হুঁশ
শাফকাত হায়াত অ্যাভিনিউ সাউথ ধরে বাসায় যাচ্ছিলেন। এস্টোরিয়ার এই নেইবারহুড আগের চেয়েও এখন অনেক জমজমাট। বছর দু-এক আগে ঈদের জামাতের পর অনেকের সঙ্গে দেখা হয়ে যেত। পরিচিত মুখগুলোর এখন আর দেখা মেলে না। মহামারির ভয়াবহতায় জীবনের স্বাভাবিক ছন্দ থেমে গেছে। টুয়েন্টি সেভেন স্ট্রিটের সিগন্যালে রেড লাইটে দাঁড়াতে গিয়ে পুরোনো দিনের স্মৃতিগুলো ভেসে আসে। সূর্যের তীক্ষ্ণ রশ্মি তখন সরাসরি চোখে এসে পড়েছে। উজ্জ্বল আলোয় গা ছুঁয়ে যাওয়া ভোরের মৃদু বাতাসে খুব ভালো লাগছে।
সিগন্যালটি পার হতে কয়েক মিনিট নেয়। এদিকে পাঁচ-ছয় লেনের ওয়ান ওয়ে রাস্তা। মাঝে গ্র্যান্ড সেন্ট্রাল হাইওয়ের দশ-বারো লেনের এলিভেটেড অংশটি ঝুলন্ত সেতুর সঙ্গে মিশে গেছে। নিচের ক্রসিংটি পেরোতে অনেকটা টানেলের মতো। তারপর আবার সিগন্যালে অপেক্ষা।
বাসার কাছে শাহজালাল মসজিদে প্রথম জামাত সাড়ে আটটায় শেষ হয়েছে। আজকে ভোরে শাওয়ার শেষে পায়জামা পাঞ্জাবি পরে প্রায় দৌড়ে প্রথম জামাত ধরেছিলেন। আগে ছেলেদের নিয়ে ঈদের জামাতে আসতেন। সে সময় প্রথম জামাত ধরতে যাওয়া কষ্ট হতো। তাদের ঘুম ভাঙিয়ে জামাতের জন্য রেডি করা কখনো সহজ ছিল না। এই সব দিনগুলো এখন স্বপ্নের মতো। সেই সময় কত দ্রুত পার করে এসেছেন!
ছেলেরা কয়েক হাজার মাইল দূরে ওয়েস্ট কোস্টে নিজেদের জীবন তরী ভাসিয়েছে। এই মুহূর্তে তাদের ওখানে রাত। ঈদের জামাতে আদৌ যায় কিনা জানা নেই। ভিন্ন পরিবেশে ব্যক্তি স্বাধীনতার দেশে সবকিছু তাদের নিজেদের মতো।
একা হাঁটতে গিয়ে অতীত এভাবেই সামনে আসে। ইদানীং প্রায়ই এমন আনমনা হয়ে পড়েন। মুসল্লিদের একজনও সামনে পেছনে নেই। এই ক্রসিংয়ে হাসিমাখা একটি মুখের সঙ্গে প্রায়ই দেখা হতো। কখনো এক সঙ্গে জামাত শেষে বাসায় ফিরতেন তাঁরা। ছোটখাটো মানুষটির স্মৃতি ভেসে আসে। সৌদি আরব থেকে নিউইয়র্কে এসেছিলেন শাফকাতের প্রতিবেশী। গত ঈদেও শুভেচ্ছা বিনিময় করেছিলেন। জিজ্ঞেস করেছিলেন, আপনার ছেলেরা আসছে?
