হারিয়ে না যাওয়ার গল্প

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

ইদানীং আমি একজনকে খুব মিস করি। মিস শব্দটার সঙ্গে অভ্যস্ত হওয়ার আগে কি বলত মানুষ? তোমার কথা খুব মনে পড়ে, তোমাকে দেখতে ইচ্ছা করে কিংবা তোমার সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছা করে। এ সবের কোনো কিছুতেই মিস শব্দটার সমান গভীরতা খুঁজে পাই না আমি। দীর্ঘদিনের অনভ্যাসে পুরোনো অনেক আবেগের গভীরতা কমে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। এখন অন্য একজনের সঙ্গে সে সংসার করছে। আমার উচিত তাকে ভুলে যাওয়া। কিন্তু তাকে ভুলতে পারি না। প্রচণ্ড কষ্টে অভিমানী কণ্ঠস্বরে চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করে আজও ভালোবাসি তোমাকে, আজও ভালোবাসি...।
প্রথম কোথায় দেখেছিলাম তাকে? হ্যাঁ, আমাদের বাসার সামনের রাস্তায় বর্ষার বৃষ্টিস্নাত বিকেলে। স্পষ্ট মনে আছে আমার। আমার অনার্স ফার্স্ট ইয়ারের কোনো একদিন। দুপুর থেকেই গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছিল। কলেজেও যাওয়া হয়নি। কতক্ষণ আর বই পড়া যায় কিংবা শুয়ে-বসে সময় কাটানো যায়। অনেকটা বিরক্ত হয়েই ওপরতলার ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়াই। রাস্তায় চোখ পড়তেই দেখি টুপটাপ বৃষ্টি মাথায় নিয়ে খোলা চুলের শ্যামলা একটা মেয়ে হুডখোলা রিকশাই চড়ে যাচ্ছে! বৃষ্টি ছুঁয়ে দেওয়ার জন্য হাত দুটো বাড়ানো। চমৎকার দৃশ্য। চুপসানো মনকে চাঙা করে দেওয়ার মতো একটা দৃশ্য। কিউট এক মেয়ে, চুল ছেড়ে দেওয়া। হুডখোলা রিকশায় বৃষ্টিতে ভেজার অসাধারণ দৃশ্যটা দেখেই কার না ভালো লাগে। এ রকম দৃশ্য বারবার দেখা যায় না। এ রকম দৃশ্য গাছে ধরে না।
তার ওপর ক্র্যাশটা তখনই খেয়েছিলাম কিনা জানি না। কিন্তু কেন জানি বৃষ্টিভেজা স্যাঁতসেঁতে বিকেলটা আমার কাছে চনমনে হয়ে ওঠে। উচাটন হয়ে ওঠা মনের ভেতর জ্বলে ওঠে হাজার বাতির রোশনাই। আশপাশে বেজে ওঠে ভায়োলিন-পিয়ানো। মুহূর্তেই চকমকিয়ে ওঠা আমি মেজ আপুকে টেনে নিয়ে আসি ছাদে। আমি তো বৃষ্টিতে ভিজলামই, জোর করে মেজ আপুকেও ভেজালাম।

আপু আমাকে বলেন, রাশেদ তুই আসলে আগাগোড়াই একটা পাগল। বৃষ্টিতে শরীর ভিজিয়ে কি লাভ? শুধু শুধু শখ করে সর্দি বাঁধানোর ফন্দি।
আপুকে সেদিন বলতে পারিনি যারা শখ করে বৃষ্টিতে ভেজে তারা শরীর ভেজানোর জন্য নয়, তারা মন ভেজানোর জন্যই বৃষ্টিতে ভেজে। শরীর ভেজানোর মধ্যে নয়, মন ভেজানোর মধ্যেই কখনো কখনো অর্থবহ শৈল্পিকতার বসবাস।
এরপর থেকেই সপ্তাহে দু-একবার দেখতাম তাকে। কখনো রিকশায়, কখনো পায়ে হেঁটে যাচ্ছে। আমাদের কলোনিতে তখন নতুন এসেছে। ইন্টারমিডিয়েট ফার্স্ট ইয়ারে পড়ছে। অবাক করা ব্যাপার কয়েক মাস পরে খেয়াল করলাম, সকাল সন্ধ্যা তার আসা যাওয়ার সময় যন্ত্রমানবের মতো আমি অটোমেটিক্যালি আমাদের ব্যালকনিতে গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে থাকি। রাস্তার দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করছি!
