হাতবদল

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

করিমনের জীবনটা ভাসমান কচুরিপানার মতো। শিকড় মাটির নিবিড় সান্নিধ্য পায় না। শিকড়হীনতার অভিশাপ মাথায় নিয়ে বাস্তবতার ধাক্কায় সে একবার এদিক, আবার আরেক ধাক্কায় ওদিক ভেসে বেড়ায়। মাথার ওপর আশ্রয় নামের নির্দিষ্ট কোনো ছাদ নাই করিমনের। অস্থায়ীভাবে মায়ের কাছে কয়েকটা দিন কাটিয়ে ফের ফুফুজানের ডেরায় ফিরতে হয়।

এভাবে ঘুরেফিরে তার উপস্থিত হওয়াটা কোনো পক্ষই সাদরে নেয় না। ফুফুজানের ব্যবহারটা মেনে নিতে বাধ্য হলেও নাড়ির সম্পর্ক থাকা মানুষটার স্পষ্ট উপেক্ষা হজম করতে করিমনের কষ্ট হয়। তখন ওর বড় বড় চোখজোড়া ভরা বর্ষার টানে ভেসে যাওয়া নদী হয়ে উঠতে চায়।

কিন্তু করিমন বুক ভাসিয়ে কাঁদেকাটে না। গোপনীয়তার বাঁধে কান্নাদের আটকে দিয়ে নির্বিকার থাকার ভান করে। বাস্তবতা করিমনকে অল্প বয়সেই জীবনের কিছু দামি পাঠ শিখিয়েছে। কান্না গোপনের বিদ্যা সে পাঠতালিকার একটা।

এমন জীবনের ওপর করিমনের নিজের কোনো হাত ছিল না। অথচ ভোগান্তির ষোলো আনাই তাকে পোহাতে হয়। এই বাস্তবতার জন্য দায়ী হৃদয়হীন এক মানুষ। মনে মনে যাকে বাপ বলতেও করিমনের তীব্র অনীহা। পাষণ্ড লোকটার কারণেই তাদের দুই বোনের উদ্বাস্তু মেঘেদের জীবন।

মা আর ওদের দুই বোনকে ছেড়ে বাপটা চলে যাওয়ার পর তাদের আর কোনো খোঁজখবর রাখেনি। তার কয়েক মাসের মধ্যে করিমনের মা-ও বিয়ে বসে। বিয়ের আগে মায়ের হবু স্বামী সাফ জানিয়ে দিয়েছিল, দুই মেয়েকে পোষা তার পক্ষে সম্ভব নয়।

করিমনকে নিয়ে মা পড়ে বিপদে। নতুন সংসারের বাসনার কাছে আত্মজা তখন যেন মূর্তিমান সমস্যা। চোখ-কান বুজে কোথাও সে সমস্যা তখন ঝেড়ে ফেলতে পারলেই স্বস্তি। তাই করেছিল করিমনের মা—লতিফা। সাবেক স্বামীর বোন ফরিদার প্রায় হাতেপায়ে ধরে মেয়েটাকে রাখার জন্য রাজি করিয়েছিল। ফুফুজানের কাছে করিমনকে রেখে ছোট বোনকে সঙ্গে নিয়ে মা নতুন সংসারে চলে যায়।

সেই থেকে ছি-ছিক্কার সয়ে করিমন এখানে আছে। ফুফুর সংসারে হাড়ভাঙা পরিশ্রমে করিমনের আপত্তি ছিল না। বসে খাওয়ার কপাল নিয়ে যখন আসেনি, তখন খাটুনি দিয়েই সেটা উশুল করা লাগে। এই বাস্তবতা করিমন খুব ভালো বোঝে। ওর সমস্যা দুশ্চরিত্র ফুফা আর ফুফাতো ভাইকে নিয়ে। ওর কচি শরীরটা ঘিরে দুজন পাষণ্ডের ছোঁকছোঁকানিতে। করিমনকে সর্বক্ষণ কুঁকড়ে থাকতে হয়। বাজপাখির থাবা থেকে ভীত মা-পাখি যেমন তার ছানাকে বাঁচানোর চেষ্টায় তটস্থ থাকে, করিমনকেও সেভাবে নিজেকে আগলে রাখার চিন্তায় অস্থির থাকতে হয়। আপনা মাঁসে হরিণা বৈরী অবস্থা করিমনের।

