব্যবসা, তথা আমেরিকান পুঁজিবাদী বাণিজ্যব্যবস্থা, তথা বাণিজ্যকৌশল।

পশ্চিম ইউরোপ থেকে যে ধর্মীয় অনুষ্ঠান আমেরিকা গিয়েছিল আঠারো শ শতাব্দীতে, বিংশ শতাব্দীতে একটি সর্বজনীন আন্তর্জাতিক উৎসব হয়ে ইউরোপে ফিরে আসে, তাই অনেক ইউরোপীয় হ্যালোইনকে আমেরিকান ট্র্যাডিশন মনে করেন।