অপেক্ষা শব্দটা আমার চরম বিরক্তিকর মনে হতো। আমি এই শব্দটাকে কোনো সময় হোল্ড করতে পারিনি। প্রণয়ের গন্ধ পেলেই বৃক্ষ যেখানে সজীব হয়ে ওঠে সেখানে রক্ত মাংসে গড়া মানুষের কাছে অপেক্ষা শব্দটা কেমন তা বলার প্রয়োজন পড়ে না।
বন্ধুদের প্রেম ভালোবাসার টিপস দেওয়ার ক্ষেত্রে আমি ছিলাম বরাবরই পটু। কিন্তু আমার নিজের ক্ষেত্রে দেখলাম সম্পূর্ণ উল্টো। ভিতুর ডিম। কতবার যে তার সামনে গিয়েছি তার কোনো ইয়ত্তা নেই। একটা শব্দ বলতে পারিনি। সে সামনে আসলেই মনে হয়, আমার মুখের ভেতরে ক্লাস্টার বোমার বিস্ফোরণ ঘটালেও যেন টু শব্দটা বের হবে না। বলব বলব করে আর বলা হয়ে ওঠে না।
প্রায় এক বছর পরের কথা। বাড়ির উঠানে কাজিনদের সঙ্গে ক্রিকেট খেলা শেষে থ্রি-কোয়ার্টার প্যান্টের সঙ্গে হাফহাতা টি-শার্ট পরে রাস্তায় বের হতে দেখি কাঁধে কলেজব্যাগ ঝোলানো ফাহমি হেঁটে আসছে। সম্ভবত কলেজেই যাচ্ছে। তখনই মাথাই এল আজকেই যে ভাবে হোক তার সঙ্গে কথা বলতেই হবে। সামনে আসতেই আমি কিছুটা নার্ভাসনেস নিয়ে বললাম, হাই আমি রাশেদ।
জি আমি জানি।
তাই নাকি, কেমনে?
আপনার কাজিন মুনতাহা আমার ক্লাসমেট।
ফিল করলাম আমার ভেতর কনফিডেন্স কিছুটা গ্রো করছে। বললাম, আমি তোমাকে তুমি করেই বলছি, মাইন্ড করছ না নিশ্চয়। তা তোমার নাম কি?
মাইন্ড করার কি আছে, আমার নাম ফাহমিদা ফাহমি।
বাহ, খুব সুন্দর নাম তো, আমি এই গলিতেই থাকি। এই তো দু-চার বিল্ডিং পরেই আমাদের বাড়ি।
আমি জানি। মুনতাহা আপনার কথা প্রায় বলে থাকে। রাশেদ ভাই হ্যান, রাশেদ ভাই ত্যান, হি হি হি...।
আমিও হেসে বললাম, বাই দা ওয়ে, ফাহমি তুমি নিশ্চয় ফেসবুক ইউজ কর। তোমার আইডি নামটা বলবা? যাতে তোমাকে অ্যাড করতে পারি।
সরি, আইডিতো দেওয়া যাবে না। সবাইকে তো আর আইডি দেওয়া যায় না। ফাহমি হাসি মুখে বলল।
সকালের এক চিলতে সোনারোদ এসে পড়া মুখের যে হাসিটা এতক্ষণ পৃথিবীর সবচেয়ে টাচি স্মাইল মনে হচ্ছিল তা তখন মনে হচ্ছে ঘসেটি বেগমের নিষ্ঠুর হাসি। মনে মনে বলি, এ রকম কিউট মেয়েদের এত কঠিন হওয়াটা স্যুট করে না। আচমকা জেঁকে ধরা নার্ভাসনেস বুঝতে না দিয়ে বললাম, ঠিক আছে তোমার আইডি কাউকে দেওয়া না দেওয়ার এখতিয়ার সম্পূর্ণ তোমার। এটা কোনো ব্যাপার না। ওকে ফাহমি, তোমার সঙ্গে কথা বলে অনেক ভালো লেগেছে।
