হাতের পাঁচ আঙুল সমান না

বরাবর আমার অনেক বন্ধু। তারা একেকজন একেক রকমের। ‘একেক রকমের’ কথাটা দিয়ে হয়তো তেমন কিছু বোঝানো গেল না, কারণ ‘অভিন্ন যমজ’ ছাড়া মানুষ এক রকম হবে না। কেউ পাতলা কেউ মোটা, কেউ বেশি কথা বলে, কেউ কানে হেডফোন লাগিয়ে সারা দিন সন্দেহজনক কী যেন শোনে!
আজ যার সম্পর্কে বলব, তার গুণ যত, দোষ ঠিক তত। সে যুক্তিবিদ্যা ও বিজ্ঞানের ওপর ভীষণ আস্থা রাখে। তাকে একটা ফ্যাশন শো আর বিজ্ঞান মেলার মধ্যে পছন্দ করার সুযোগ দিলে, সে নির্ঘাত বিজ্ঞান মেলায় যাবে। তার দৃশ্যমান দোষ হচ্ছে, সে কূটতর্কে খুবই পারদর্শী। কিছুদিন পরপর নতুন একটা ভড়ং ধরে সে। যেমন হঠাৎ কালো কফি খাওয়া শুরু করল, এতে নাকি নিজেকে আমেরিকান আমেরিকান মনে হয়। ইদানীং আবার করলার জুসের সঙ্গে আদা আর কী কী মিশিয়ে ‘সুপার ফুড’ নাম দিয়ে খাওয়া শুরু করেছে। আরও বহু দোষ আছে, কিন্তু কারও পেছনে তার দোষ ধরতে নাই। সে এই লেখাটা কোনোদিন পড়বে না, পড়লে তার পেছনে বলা হতো না। তা ছাড়া দোষ-গুণের বিচার করার আমি কেউ নই। তাই দোষ-গুণ বাদ দিয়ে ঘটনাটাই খুলে বলি। একদিন সে জানাল, হাতের পাঁচ আঙুল সমান নয় বললেই বিষয়টি শেষ হচ্ছে না। আঙুলগুলো কতটুকু অসমান, তাও একটা চিন্তার বিষয় হতে পারে। সব মানুষের অনামিকা ও কনিষ্ঠা আঙুলের দৈর্ঘ্যের অনুপাত সমান নয়। অনামিকা কনিষ্ঠা থেকে বড় হয় ঠিক, কিন্তু কত বড়? সবার কি একই অনুপাতে বড়? তা নয়। মেয়েদের অনুপাত কম। ছেলেদের অনুপাতটা একটু বেশি। একটু অবাক হয়ে তানিমের (ছদ্ম নাম) দিকে তাকালাম। এত দিন পাঁচটা আঙুল সমান হয় না জানতাম, এ তো দেখি আবার বলছে কতটুকু অসমান তাও নাকি একটা বংশগতির রহস্য। সেটাও নাকি সে জেনেছে জিনের বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা থেকে!
তানিম ঘোর কবিতা বিদ্বেষী লোক। সে জিনের বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা করতে প্রস্তুত হয়ে গেল। প্রথম ভাগে আসবে ‘বংশগতি’- পূর্বপুরুষের বৃত্তান্ত। তারপর আসবে তার নিজের বৃত্তান্ত, কোন কোন রোগ-শোক হওয়ার সম্ভাবনা বেশি, লোকটা কী ধাঁচের হবে- এই সব। তানিমের দাদার দাদা, মানে অনেক আগের পূর্ব পুরুষ, বনেদি (!) কোনো দেশ থেকে এসেছিলেন বলে নাকি জোর গুজব চালু আছে। তার মতে তাঁরা ফারসি ভাষায় কথা বলতেন, দেখতে টকটকে ফরসা ছিলেন। তাঁদের ‍সঙ্গে আমাদের মাটি-ময়লা জনগণের মিলত না। এদিকে আবার তানিমের সহকর্মী বাক্যবাগীশ জর্জ ‘টুয়েন্টি থ্রি অ্যান্ড মি’তে (যে কোম্পানি জিনগত পরীক্ষা করে) নমুনা পাঠিয়েছে শুনেই বক্তৃতা শুরু করে দিল তানিম। আমি জানি তোমার ‘উৎস ইতিহাস’ কি আসবে। নব্বই ভাগ আইরিশ আসবে, এই লিখে দিলাম। কিভাবে কিভাবে যেন আমাদের সবারই ‘উৎস ইতিহাস’ আইরিশই আসে। কত পণ্ডিতের কত কথা!
