প্রতিভা, ব্যক্তিত্ব, পাণ্ডিত্য ও দূরদর্শিতা যে ব্যক্তির মধ্যে একাধারে বিকশিত হয়, তিনিই সর্বস্তরের মানুষের হৃদয়ে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকেন। প্রতিভা এমন এক দুর্বার শক্তি, যা অর্গল দিয়ে স্তব্ধ করা যায় না। প্রতিভা নিজেই তার প্রকাশ খুঁজে নেয়। জননায়ক হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী এমনই এক মানুষ। তাঁর আদর্শ, মানসিকতা, উদার মন ও কর্মসূচি সব সময়ই ছিল সমাজ ও দেশের কল্যাণে।
১৯২৮ সালের ১১ নভেম্বর হুমায়ুন রশীদ বৃহত্তর সিলেটের ঐতিহ্যবাহী রশীদ পরিবারে জন্ম নেন। রাজনীতিবিদ ও সমাজসেবী পরিবারের যোগ্য সন্তান ছিলেন তিনি। বাবা আবদুর রশীদ চৌধুরী ও মা সিরাজুন্নেসা চৌধুরী দুজনেই রাজনীতি, শিক্ষা ও সমাজসেবায় সম্পৃক্ত ছিলেন। নিবেদিত ছিলেন শিক্ষার বিস্তার ও মান উন্নয়নে। হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী ছাত্র হিসেবে অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তর পেরিয়ে ১৯৪৪ সালে আটটি ক্রেডিটসহ সিনিয়র ক্যামব্রিজ পাস করে আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য ভর্তি হন। সেখান থেকেই লন্ডনের ইনার টেম্পলের সদস্য হয়ে ইংলিশ বার-এ আইন শাস্ত্র অধ্যয়ন করেন। লন্ডন ইনস্টিটিউট অব ওয়ার্ল্ড অ্যাফেয়ার্স থেকে আন্তর্জাতিক বিষয়ে ডিপ্লোমা ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৫১ সালে যুক্তরাজ্যের অল পাকিস্তান ছাত্র ফেডারেশনের সেক্রেটারি এবং ১৯৫২ সালে ওই একই সংগঠনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।
হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী ফরেন সার্ভিসে যোগ দেন ১৯৫৩ সালে। একজন সৎ, দক্ষ, নিষ্ঠাবান ও মেধাবী কর্মকর্তা হিসেবে তিনি সুনাম ও সুখ্যাতি অর্জন করলেও পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালিদের প্রতি পশ্চিমাদের বৈষম্য ও দমনপীড়ন দেখে বিচলিত হন তিনি। অত্যন্ত সাহসী মানসিকতার হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীকে দেশমাতৃকার যোগ্য সৈনিক বললে ভুল হবে না। সংগ্রামী মানসিকতা তাঁকে জীবনে উন্নতির চরম পর্যায়ে আসীন করেছে।
পাকিস্তানের প্রতিনিধি হয়ে কাজ করলেও পূর্ব পাকিস্তান তথা বাঙালিদের আন্দোলনে বরাবরই সমর্থন দিয়েছেন তিনি। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানি বাহিনী বাঙালিদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লে হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী ফরেন সার্ভিসের চাকরি ছেড়ে মুক্তিসংগ্রামের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেন। তাঁকে নয়াদিল্লিতে বাংলাদেশ মিশনের দায়িত্ব প্রদান করা হয়। দিন-রাত খেটে তিনি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কূটনৈতিক তৎপরতা শুরু করেন। তাঁর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের কূটনৈতিক বিজয় দেখে পশ্চিমারা ঘাবড়ে যায়।
হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী বাংলা ছাড়াও ইংরেজি, উর্দু, ফারসি, ইতালিয়ান, ফরাসি, জার্মান, আরবি, হিন্দি ও স্প্যানিশ ভাষায় অনর্গল কথা বলতে পারতেন। আর এ জন্য সহজেই তিনি অন্য দেশের মানুষদের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারতেন। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে একবার তাঁর বক্তব্য শোনার সুযোগ আমার হয়েছিল। তাঁর ভাষা বিন্যাস ও ভাবগম্ভীর পরিবেশনা সব ধরনের মানুষকে আকৃষ্ট করত।
হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী সারা দেশের জন্য নিবেদিতপ্রাণ হলেও সিলেটের প্রতি ছিল তাঁর আলাদা টান। সিলেটের শিক্ষা, সংস্কৃতি, শিল্প তথা অবকাঠামো উন্নয়নে তিনি কাজ করতেন নিরন্তর। তাঁরই অক্লান্ত চেষ্টার ফসল শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং সিলেটের আধুনিক রেলস্টেশন। এ ছাড়া সিলেটের বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে তাঁর অবদান অবিস্মরণীয়।
হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীর সিলেট প্রেমের দুটি দৃষ্টান্তের কথা না বললেই নয়। এক বিশেষ কাজে একবার আমি ও দেওয়ান ফরিদ গাজী তৎকালীন স্পিকার হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীর সঙ্গে জাতীয় সংসদ ভবনে দেখা করতে যাই। প্রয়োজনীয় আলাপ শেষে তিনি আমাকে বললেন, ‘তুমি কবে সিলেট যাচ্ছ?’ বললাম, ‘স্যার, কাল সকালে রওনা দিয়ে বিকেলে সিলেট পৌঁছাব।’ আমাকে বললেন, ‘দু দিন সময় দিলাম তোমাকে। তুমি সিলেট শহরে কতটি প্রাইমারি স্কুল আছে এবং কতটির টিনের ছাউনি, তা আমাকে ফ্যাক্স করে জানাবে। কুয়েত ডেভেলপমেন্ট ফান্ডের কিছু টাকা ফেরত যাওয়ার উপক্রম। আমি ওই টাকাগুলো দিয়ে সিলেট পৌরসভার ভেতর যে কয়টা প্রাইমারি স্কুল আছে, সেগুলোর ভবন নির্মাণ ও আধুনিকায়নের চেষ্টা করব।’ তারপর একজনকে ডেকে ফ্যাকস নম্বর আমাদের দিতে বললেন।
আমি সিলেট পৌঁছেই আমার ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করি। কয়েক দিন পর দেখি শহরের বিভিন্ন প্রাইমারি স্কুলে নতুন ভবন নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে। আরেকবার তাঁর সঙ্গে আলাপ শেষ করে তাঁর চেম্বার থেকে বেরিয়ে আসার সময় বললাম, ‘স্যার, সালুটিকর থেকে কোম্পানীগঞ্জ পর্যন্ত রাস্তার দুধারে গেল বছর আপনার নির্দেশে রোপিত গাছের চারার বেশির ভাগই রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচর্যার অভাবে নষ্ট হওয়ার পথে।’ ‘দাঁড়াও’, বলেই তিনি সিলেটের ডিএফওকে সরাসরি ফোন করে বললেন, ‘আমার কাছে খবর আছে সালুটিকর থেকে কোম্পানীগঞ্জ পর্যন্ত রাস্তার পাশের গাছের চারা বেশির ভাগই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। বিষয় কী?’ আমাকে বললেন, ‘তুমি আগামী সপ্তাহে আমাকে ফোন করে ফলাফল জানাবে।’ তিনি ডিএফওকে এ ব্যাপারে চিঠি লিখে আমাকে কপি পাঠালেন মনিটরিং করার জন্য।
এ দুই ঘটনা থেকেই বোঝা যায় সিলেটের উন্নয়নে তিনি কত আন্তরিক ছিলেন। একজন দক্ষ প্রশাসনিক কর্মকর্তা, কূটনীতিবিদ ও রাজনীতিবিদ হিসেবে তাঁর প্রতিভাকে স্বীকৃতি দিতেই হয়। এই মহান জননায়কের রাজনৈতিক দর্শন ও জীবন নিয়ে পর্যালোচনা করলে আমরা আশান্বিত হই এই দেখে যে, তিনি ছিলেন একজন আমলা, ছিলেন একজন সফল রাষ্ট্রদূত, ছিলেন পররাষ্ট্রসচিব, পররাষ্ট্র উপদেষ্টা, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, জাতীয় সংসদের স্পিকার এবং জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনের সভাপতি; কিন্তু যে পদেই থাকেন না কেন দেশ ও নিজের জন্মভূমির প্রতি দায়বদ্ধতার ক্ষেত্রে তিনি বরাবরই ছিলেন অবিচল।
সবকিছুকে ছাপিয়ে চারিত্রিক দৃঢ়তা ও কর্মস্পৃহা দিয়ে হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী নিজেকে বিশেষ করে তুলেছিলেন। বনেদি বংশে জন্মগ্রহণ করলেও আভিজাত্যকে এড়িয়ে তৃণমূল পর্যায়ের সাধারণ মানুষকে সংগঠিত করতে নিজেকে নিঃস্বার্থভাবে নিয়োজিত করেছিলেন। সাদাসিধা ও অমায়িক আচরণ দিয়ে আকৃষ্ট করতেন মানুষকে। হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীর চরিত্রের এই দিকগুলোই সবার কাছে অনুসরণীয় হোক।