সকাল থেকে বিশ্ব নারী দিবস নিয়ে সবার এত আনন্দ প্রকাশ দেখে হাসনাহেনার মাথা গরম। সে মানুষ হয়েছে কঠিন শাসনে। মানে ওর শিশুকাল শাসনের আড়ালে কয়লা হয়ে গিয়েছিল। বড় হওয়ার ঘটনা তো আরও করুণ। শুনে ওর বান্ধবী রুবি হাসতে হাসতে বিছানা থেকে পড়ে যেতে যেতে বলে বসল, খুলে বল সবকিছু দোস্ত।
হাসনাহেনা অতঃপর দুঃখের ঝুলি খুলে বসল। ছোটবেলায় খেলার জন্য পার্কে যেতে দিত ঠিকই ওর মা, কিন্তু মাগরিবের নামাজের এক মিনিট দেরি হলেই হয়েছে। এ ধরনের দস্যি মেয়েদের জীবনে মানুষ হওয়ার সম্ভাবনা শূন্য, মর্নিং শো’স দ্য ডে-জাতীয় কথা শুনে কানে প্রায়ই ভোঁ ভোঁ করত। তাই ইচ্ছা না থাকলেও গোধূলির সময় প্রায় জিতে যাওয়া বুড়ি চিঁ বা হাডুডু খেলা বাদ দিয়ে বাসায় চলে আসতে হতো তাকে।
সাইকেল চালানোর সময় মা তাঁর দৃষ্টিসীমার বাইরে চালাতে দিতেন না। সাঁতার কাটতেও গেলেও তা-ই। পুলে নামলে তিনি ঠায় দাঁড়িয়ে থাকবেন পাড়ে। কেন বাপু, সেই সময়ে বাড়তি কিছু আলুর চপ ভেজে ফেললে কী হয়? নাহ, সঙ্গে যাবেন আর সঙ্গে আসবেন।
আরেকটু বড় হতেই ওদের বাসার সামনে কায়দা করে সাইকেল চালানো বা নতুন বুট পরা কিছু কিশোর ঘুরত। তাদের গানের গলা কাক থুক্কু কোকিলের চেয়ে কম ভালো ছিল? সঙ্গে দিতে চাইত চিঠি...‘আমারও পরান ও যাহা চায়, ও হেনা তুমি তাই’ চিঠি গিয়ে পড়ত দারোগা নারীর হাতে। অতঃপর তাদের মা-বাবার সঙ্গে মায়ের কী কথা হতো হাসনাহেনা জানে না। তবে নায়করাজ রাজ্জাকেরা হাওয়ায় মিলিয়ে যেত। রোমান্টিক মন কত সহজে নষ্ট, আহা...
এ পর্যায়ে রুবি আরেক কাপ চা আর পিঁয়াজুর আবদার করে বসল। বলল, বিদেশে বসে খালামণির অত ভালো রান্না কি আর পাব? দে, তোর খাবারই দে। দুধের সাধ ঘোলে মেটাই। তোর দুঃখের কাহিনি তো সবে শুরু হয়েছে মনে হয়। চা নিয়ে বসে হাসনাহেনা বলল, তারপর শোন। খেলাধুলায় উসাইন বোল্টের চেয়ে কম ছিলাম? এসএসসির পর সব বন্ধ। কেন? পড়াশোনা করতে হবে, নিজে ভালো থাকবে হবে আর সবার জন্য সেবামূলক কিছু করতে হবে। ঝাঁজিয়ে উঠত হেনা, কেন মা পৃথিবীর সব বোঝা আমার ঘাড়ে নিতে হবে? তুমি আমার পিছে সময় নষ্ট না করে নিজে সে কাজের দায়িত্ব নিলেও তো পারো। শুনে মা নাকি বলেছিলেন, তিনি তো সব সময় থাকবেন না। আর একা একা দুনিয়ার সব ঐশ্বর্য নিয়েও নাকি ভালো থাকা যায় না। বলে আবৃত্তি করতেন,
কে লইবে মোর কার্য্য
কহে সন্ধ্যা রবি
শুনিয়া জগত রহে নিরুত্তর ছবি