মাঝেমধ্যে মনে হয় ফুফুজানকে তার গুণধর স্বামী আর ছেলের ইতরপনা খাসলতের কথা বলে দেয়। কিন্তু তার কথা যদি বিশ্বাস না করে, তাহলে এই আশ্রয়টা তাকে হারাতে হবে। এমন আশঙ্কায় করিমন মুখ বুজে থাকে। ফুফা আর ভাইয়ের উপদ্রব যখন বেড়ে যায়, করিমন তখন মায়ের সংসারে গিয়ে ওঠে। মা খুশি হয় না একটুও। গিয়ে উঠতে না উঠতেই বেজার মুখে জানতে চায়, সে কবে ফুফুর কাছে ফিরে যাবে। করিমনের বুকে কান্নার ঢেউ উথলে উঠতে চায়। অভিমানে ঘন হয়ে আসা মন নিয়ে ভাবে, তার মা কেন মেয়ের অসহায়ত্বটুকু বুঝতে পারে না?

দুই.

গেল সপ্তাহের মধ্যে দুই দফা বোনের বাড়ি ঘুরে গেছে রহিম মৃধা। বোনের বাড়িতে ভাই আসতেই পারে। প্রথম দিন অক্ষম একটা রাগে জ্বলেছে করিমনের শরীর-মন দুটোই। কিছুতেই সে লোকটার সামনে যেতে রাজি ছিল না। যে বাপ অতীতে তাদের খোঁজটুকু নেওয়ার প্রয়োজন মনে করেনি, তার হঠাৎ আগমনের হেতু ঠাওর হয় না করিমনের। ফুফুজান ঠেলেঠুলে না পাঠালে সে যেচে কিছুতেই গিয়ে দাঁড়াত না পাষাণ মানুষটার সামনে। কিন্তু আশ্চর্য! যে লোকটাকে এত দিন স্বার্থপর, পাষাণ ভেবে এসেছিল, তার স্নেহার্দ্র মধুর ব্যবহার পেয়ে পুষে রাখা প্রচণ্ড রাগ উবে যেতেও সময় লাগে না করিমনের।

তার গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে, সজল চোখে লোকটা যখন বলে, আমার আম্মাজান কত ডাঙর হইছে। আম্মা গো, এই অধম পোলারে ক্ষমা দেও। তোমাগো কাছে আমি বড়ই শরমিন্দা। আমারে ক্ষমা না দিলে মইরাও শান্তি পামু না আম্মাজান।

বলতে বলতে করিমনের রুগ্‌ণ খসখসে দুই হাত ধরে অত্ত বড় মানুষটা যখন হাউমাউ করে কেঁদে ফেলেছিল। আগুনের আঁচে গলে যাওয়া মোমের মতো করিমনের ভেতরে পুষে রাখা যাবতীয় রাগ-ঘৃণা গলে গিয়ে মানুষটার প্রতি তাকে সহানুভূতিশীল হতে ইন্ধন জোগায়।

অনাদর, অবহেলায় বেড়ে ওঠা করিমনের ভেতরটা বাপের সামান্য স্নেহের স্পর্শে ভোরের শিশিরের আর্দ্রতায় ভিজে উঠতে চায়। সদরের বাজার থেকে কিনে আনা নতুন গুড়ের রসগোল্লা নিজ হাতে মেয়েকে খাওয়াতে থাকা মানুষটার কোমল ব্যবহারের মায়ার কাছে করিমনের বুভুক্ষু মন বিকিয়ে যেতে খুব বেশি সময় নেয় না। হুড়মুড়িয়ে ভেসে যায় বহুদিনের সঞ্চিত অভিমান। দিন কয়েক পর আবার আসবে জানিয়ে বোনের হাতে দুখানায় এক শ টাকার নোট গুঁজে দিয়ে রহিম মৃধা সেদিনের মতো বিদায় নেয়।