আমি যেই না বাই বলে যাওয়ার জন্য পেছন ফিরি তখনই আবার ফাহমির কণ্ঠ। আমার আইডির নাম ফাহমি সিটিজি...। যে ছেলে সামনে এসে কিছু বলার সাহস পায় না, শুধু শুধু ঘরের জানালা দিয়ে চুরি করে দেখে, তাকে আমার আইডি দেওয়ার ইচ্ছা টোটালি ছিল না। এরপরও আপনাকে দিলাম। ফাহমির মুখে হাসি।
তাই নাকি। থ্যাংকস এ লট ফাহমি। বললাম আমি। কিন্তু লজ্জায় আমি গুটিশুটি মেরে যাচ্ছিলাম।
শুনুন, আপনি অনেক দূর চলে এসেছেন তো খালি পায়ে। বলল ফাহমি।
সমস্যা নেই। মনে মনে বললাম আসুক না এ রকম খালি পায়ের সকাল বারবার। তারপর ফাহমিকে বাই বলে বিদায় নিলাম।
সেদিন ফাহমির সঙ্গে প্রথমবারের মতো কথা বলে মনে হচ্ছিল, ওয়াও, কী রকম ঝলকে ওঠা কণ্ঠ। শ্যামলা মেয়েটি শুধু কিউট তাই নয়, কথাও বলতে পারে দারুণ ভঙ্গিমায়। তখন থেকে দিনের চব্বিশটা ঘণ্টাই কানে লেগে থাকে ওই মুগ্ধতার ফ্লেভার। আর কানে বাজতে থাকে—যে ছেলে সামনে এসে কিছু বলার সাহস পায় না, শুধু শুধু ঘরের জানালা দিয়ে চুরি করে দেখতে থাকে, তাকে আমার আইডি দেওয়ার ইচ্ছা টোটালি ছিল না।
তারপর থেকে সব ইজিলি হতে থাকে। ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠানোর পর অ্যাকসেপ্ট করা। একে অপরের স্ট্যাটাস কিংবা ছবিতে লাইক, কমেন্ট, ইনবক্সে হাই হ্যালোর সঙ্গে একে অপরের যাপিত জীবনের খুঁটিনাটি জেনে নেওয়া। মাঝে মধ্যে হ্যাং-আউট করা। ছোটখাট গিফট দেওয়া নেওয়া। আসলে ভালো লাগাটা আশ্চর্য এক গতিময়তার নাম। যা কারও হাত ছাড়া নিজস্ব ভঙ্গিতে উন্মোচিত হয়। দূরত্বই পথের সৃষ্টি করে। পথ থেকে পথ গড়ে দেয়।
আমার ভালো লাগার বিষয়টা ফাহমিকে বলার জন্য মুখিয়ে ছিলাম। কীভাবে বলব বুঝে উঠতে পারছিলাম না। ভয় ছিল পাছে রিলেশনে জড়াতে না চায় কিংবা ইগনোর করে দেয়। একদিন আমরা ফেসবুকে চ্যাটিং করছিলাম।
আমি লিখলাম, জন্ডিসে আক্রান্ত নিঃসঙ্গ নগরীর নিষ্প্রাণ রাস্তায় কোনো একদিন অবহেলায় নিঃশব্দে নিরুদ্দেশ হব।
ফাহমি লিখল, সোডিয়ামের আলোয় আলোকিত নগরীর মধ্যরাতের হলদেটে রাস্তাগুলোর নিঃসঙ্গতা আমারও খুব প্রিয়, আমাকে সাথে নিবা?