রিপোর্ট আসার পরে দেখা গেল, তানিমের কপালে কিছুই জোটেনি। না তুরান, না বাগদাদ। চুরানব্বই দশমিক পাঁচ ভাগ ‘দক্ষিণ এশীয়’। তারপর সামান্য একটু পূর্ব এশিয়াও আছে। এ আর কী এমন হলো? আজকে খাবারের মেন্যু কী, আগ্রহের সঙ্গে এটা জিজ্ঞেস করার পর ডাল আর আলু ভর্তা শুনলে যেমন লাগে, তানিমের মুখভাব তেমন দেখা গেল।
তারপর এল অসুখের বৃত্তান্ত। ব্লাড ক্যানসার, ডায়বেটিস এমন সব অসুখের সহজবোধ্য নাম পাওয়া গেল না। খটমটে নাম একেকটা। তানিম বহু কষ্ট করে পড়ছে, ‘অটোসোমাস রিসেসিভ পলিসিস্টিক কিডনি ডিজিজ’; হবে কি হবে না, তা লেখা নেই, পাশে লেখা ‘ভ্যারিয়েন্ট নট ডিটেক্টেড’। চালাক তো! হবে না বলবে না, বলবে ‘ভ্যারিয়েন্ট’; পাওয়া যায়নি। হওয়ার কথা ছিল না, কিন্তু একেবারে যে হবে না, তাতো বলিনি? যাই হোক, এই পাওয়া যায়নির তালিকা বেশ লম্বা, শুধু একটা পাওয়া গেল ডিটেক্টেড, সঙ্গে লেখা আছে, ‘নট মোর দ্যান অ্যাভারেজ রিস্ক’। সান্ত্বনা দিয়ে রেখেছে আরকি। কারণ টাকার বিনিময়ে দুঃসংবাদ দিলে সে বিজনেস কি টিকবে? রোগটার নাম ‘ম্যাকুলার ডিজেনারেশন’; আমি বা তানিম বাপের জন্মে শুনিনি।
এতগুলো অসুখের মধ্যে শুধু একটার সম্ভাবনা থাকলে খুশিই হওয়ার কথা। তদুপরি মারাত্মক কিছু শোনাচ্ছেও না। চোখের সমস্যা, কি যেন পর্দার মতো পড়তে পারে শেষ বয়সে- এ রকম। তানিম মন্তব্য করল ছানিটানি হবে বোধ হয়। তারপর সে খুশি মনে বলল, ‘এ আর কি? আমার নানা, সেই তিরিশ বছর আগে, চক্ষু শিবিরে গিয়ে তাঁবুর মধ্যে অপারেশন করে নিয়েছিলেন। এক সপ্তাহ পরেই ভালো। আমারটা ধরলাম আরও বিশ বছর পরে হলো। এই বিশ বছরে বিজ্ঞান যদি জ্যামিতিক হারে অগ্রসর হয়, তাহলে ডাক্তার চোখের ওপরে একটা যন্ত্র বুলাবে, অনেকটা জাদুর কাঠির মতো, এক মিনিটের মাথায় বলবে চোখ খোলো। তখন ছানিগ্রস্থ লোকটা আবার সব পরিষ্কার দেখতে পাবে। আগের চেয়েও বেশি পরিষ্কার। বাতাসে যে ভাসমান ধূলিকণা থাকে, যা সে জীবনেও দেখেনি, সেটাও দেখতে পাবে, বুঝলি?’ বলে সে হাসতে থাকল।
জিনের ধাঁচের মধ্যে যা লেখা আছে তা মানুষের ছাঁদ হয় আগে জানতামই না। বিশেষ একটা গন্ধ মানুষটা পাবে কিনা, তারপর তিতা স্বাদটা জিভে বেশি লাগবে না কম, মিষ্টি না নোনতা কোন খাবার পছন্দ করবে, এসব বলা আছে। তারপর আছে আঙুলের কথা। তানিম সগৌরবে তার হাতের তালু পেতে দেখাল তার অনামিকা তর্জনীর থেকে অনেক লম্বা। সেটাও ওখানে লেখা আছে। সে তাৎপর্যপূর্ণ হাসি হাসল। তার মানে অনামিকা লম্বা হলে কি হয়, সেটাও একটা বিজ্ঞান। জোড়া শালিক দেখার মতো কুসংস্কার