ঠিক পাঁচ দিনের মাথায় মেয়ের জন্য এক সেট কাপড়, এক জোড়া স্যান্ডেল নিয়ে দ্বিতীয়বার রহিম মৃধার উপস্থিতিতে শুধু ফুফুজান না, করিমনও বড় বেশি বিগলিত হয়ে পড়ে। রহিম মৃধা এসেই জানায় আজ সে মেয়েকে নিজের রিকশায় চড়িয়ে ঘুরবে। দ্রুত তাকে নতুন কাপড়টা পরে আসতে বলে, ভাইবোন নিজেদের মধ্যে কীসব গুজুর গুজুরে ডুবে যায়। করিমন সেদিকে একঝলক তাকিয়ে কাপড় নিয়ে কলপাড়ের আড়ালে চলে যায়। গায়ে থাকা চিটচিটে জামাটা খসানোর আগমুহূর্তে একবার সে প্রাণভরে নতুন কাপড়ের গন্ধ নেয়। মনে করতে চেষ্টা করে, এমন নতুন জামা শেষ কবে সে গায়ে দিয়েছে। সব কেমন স্বপ্ন স্বপ্ন মনে হয় করিমনের। তার বাপ লোকটা এত ভালো একটা মানুষ হয়ে কেন তবে তাদের ছেড়ে পালিয়েছিল! হিসাবটা করিমন মেলাতে পারে না।

সেদিন যাওয়ার আগে মেয়েকে আড়ালে ডেকে মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে রহিম মৃধা জানায়, আম্মাজান ভাবতেছি তোমারে আর এইখানে রাখুম না। খুব শিগগিরই অন্যখানে নিয়া যামু। নিজের ধারেই রাখতাম। কিন্তু তোমার সৎমায়ের বহুত চোপা গো আম্মা। অশান্তিতে রাখুম না আর আমার আম্মারে। শহরে এক বড়লোক বাড়িত দিয়া আসুম। ভালো বেতন দেব। ভাত-কাপড়ের অভাব থাকব না। তারা মানুষ ভালো। শান্তিতে থাকতে পারবা আম্মা। তয় তোমার আপত্তি থাকলে অন্য কথা। যাইবা বাপের লগে? নাকি ফুফুর বাড়িত আদপ‍ যাট খাইয়া মাগনা বান্দিগিরি করবা?

প্রস্তাবটা পেয়ে করিমনের মনে হয়, বাপজান না চাইতেই আকাশ থেকে চাঁদটা টুপ করে পেড়ে তার হাতে গুঁজে দিল। শহরে কাজের প্রস্তাবটা লুফে নিতে দেরি করে না করিমন। শহরের অচেনা অজানা পরিবেশ তার জন্য কতটা নিরাপদ, সে চিন্তায় না গিয়ে, আসন্ন মুক্তির স্বস্তি না লুকায়ে খলবল করে বাপকে বলে, এইখানথে যত জলদি সম্ভব আমারে নিয়া যান।

তিন.

শহরে যাওয়ার আগে একবার মা আর বোনের সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিল করিমন। সে কথা ফুফুজানকে জানানো মাত্র তিনি কেমন হা হা করে ওঠেন। অন্য সময় মায়ের কাছে পারলে ঠেলে পাঠান। কারণ হিসাবে অবশ্য যে যুক্তি দেওয়া হয়, সেটাও ফেলে দেওয়ার মতো মনে হয়নি করিমনের। ঠিকই তো, মা যদি শহরে যাওয়ার বিষয়ে বাধা দেয়, তখন? যদিও করিমনের মন বলছে মা বরং তার শহরে যাওয়াটা খুশি মনেই নেবে। ছোট বোনটার জন্য করিমনের বুকের ভেতর কেমন এক কষ্ট দাপাদাপি করে। আবার কবে মা আর বোনটাকে দেখতে পাবে, তারও তো কোনো নিশ্চয়তা নাই। ফুফুজানকে নাকি বাপজান জানিয়ে গেছে ছয় মাস অন্তর একবার করে গ্রামে ঘুরে যেতে পারবে করিমন। অলিখিত সেই আশ্বাসের ওপর ভরসা রেখে করিমন চুপ মেরে যায়।