শাফকাত উত্তরে তাঁকে বলেছিলেন, ‘ওরা তো অনেক দূরে থাকে, ক্রিসমাসের লম্বা ছুটি ছাড়া সাধারণত আসে না। এখন তো করোনাকাল।’
তিনি নীরব রয়ে গেলেন। বোঝা গেল না কোনো দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ছিলেন কিনা। মৃদুভাষী হক সাহেব আর কোনো দিন তাঁকে এমন প্রশ্ন করতে আসবেন না।
হক সাহেবের বড় মেয়ে অ্যাটর্নি। সে সাদা চামড়ার একজন অ্যাটর্নিকে বিয়ে করে পার্শ্ববর্তী রাজ্যে সুখে শান্তিতে আছে। ছোট মেয়েটি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাট চুকিয়ে একটা ল’ ফার্মে জয়েন করেছে। সে-ও বোনের মতো অ্যাটর্নি হওয়ার স্বপ্নে বিভোর। তাদের মা হাসপাতালের নার্স। চমৎকার গোছানো সংসার। কথা বললে কোনো আক্ষেপ আছে এমন মনে হয় না। তিনি অসাধারণ অতিথি পরায়ণ। ঈদের দিনে রীতিমতো টেনে বাসায় নিয়ে যান। সারা বছরে সেদিনই সোফায় বসে আয়েশ করে হক সাহেবের সঙ্গে কিছু সময় গল্প হয়। কল্পনায়ও আসেনি সপ্তাহখানেক আগে তিনি চিরদিনের জন্য চলে যাবেন। দুরারোগ্য ব্যাধি ক্যানসার নীরবে শরীরে বাসা বেঁধেছিল সম্ভবত অনেক দিন থেকেই। ক্যানসার ধরা পড়ার এক বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই চলে গেলেন। মৃত্যুর তিন-চার দিন আগেও শাফকাত দেখে এসেছিলেন। কোনো কথা না বলে হাতের ইশারায় বসতে বলেছিলেন। প্রায় তাঁর স্ত্রী জান্নাত আরা বলতেন, ‘ভাই বাসায় আসেন না কেন? আপনার ভাইয়ের সঙ্গে গল্প করবেন।’
ব্যস্ততার কারণে শাফকাত যেতে পারেননি এমন নয়। সিঁড়ি বেয়ে তাঁর নিজের অ্যাপার্টমেন্ট গিয়ে আর বের হতে ইচ্ছে হয় না। আলসেমিতে পেয়ে বসে।
শাফকাত সিগন্যালে দাঁড়িয়ে হাসিখুশি সেই মানুষটিকে বারবার মনে করছেন। দুই যুগের বেশি একই ভবনে থেকেছেন তাঁরা। নিজেদের সুখ-দুঃখের বিষয়টি কখনো আদান-প্রদান হয়নি। জান্নাত আরা বেগম প্রায়ই দেশে যেতেন। যাওয়ার সময় সিঁড়িতে দেখা হলে বলতেন, ‘আপনার ভাইয়ের প্রতি একটু খেয়াল রাইখেন, আমি দেশে যাচ্ছি’ এই পর্যন্ত। শাফকাতের যাওয়া হয়নি। এখন মা ও মেয়ের সঙ্গে সিঁড়িতে দেখা হলে কুশলাদি বিনিময় ছাড়া আর কথা এগোয় না। তাঁরা দুজনই চাকরি করেন। মেয়ের নাম সুহানা। বাবার মতো হাসিমুখে বলবে, ‘আংকেল কেমন আছেন? ওরা কেমন আছে? সবাই ভালো তো?’ ওরা মানে শাফকাতের ছেলে-মেয়েদের কথা। সুহানা শাফকাতের ছোট ছেলে সিমনের এক গ্রেড নিচে পড়ত।
মেয়েটার মুখ থেকে অসহায়ভাবে কথাগুলো বের হয়। জীবনযুদ্ধে এই ছোট্ট মেয়ে সুহানাও মায়ের সঙ্গে কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি। জীবনটা যেন শুধু নিজেকে নিয়ে উদ্দেশ্যহীন ছুটে চলা। ওদের দিকে তাকালে পুরোনো স্মৃতিগুলো বেদনায় ভরিয়ে দেয়। সিমনের স্কুল বাসের অপেক্ষায় শাফকাত ব্লকের শেষ প্রান্তে কত দিন হক সাহেবের সঙ্গে দাঁড়িয়ে থেকেছেন। বৃষ্টি বা তুষার ঝড় কিছুই হার মানাতে পারেনি তাঁদের। কখনো ঝড় শুরু হওয়ার আগেই ড্রাইভ করে স্কুল থেকে তাদের নিয়ে আসতেন। সবই যেন মাত্র কয়েক দিন আগের ঘটনা।
আবার সিগন্যালের দিকে চোখ ফেরান। ইচ্ছা করলেই এই সিগন্যালের রেড লাইটে পার হওয়া যায় না। গ্র্যান্ড সেন্ট্রাল হাইওয়েতে উঠতে প্রচণ্ড বেগে গাড়িগুলো ছুটে যায়। প্রথম সিগন্যাল পার হলে হাইওয়ের নিচে আন্ডারপাস। আবার সিগন্যাল। পাঁচ-ছয় লেন। অপেক্ষা করাই শ্রেয়। শাফকাত অন্যমনস্ক হয়ে পড়েন।