নয়, রীতিমতো জিনগত বিজ্ঞান! কোষের ভেতরে ক্রোমোজোম, ক্রোমোজোমের ভেতরে জিন, সেখানেই প্রোটিনের অক্ষরে মানুষটার নীলনকশা দেওয়া আছে। পড়তে পারলে অনেক কিছুই জানা যাবে। তবে রিপোর্টটা পড়ে দু-একটা মজার জিনিস পাওয়া গেলেও মনে হলো, ব্যবসায় উন্নতি, বিদেশ গমন (যদিও আমরা দুজনেই বিদেশে), নারীভাগ্য, এই সব থাকলে আরেকটু ভালো হতো। কিন্তু করলার জুস খাওয়ার রহস্য ভেদ করতে পেরে তানিম খুবই উত্তেজিত, যেন সে এই পরীক্ষা টার পিছনে যে টাকা খরচ করেছে, তা এই একটা তথ্যেই দ্বিগুণ উশুল হয়ে গেল।
‘ম্যাকুলার ডিজেনারেশন’ ব্যাপারটা ছানি ছিল না। গুগল করে দেখলাম, ভয়ংকর রোগ; পুরা অন্ধ হয়ে যেতে হবে। কোনো চিকিৎসা নেই। চিকিৎসার বর্ণনার বদলে সেখানে অন্ধ লোকদের কোথায় কোথায় সাহায্য দেওয়া হয়, সেই সব জায়গার নাম-ঠিকানা লেখা আছে। তানিমকে কিছু জানালাম না। ভাবলাম টাকা দিয়ে এমন খবর কে সেধে নিয়ে আসে? হোক বা না হোক, একটা বাড়তি দুশ্চিন্তা এসে জুটল। আমি না বললেও তানিম ব্যাপারটা উদ্‌ঘাটন করল এবং নিজেই পরে ফোন করে ব্যাপারটা জানাল। সে মোটেও বিচলিত নয়। তারপর সে হঠাৎই নতুন উৎসাহে শুরু করল, শতকরা যে এক-দুই ভাগ ‍উৎস ইতিহাস জানা বাকি ছিল, সেখানে নাকি মজার তথ্য পাওয়া গেছে। তার সঙ্গে আমেরিকার রেড ইন্ডিয়ানদের যোগ আছে। কারণটা হলো দক্ষিণ এশিয়া থেকেই মানুষ পাড়ি জমায় আজকের আমেরিকায়, সেটা প্রায় দশ হাজার বছর আগে। কাজেই তারা আমাদেরই জ্ঞাতিগুষ্টি। আরেকটা খোঁজ পাওয়া গেছে। ইয়াকুত নামের এক জাতি, যারা রাশিয়ার সাইবেরিয়া অঞ্চলে থাকে; তাদের এলাকার নাম ইয়াকুতিয়া- তাদের ‍সঙ্গে নাকি তানিমের ‘উৎস ইতিহাসের’ যোগ আছে। প্রায় সাত পুরুষ আগে তানিমের পূর্বপুরুষেরা ইয়াকুত থেকে এসেছে। সাল পর্যন্ত লেখা। সেটা হলো ১৭৯০। ইয়াকুতের নাম প্রথম শুনলাম। কী সব তথ্য! কোষের মধ্যে আণুবীক্ষণিক ইতিহাস বই লুকানো আছে নাকি? আইরিশ না হলেও, ইয়াকুতের সঙ্গে যোগসূত্র বের হওয়ায় তানিম একটা নতুন রহস্যের গন্ধ পেল, যেটার পিছনে সে এখন বহুদিন লেগে থাকবে। এরপর সে আমাকে একই পরীক্ষা করার জন্য বিভিন্নভাবে প্ররোচিত করতে থাকে। আমার তখন জীবননান্দ দাশের একটা কবিতার লাইন মনে হলো- ‘কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে!’ শেষ বয়সে অন্ধ হয়ে যাওয়ার সামান্যতম সম্ভাবনার কথা যেখানে লেখা থাকে, তার সম্পর্কে জীবনানন্দ হয়তো বলতেন- ‘কে হায় ডিএনএ খুঁড়ে দুঃসংবাদ জানতে চায়!’ নাহ, সে কাজ কিছুতেই করা যাবে না।

হার্নডন, ভার্জিনিয়া