চেনা জানা কত জনপদে হেঁটে বেড়ালাম। শত শত নয়, হাজারো মানুষের সঙ্গে চলাফেরা হলো। কখনো কাজের সুবাদে, কিংবা বন্ধুত্বের বন্ধনে। সেই চলার পথে যাদের সঙ্গে চলেছি এদের সবার কিছু কিছু স্মৃতি আজও জাগরুক মন–মন্দিরে। নব্বই দশকের মাঝামাঝি ইংল্যান্ডের সাউথ ওয়েস্টর বিখ্যাত ইউনিভার্সিটি শহর এক্সিটারে তখন থাকি। কাজ করি শহরের প্রথম সারির ভারতীয় রেস্তোরাঁ দ্য গ্যাঞ্জেসে। রেস্তোরাঁর ওপরে থাকার জায়গা। কাজ আর বাস এক জায়গায়।
রেস্তোরাঁর দুটি ভাগ। পেছনে মাঝারি আকারের কিচেন ও সামনে বেশ বড় আকারের সার্ভিস ফ্লোর। সামনের চার কর্মীর আমি একজন। পেছনে কিচেনের তন্দুরি শেফ ছিলেন ছাতকের বাসিন্দা। বড়ই রসিক মানুষ, পাশাপাশি নামাজি। তবে বেশ শৌখিন বটে। শখের মধ্যে দুটি ছিল প্রধান। একটি হুজুরদের ওয়াজ শোনা। দ্বিতীয় কারও কোন মুসিবতে ফুঁ, পানি পড়া নয়তো তেল পড়া দিতেন। সমস্যা জটিল হলে তাবিজ, তবে সেটা দিতেন পরে। পানি বা তেল পড়া মুসিবতে কাজে না আসলে তখন দেওয়া হতো গরম সুতা বা গল্লা (লাঠি) পড়া। যেকোনো সমস্যা নিরসনের প্রাথমিক চেষ্টা চলতো পানি কিংবা তেল পড়া দিয়ে। পরে অন্যান্য গরম ব্যবস্থাও দেওয়া হতো।
ছুটিতে লন্ডন আসতাম ন্যাশনাল এক্সপ্রেস সার্ভিসের বাসে। যখন শুনতেন লন্ডন যাব, হাতে ধরিয়ে দিতেন ওয়াজ ক্যাসেটের তালিকা, সঙ্গে নগদ পাউন্ড। তালিকায় অনেক নাম, সাঈদী থেকে শুরু করে যুক্তিবাদী, ফুলতলী এমনকি সিলেটের কাজির বাজারের বুলবুলি হুজুরের নামও। বাড়তি পাউন্ড দিতেন তাগা (কালো সুতা) ও তাবিজের খোল আনতে। ব্রিটেনে ওনার বসবাসের বৈধতা ছিল না। তাই শহর ছেড়ে অন্য কোন জায়গায় কাজে যেতে চাইতেন না। বেশির ভাগ রেস্তোরাঁয় সময় কাটাতেন। কাজের শেষে ওপরে শোয়ার রুমে রসিয়ে রসিয়ে সুন্দর সুন্দর কাজের অভিজ্ঞতার গল্প বলতেন। একটি গল্প ছিল, বেতের তৈরি লাঠিতে তেল পড়া নিয়ে, যাকে আঞ্চলিক ভাষায় বলে ‘গল্লা’ পড়া বা পাঠ।
ব্রিটেনের সাউথ ওয়েস্ট এলাকার একটি ছোট্ট শহরে বাংলাদেশি মালিকানাধীন এক টেকওয়েতে কাজ করতেন। শেফের দেওয়া তথ্য মতে, মালিকের বাড়ি সিলেট জেলাধীন এক শহর (আমার কাছাকাছি) থেকে উত্তর পূর্বে একটি ঐতিহ্যবাহী গ্রামে। গ্রামের অনেক সুসন্তান আইন ব্যবসা ছাড়াও ভালো পদে চাকরিতে ছিলেন দীর্ঘকাল। স্বাধীনতা পরবর্তী একটি বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতা ও স্বনামধন্য মুক্তিযোদ্ধা বাস করতেন ওই গ্রামে। নামের শেষে টাইটেল ছিল চৌধুরী।