মাটির প্রদীপ ছিল, সে কহিল স্বামী
আমার যেটুকু সাধ্য করিব তা আমি।
সাধারণ মাটির প্রদীপ না বলে হারিকেনও বলতে পারতেন, বল? অপমানের চূড়ান্ত। এইচএসসির আগে আগে বিতর্ক প্রতিযোগিতায় আন্তজেলা চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল সে। ঢাকা যাবে, তার আগে যথারীতি মায়ের ভেটো। এ সময় তর্কবিতর্ক করে বেড়ালে নাকি ভবিষ্যৎ ঝরঝরে। বলে কী? তাকে তো টিভিতে দেখাবে। তবু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মা কিছুতেই পড়া বাদ দিয়ে যেতে দিতে রাজি হলেন না।
হাসনাহেনা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় মডেলিং করার সুযোগ পেল। নাচতে নাচতে মাকে বলেছিল, মা, তোমার আর বেশ কিছুদিন আমাকে টাকাপয়সা দেওয়া লাগবে না। তিনি নাকি শিক্ষিকাসূচক ধমক দিয়ে বলেছিলেন, মেয়ে যেদিন নিজে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতে পারবে, সেদিন নিজের টাকা দিয়ে যেন তাঁকে শাড়ি-চুড়ি কিনে দেয়, রেস্তোরাঁয় নিয়ে খাওয়ায়। এখন পড়াশোনা বাদ দেওয়ার ফলাফল কঠিন খারাপ হবে। সুতরাং পড়ল বাড়া ভাতে ছাই। গাইতে পছন্দ করত সে। রেডিওর তালিকাভুক্ত শিল্পীও হয়েছিল। মা নাকি বলেছিলেন, পড়াশোনা বাদ দিলে অন্য সব গুণ শূন্য হয়ে যায়। আগে পিএইচডি করুক। সেটা হবে এক। আর গান ও সবকিছু হবে শূন্য তার সঙ্গে। মানে ১ পড়াশোনা, গান ১০ ইত্যাদি।
এ পর্যায়ে কাজের মেয়ে রহিমার প্রবেশ। সে বলল, হাসনাহেনার এক ছাত্র তুমুল বৃষ্টি উপেক্ষা করে ম্যাডামের কাছে নোট নিতে এসেছে, গত কালের ক্লাসটা নাকি তার মিস হয়েছে। হাসনাহেনা উঠে যেতেই ওর স্বামী রাব্বি বলল, জানেন রুবি, এ রকম মা-ভক্ত মেয়ে বলেই আজকে এত সফল একজন শিক্ষিকা। কত ছেলেমেয়ের জীবন গড়ে চলেছে। ওর মায়ের স্বপ্ন সার্থক।
হাসনাহেনা ফিরে এল সে সময়। তারপর বলল, রুবি, নারী দিবসে খুব আনন্দের সঙ্গে নিজের জীবনের আনন্দ তোর সঙ্গে শেয়ার করলাম। মা কাঠিন্যের আড়ালে কত বিপদ থেকে বাঁচিয়ে সুন্দর একটা জীবন দিয়েছেন। নারীরা তো এমনই হবেন। নিজের সন্তান যেন ভালো থাকেন, অন্য মানুষকে ভালো রাখেন। মায়ের মতো করে হাসনাহেনাও নেপোলিয়ান বোনাপার্টের উক্তি আওড়ে চলল এরপর,
‘Give me a good mother
I’ll give you a good nation’
ভালো মা দিন আমাকে, আমি একটা ভালো জাতি উপহার দেব।
নারী দিবসের শুভেচ্ছা পৃথিবীর আলোর পথিক নানি, দাদি, মা, খালা, চাচি, ফুফু, বোন, কন্যা ও ভাগনিদের।