কোনো গাড়ি আসছে না। তবুও ঝুঁকি নিয়ে বোকামি করতে চান না। প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটে এই ক্রসিংয়ে। রাস্তা পার হলেই বাসা। বাসার সামনে এসে মনটা বিষাদে ভরে গেল। সবকিছুতেই শূন্যতার ছায়া। এই ব্লকে গুটিকয়েক বাঙালি পরিবার থাকতেন। তাঁরাও মুভ হয়ে অন্য অন্যত্র চলে গেছেন। সিংহভাগ আয় ভাড়ার পেছনে দেওয়া যৌক্তিক মনে করেননি অনেকেই।
তিন যুগ আগে যুক্তরাষ্ট্রে আসার পর থেকেই শাফকাত এস্টোরিয়ায়। সে সময় অনেক বাঙালি ছিল এই নেইবারহুডে। ঈদের দিনে ধুমধাম পড়ে যেত। ট্রাইব্রো এখন নতুন নাম নিয়ে ‘আরএফকে ব্রিজ’। এই বিশাল ঝুলন্ত সেতুর নিচে খোলা মাঠে ঈদের জামাত হতো। তখন অনেকের পরিবার নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে আসার সুযোগ হয়নি।
স্বায়ত্তশাসিত সরকারি প্রতিষ্ঠানে মতিঝিল হেড অফিসে চাকরি করতেন শাফকাত। পরিবার ঢাকায় রেখে এসেছিলেন। অফিস থেকে চাকরিতে জয়েন করার নোটিশ গেছে কয়েকবার। সরকারি চাকরি তাই কাজে জয়েন না করায় সোজা টারমিনেশন। ঢাকা থেকে স্ত্রীকে অল্প দিনের মধ্যে নিউইয়র্কে নিয়ে আসেন। ছেলে ইমন অনেক ছোট। সবার গ্রিন কার্ড হলেও শাফকাতের মতো দুর্ভাগ্যবানরা পড়ে গেলেন ভীষণ গ্যাঁড়াকলে। অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ। ভাগ্যবান ব্যক্তিরা ও-পি-ওয়ান ভিসা পেয়ে পরিবার নিয়ে আসছেন। অনেককেই তিনি সাহায্য সহযোগিতা করেছেন। বাসায় রেখেছেন। কাউকে টাকা-পয়সাও দিয়েছেন। অনেকে মনে করতেন, তিনি আমেরিকান সিটিজেন। কাউকে তাঁর স্ট্যাটাসের কথা বলতেন না। কী দরকার জানিয়ে। এই সেদিনও বড় ছেলে ইউনিভার্সিটি থেকে ডিগ্রি নেওয়ার আগ পর্যন্ত তাঁদের প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট ছিল না। ওদের মেজো মামা পারিবারিক ক্যাটাগরিতে ফ্যামিলি ভিসার আবেদন না করলে আজও হয়তো লিগ্যাল স্ট্যাটাস থাকত না। কঠিন দিনে অনিশ্চিত মুহূর্তে পরিবারকে সামলে নিয়ে এগিয়েছেন। এখন মনে হচ্ছে নিজের নিশ্চয়তার জন্য কিছু করা হয়নি। তাঁরা একা হয়ে পড়েছেন। কখনো ভাবেন নতুন করে জীবনসংগ্রামে আবারও ঝাঁপিয়ে পড়বেন। এখনো মনোবল ঠিক আছে আগের মতো।
হক সাহেব বেঁচে থাকলে হয়তো বাসার গেটের সামনে অথবা সিঁড়িতে দেখা হতো। সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে স্বপ্নের কথা বলতেন। নাতি-নাতনির গল্প শোনাতেন। কোনো দিন আর সেই শান্ত প্রতিবেশীর সঙ্গে দেখা হবে না। বাসার গেটের দুই পাশে গোলাপি ও সাদা রঙের ফুলের দিকে তাকিয়ে থাকেন শাফকাত। ফুল গাছ দুটো কত বড় হয়ে গেছে, খেয়াল করেননি। সাদা ও গোলাপি রঙের ফুলগুলো বাড়িটির অনেক সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিয়েছে। বাড়ির আঙিনার অবিচ্ছেদ্য অংশ এই দুটি গাছ। এত দিন ধরে দেখছেন, তবু ফুল গাছটির নাম জানা হয়নি। চেষ্টাও করেননি। তাকানোর ফুরসত ছিল না। কেন এই ব্যস্ততা? হক সাহেব তো পরিবারের কাজকর্ম পেছনে ফেলে চিরদিনের জন্য হারিয়ে গেছেন। এই বাস্তবতার কোনো হেরফের কারও জন্য হবে না। শাফকাত দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবেন কখন হুঁশ আসবে!