আমার ভেতরের আমি কিছুটা ঝাঁকুনি খেয়ে উঠি। বুঝেশুঝে রিপ্লাই করছ তো? আবার ইনবক্স করলাম। উড়তে চাইলে চল দুজন এক আকাশে উড়ি।
উত্তর এল, তখন না হয় হয়ে যাব একই রঙের ঘুড়ি।
ঝাঁকুনিটা আরও একটু প্রবল ভাবে খেলাম। মনে মনে ভাবছি, ফাহমি কি সিরিয়াস! লিখলাম, বউ পালানো জ্যোৎস্না রাতে শ্যামলাটে কোনো এক তরুণীকে মায়াবতী বলে ডাকতে ইচ্ছে করছে।
আমি কি হতে পারি তোমার সে মায়াবতী?
ওয়াও! আমি তো এটাই চাচ্ছিলাম।
আমি জানি।
একটা কথা বলি।
বল।
আই লাভ ইউ!
আই লাভ ইউ টু! লিখল ফাহমি।
ভালোবাসি কিনা প্রকাশ করার জন্য আসলে বিলবোর্ডের প্রয়োজন হয় না। ভালোবাসা প্রকাশ করতে হয় না, ভালোবাসা নিজে থেকেই প্রকাশিত হয়। অনেক দিন মিশতে মিশতে আমি বুঝে ফেলেছিলাম ফাহমিও আমার প্রতি ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়েছে। ফাহমি খুব মিষ্টি না বিরক্তিকর তা নিয়ে আমার মাথা ব্যথা ছিল না। গায়ের রং ফরসা না উজ্জ্বল শ্যামলা তাও পরখ করে দেখিনি। ফাহমির নামে চিটাগাং শহরে ফ্ল্যাট-জমি আছে কিনা তাও হিসাবের চৌহদ্দির বাইরে রেখেছিলাম। বরং খোঁজ নিয়েছি সে পায়ে নূপুর পড়ে কিনা। জ্যোৎস্না দেখে তার আবেগ উপচে পড়ে কিনা কিংবা রবীন্দ্র সংগীত ছেড়ে দিয়ে জানালার গ্রিলের ফাঁক দিয়ে হাত বাড়িয়ে বৃষ্টি ছুঁয়ে দেখে কিনা এসব।
মুডি প্রিয় মানুষটার সঙ্গে কাটানো কিছু মোমেন্টাম এমন হয় যা নামি ব্র্যান্ডের পারফিউমের মতো অনেকক্ষণ অনেক দিন মনের গলি ঘুপচিতে ইতিউতি করতে থাকে। সৌরভ ছড়াতে থাকে। আমার কাছে সুখানুভূতির ডেফিনেশন হচ্ছে এটাই। এর আগে ইনবক্সে আড্ডার ঝড়ে মিউচুয়ালি তা দিয়েছিলাম অসংখ্যবার। কিংবা একসঙ্গে কত জায়গায় কতবার ঘুরেছি তার হিসাব নেই।
কিন্তু কেন জানি পয়লা বৈশাখের দিনে তার সঙ্গে কাটানো চার-পাঁচ ঘণ্টার মুহূর্তটাই ছিল আমার কাছে প্রচণ্ড রকমের আনন্দের। লাল পেড়ে সাদা শাড়ির সঙ্গে ম্যাচ করা হাত ভরা কাচের চুড়ি। আর কপালের ঠিক মাঝখানটাই বসানো লাল টিপটা প্রচণ্ডভাবে বাঙালিয়ানা উঁকি দিচ্ছিল। ওই দিনই প্রথমবারের মতো একসঙ্গে আমরা হুড তোলা রিকশাই চষে বেড়িয়েছিলাম দু নম্বর গেট ধরে প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে জিইসির মোড়ের অলিতে গলিতে। ওই দিনই প্রথমবারের মতো পরস্পর হাত ধরে পাশাপাশি হেঁটেছিলাম। কয়েক ঘণ্টা তার বাম হাতের কনি আঙুল আমার ডান হাতের কনি আঙুলের সঙ্গে লেপটে ছিল! এই অভাবনীয় মুহূর্তটা কেমনে ভুলি।