মাত্র তিনজন কর্মচারী নিয়ে ভারতীয় খাবার বিক্রির দোকান। ব্রিটেনের ভাষায় প্রচলিত নাম টেকওয়ে। মালিক সামনে বসে খাবারের অর্ডার নেন। পেছনে শেফ ও তন্দুরি শেফ অর্ডার করা খাবার প্রস্তুত করতেন।
সপ্তাহের প্রথম দিকে ব্যস্ততা কম হলেও সপ্তাহের শেষ ২/৩ দিন ব্যস্ততা বেড়ে যেতো প্রচুর। ব্যস্ত দুদিন মালিক খণ্ডকালীন কাজের জন্য এক ইংরেজ মহিলাকে নিয়োগ দিয়েছিলেন। যিনি আন্তরিকতার সঙ্গে সামনে পেছন দুজায়গা সামাল দিতে পারতেন। কখনো ওনার স্ত্রী এসে সাহায্য করতেন, সবকিছু ভালোই চলছিল। ব্যবসা ভালো হচ্ছে। কাজের শেষে শেফ চলে যেতেন স্থানীয় বারে সময় কাটাতে। তন্দুরি শেফ নামাজ–কালাম শেষে তাঁর শখের ন্যাশনাল ব্রান্ডের টেপ রেকর্ডারে শুনতেন দেশের হুজুরদের নানা ফতোয়া সংবলিত ওয়াজ। সুর করে পড়া ওয়াজ শোনার সময় তিনি তন্ময় হয়ে থাকতেন।
একদিন ঘটে গেল বিপত্তি। সপ্তাহের শুরুর দিকের ঘটনা। মালিক টেকওয়েতে এলেন খোলার প্রায় ঘণ্টা খানের পর, তাঁকে দেখে বেশ বিধ্বস্ত দেখাচ্ছিল। শেফ ও তন্দুরি শেফকে ডেকে বিস্তারিত বললেন। বিষয়, তাঁর স্ত্রীকে জিনে ধরেছে। গত রাত থেকে শুরু। সারা দিন অন অ্যান্ড অফ চলছে। মানে জিন আসছে আবার চলে যাচ্ছে। প্রথমে নিজে থেকে চেষ্টা করে কিছু ফল পেয়েছেন, কিন্তু বিকেল হতে পরিস্থিতি আর সামাল দেওয়া যাচ্ছে না। অনেক কষ্টে সবকিছু ম্যানেজ করে টেকওয়েতে আসতে পেরেছেন। টেকওয়ে বন্ধ করার আগ পর্যন্ত পানি ও তেল পড়া বিশেষজ্ঞ তন্দুরি শেফ সবকিছু আগাগোড়া শুনে নিলেন। অনেক লক্ষণ ছিল। তবে প্রধান লক্ষণ বিজাতীয় ভাষায় কথা বলা, স্বামীর দিকে তেড়ে আসা, মারধরের চেষ্টা করা।
সব দেখে স্বামী বেচারা বড্ড ভয় পেয়েছেন। তাই ছুটে আসেন হুজুরের কাছে। তন্দুরি শেফ পুরো বিষয়টি মনযোগ দিয়ে শুনে এক রাত সময় চাইলেন। ফয়সালা হলো আগামীকাল দিনে জরুরি ভিত্তিতে সমস্যার পূর্ণ সমাধানে সব ব্যবস্থা নেওয়া হবে। মালিক বাসায় ফেরার সময় হুজুর (তন্দুরি শেফ) শক্ত করে মালিকের সারা গা ফুঁ দিয়ে দিলেন। বাকি তদবিরের জন্য একটি তালিকা হাতে ধরিয়ে দিলেন। এর মধ্যে ছিল এক বোতল খাঁটি সরিষার তেল, সঙ্গে একটি লাঠি। তবে লাঠি না পেলে মেঝে মোছার মপের কাঠের ঠান্ডা হলেও চলবে। হুজুর কাজ সেরে ওপরে ঘুমাতে গেলেন বটে, তবে মালিকের জন্য চিন্তা করলেন বিস্তর। টেলিফোনে যোগাযোগ রাখলেন শুতে যাওয়ার আগ পর্যন্ত। পরদিন মালিক তালিকা মতো সব