যত দিন যাচ্ছে ততই আমাদের সম্পর্কের ব্যাপ্তি বাড়তে থাকে। মিউচুয়াল রেসপেক্ট ও বিশ্বাসের পারদ ওপরে উঠতে থাকে। স্বপ্নের মতোই চলছিল আমাদের রিলেশন। আমরা গড়ে নিয়েছিলাম নিজস্ব একটা জগৎ। আমাদের মতো করেই। আমরা বুনতে থাকি আমাদের আগামীর স্বপ্ন। তত দিনে ফাহমির ইন্টারমিডিয়েট ফাইনাল শেষ আর আমি অনার্স থার্ড ইয়ারের ফাইনাল দেব। একদিন ফাহমির ফোন, ছেলেপক্ষ আগামীকাল আমাকে দেখতে আসবে। আর তুমি বসে বসে আঙুল চোষ। রাশেদ প্লিজ কিছু একটা কর।
কি সব আবোল তাবল বলছ। কদিন আগেই না বললে আগামী চার বছর কোনো সমস্যা হলে তুমি নিজেই সামলাবা।
সামলানোর জন্য সময় পেলে তো! আজকে হঠাৎ বড় ভাবি আমাকে বলছে, আগামীকালকেই আমাকে দেখতে আসছে। ছেলে আমাদের দূর সম্পর্কের রিলেটিভ! ব্যাংকক সুপার মার্কেটে ছেলের বাটা বাজারের শোরুম আছে। আব্বুর ভাব গতি সুবিধার মনে হচ্ছে না। প্লিজ তাড়াতাড়ি কোনো একটা পথ...ফাহমির কথা শেষ করার আগেই মোবাইলের অপর প্রান্তে ভরাট পুরুষালি কণ্ঠে ওর বাবার বকাবকি। কে? কার সাথে কথা বল? তোমাকে না বলছি রাশেদের সাথে যোগাযোগ না করতে। কথা কানে যায় না। এদিকে দাও মোবাইল। হ্যালো কে? হ্যালো! কথা বল না কেন রাশেদ?
জি আঙ্কেল স্লামালাইকুম, কেমন আছেন?
তুমি আর ভালো থাকতে দিচ্ছ কই। তুমি বারবার ফাহমিদার মোবাইলে ফোন দাও কেন? কি ব্যাপার, কোনো সমস্যা?
না আঙ্কেল, কোনো প্রবলেম নেই, বাট আমি...আমরা...।
কি সব আমি আমরা করছ। শোন বাবা তুমি যদি ফাহমিদাকে পছন্দই করে থাক তো তোমার মুরব্বিদের আমাদের বাড়িতে আসতে বল।
আঙ্কেল আমার স্টাডি কমপ্লিট করতে আরও দু-তিন বছর সময় লাগবে। এই অবস্থায় কি ভাবে...। আমাদের যদি কিছুটা সময় দিতেন প্লিজ?
এই তো, এই কথাই তো আমি তোমাদের বোঝাতে চাইছি। তোমরা এখনকার পোলাপান নিজেকে গড়ে তোলার আগে কি সব রিলেশন ফিলেশন করে বসে থাক। আগে নিজেকে গড়ে তোল তারপর অন্য কিছুর চিন্তা ভাবনা কর। শোন বাবা, তুমি আমার ছেলের বয়সী, তোমাকে হাত জোড় করে বলছি আর একটি বারের জন্যও ফাহমির সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করবে না। আমার মেয়েকে ভালো ঘরে বিয়ে দিতে দাও, প্লিজ।
ফাহমির বাবাই ফোনের লাইন কেটে দিলেন। আমি উদভ্রান্তের মতোই বসে থাকি। মনে হচ্ছিল পৃথিবীটা একটা লাটিম! আমার মাথার ওপরের পৃথিবীটা শো শো করে ঘুরছে। কি করব বুঝে উঠতে পারছিলাম না। একটু পরে স্বাভাবিক হয়ে ফাহমির ফোন কলের জন্য অপেক্ষা করতে থাকি। এক, দুই, তিন ঘণ্টা ধরে অপেক্ষা করছি, কখন সেই চিরপরিচিত নম্বরটা মোবাইলের স্ক্রিনে ভেসে উঠবে। এক সময় অপেক্ষা শব্দটা সাপের মতো চামড়া বদলে আবারও তার নিজস্ব রূপ ধারণ করা শুরু করছে। কোনো গতি না দেখে আমি নিজেই কল দিই। অপর প্রান্ত থেকে ভেসে আসে দ্য নাম্বার ইউ হ্যাভ কলিং ক্যান নট বি রিচড অ্যাট দিজ মোমেন্ট। একটু পর পর ফোন করি আর ভেসে আসে একই শব্দ। একদিন পর জানতে পারলাম, ফাহমির পুরো ফ্যামিলি গ্রামের বাড়ি বগুড়া চলে গেছে।
তারপর থেকে দিনের চব্বিশ ঘণ্টায় হাজার বার মোবাইলে দেখতাম ফাহমির কল কিংবা মেসেজ আছে কিনা? ফেসবুকের ইনবক্স চেক করতাম ফাহমি অ্যাকটিভ হয়েছে কিনা। না আসে না কোনো মেসেজ কিংবা কল। এভাবে প্রায় নয় দিন কাটানোর পর রাত একটার দিকে আমার মোবাইলে অপরিচিত একটা নম্বরের কল রিসিভ করতেই ফাহমির কণ্ঠ কাল আমার বিয়ে। তুমি কিছুই করলে না বিয়ে ঠেকানোর জন্য। আমি তোমাকে জীবনেও মাফ করব না বলেই ডুকরে কেঁদে ওঠে।
আমি সেই মুহূর্তে কি আর বলব? আমি বাকরুদ্ধ। আমার বুক ফেটে যাচ্ছে। আমার স্বপ্নিল মায়াবতী হারিয়ে যাচ্ছে আসলেই আমি কিছুই করতে পারছি না। নিজেকে কাপুরুষ মনে হচ্ছিল। সীমাবদ্ধতা নামক শব্দটি মানুষকে কখনো কখনো এমন ভাবে কোণঠাসা করে ফেলে মুহূর্তেই মুখের ভাষা হারিয়ে ফেলে। চোখের জলই তখন শুধু কথা বলে।
সবারই একটা না বলা গল্প থাকে। সেই গল্পের খবর কেউ জানে না, কেউ রাখে না। সবাই নিজস্ব গল্পের একটা হ্যাপি এনডিং রাখতে চায়। আমি বরাবরই স্বপ্নবাজ টাইপের ছেলে। আমার না বলা গল্পের শেষটা এমন হোক তা আমি চাওয়ার প্রশ্নই আসে না বলেই কিনা বাইটা আমি ইচ্ছে করে বলিনি ফাহমিকে। ফাহমি তো আমার জীবন থেকে হারিয়ে যাচ্ছে না। আমি শুধু শুধু বাই বলব কেন? তা ছাড়া আমি অপ্রাপ্তি শব্দটাতেই বিশ্বাসী না। বড় জোর আমি একে শূন্যতা বলতে পারি। শূন্যের অস্তিত্ব, আকৃতি, গতি-প্রকৃতি ও ব্যাপ্তিও আছে। মজার ব্যাপার, পূর্ণতাকে ধারণ করবার মতো গর্ভাশয়ও আছে। শূন্যতা মানেই অপেক্ষা আর অপেক্ষা মানেই বেঁচে থাকা। সুতরাং বুকের ভেতর শূন্যতা নিয়ে হতাশার কিছু নেই। শূন্যতার পুরোটা জুড়েই লুকিয়ে থাকে জীবন।
বর্ষা শুরু হলেই ফাহমিকে খুব মিস করি। নস্টালজিক হয়ে পড়ি। বৃষ্টিস্নাত বিকেলে হুডখোলা রিকশায় খোলা চুলে বসে থাকা শ্যামলাটে সেই তন্বী মেয়েটির বৃষ্টি ছুঁয়ে দেওয়ার অসাধারণ দৃশ্যটি এখনো আমাকে খোঁচা দেয় প্রতিনিয়ত। চুপচাপ রাস্তায় টুপটাপ বৃষ্টির শব্দে এখনো ফাহমি আসার গন্ধ পাই। ফাহমি হারিয়ে যাওয়ার নয়।

(লেখক সৌদি আরবের জেদ্দাপ্রবাসী)