নিয়ে সকাল সকাল হাজির। ব্যাস, হুজুর দেরি না করে প্রথমে বোতলে তেল পড়া সঙ্গে কাঠের তৈরি মপের ডান্ডাতে বেশি করে পড়া তেল মেখে শক্ত লাঠি পড়া দিলেন। বলে দিলেন, যেকোন উপায়ে তেল পড়া ওনার স্ত্রীর মাথা ও মুখে মাখাতে হবে। আর পড়ে দেওয়া লাঠিটি (মপের ডান্ডা) বিছানার পাশাপাশি রাখতে হবে। অনেকক্ষণ দোয়া করে বললেন, দেওয়ান সাহেব আশা করি আমার তদবির কাজে আসবে। মালিক দেরি না করে চলে গেলেন বাসায়। বাসায় যাওয়ার আগে সিদ্ধান্ত হলো, আজ বিকেলে টেকওয়েতে মালিক আসবেন না। শেফ ও তন্দুরি শেফ পালাক্রমে রাতটি চালিয়ে নেবেন।
রাতে দেওয়ান সাহেবের কোনো খবর না পেয়ে হুজুর ভাবলেন, তাহলে ওনার তদবিরে হয়তো কাজ হয়েছে।
সকালে দরজায় ঘন ঘন করাঘাতের শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। দরজা খুলেই দেখেন মালিক দেওয়ান সাহেব। কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই তিনি রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে হুজুরকে বললেন, কী সব তেল পড়া আর গল্লা (লাঠি) পড়া দিছেন। এসবে কোন কাজে আসেনি। উপরন্তু দেখুন, আমার কী অবস্থা। যে গল্লা (লাঠি) দিয়ে আমার স্ত্রীর চিকিৎসা করার কথা। ভদ্রমহিলা সেই লাঠি আমার পিঠে ভেঙেছেন। কী হাল করেছেন দেখুন। সব শুনে হুজুর শুধু বললেন, না না এমন হওয়ার কথা নয়। যে শক্ত আর গরম গল্লা পড়া দিয়েছি, তা এমন হতেই পারে না। কোথাও কোন ভুল হয়েছে। তাই ফল উল্টে গেছে।
অনেকক্ষণ মাথা চুলকে হুজুর বললেন, আচ্ছা আপনি যে সরিষার তেলের শিশি এনেছিলেন পড়া তেলের জন্য, তা কি সঙ্গে আছে? মালিক বললেন, আরে হুজুর কী যে বলেন, জান নিয়ে পালিয়ে এসেছি। তেলের বোতল আনব কীভাবে। তবে হ্যাঁ, যে ইন্ডিয়ান দোকান হতে কিনেছিলাম সেখান থেকে একই বোতল আনতে পারব। হুজুর বিনয়ে অনুরোধ করলেন, প্লিজ তাই করুন। প্লিজ তাই করুন। দোকান থেকে তেলের বোতল আনার পরে হুজুর (তন্দুরি শেফ) বোতল হাতে নিয়ে বললেন, আমি তো জানি, ভুলটি কোথায়!! তাই তো বলছি কোথায়ও একটি ভুল ছিল। তা না হলে আমার পড়া তেল পড়া কিংবা গল্লা পড়া অবশ্যই কাজে আসতে হবে। সবাই যখন জিজ্ঞেস করলেন, তা হলে সমস্যা কোথায়? টোটকা চিকিৎসার বিশেষজ্ঞ হুজুর আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন শিশির গায়ে সাঁটানো মনোগ্রাম। সবাই দেখলেন সরিষার তেলের বোতলের গায়ে লেখা। লক্ষ্মী মার্কা খাঁটি সরিষার তৈল। Made in Kolkata. (India)