লালের ওপর হলুদ সবুজ ফুল ফুল নকশার কামিজ আর একরঙা হলুদ সালোয়ারে করিমনকে ভারি চমৎকার দেখাচ্ছে। শহরে যাওয়া উপলক্ষে বাপজান আরেক সেট কাপড় কিনে দিয়েছে ওকে। ফুফুজান খুব ঘটা করে জীবনে প্রথমবার করিমনের মাথায় সুগন্ধি তেল দিয়ে ওর জটাধরা চুলের জট খুলে সযত্নে দুটো বেণিতে বেঁধে দিয়েছে। মেয়ের দিকে একঝলক তাকিয়ে রহিম মৃধা মুগ্ধ হয়। বিদায় বেলায় ফুফুজান করিমনকে জাপটে ধরে মরা কান্না জুড়ে দিলে শরীর শক্ত করে দাঁড়িয়ে থাকে করিমন। দুবেলা দুমুঠো ভাতের সঙ্গে নিত্যদিনের পাওনা গালমন্দ আর মাঝেমধ্যে জ্বলন্ত চ্যালা কাঠের স্মৃতিগুলো বড় বেশি জীবন্ত হয়ে করিমনকে আড়ষ্টতায় বেঁধে রাখে। কোনোমতে ফুফু আর তার দোজখ সমান বাড়িটা থেকে বিদায় নিয়ে অনিশ্চিত আরেক জীবন আলিঙ্গনের ইচ্ছায় বাপের হাত ধরে বেরিয়ে আসে করিমন।

মেয়েকে নিয়ে রহিম মৃধা রাজবাড়ীর বাসে ওঠে। বাপ-মেয়ে পাশাপাশি সিটে দুইমুখী চিন্তায় ডুব দিয়ে বসে থাকে চুপচাপ। দুজনের বিপরীতমুখী চিন্তা সুতার গুটলির মতো গড়াতে থাকে যার যার গন্তব্য ধরে।

উদ্বাস্তু জীবনের হেনস্তা আর পিশাচ ফুফা-ফুফাতো ভাইয়ের হাত থেকে মুক্তি পাওয়ায় করিমন স্বস্তি পেলেও অবাধ আনন্দে ভেসে যাওয়ার শক্তি পায় না কেন জানি। ওর ছোট্ট মনের ভাবনায় আপাত মুক্তির আনন্দ প্রজাপতির পাখা জুড়ে দিতে ব্যর্থই হয় বরং। সামনে তার জন্য ঠিক কেমন জীবন অপেক্ষায় আছে, সে নিয়ে মনের মধ্যে তৈরি হওয়া দোনোমোনো ভাবনাটা ওকে কেমন অস্থির করে তোলে। ভেতরের অস্থিরতা ভুলতে চলন্ত বাসের জানালায় চোখ রাখে সে। বাইরের উদার প্রকৃতি কী এক জাদু স্পর্শে খুব অল্প সময়ের মধ্যে করিমনের বুকের কপাট খুলে এই মুহূর্তের যাবতীয় চিন্তা উড়িয়ে নিয়ে যায় বুঝি। দ্রুত সরে যেতে থাকা প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলি দেখতে দেখতে করিমনের চোখজুড়ে নেমে আসে ঘুম। ঘুমের প্রাথমিক স্তর পেরিয়ে খানিক পরে গাঢ় ঘুম ওকে টেনে নেয় আরও গভীর এক স্তরে। ওর মায়াভরা ঘুমন্ত মুখের চৌহদ্দিতে দুশ্চিন্তার লেশ দেখা যায় না আর। বরং সেখানে একধরনের ছেলেমানুষির পাতলা রেখা আহ্লাদে ঝুলে থাকে।

ঘুমন্ত মেয়েটার দিকে এক পলক তাকিয়ে রহিম মৃধা বড় স্বস্তি নিয়ে বিলম্বিত একটা নিশ্বাস ছাড়ে। এত স্বল্প সময়ের মধ্যে কাজটা সারতে পারবে, সেটা তার কল্পনাতেও ছিল না। এখন ভালোয় ভালোয় পৌঁছে গেলেই হয়। মেহেরকে চাপ দিয়ে আরও হাজারখানেক টাকা বাড়িয়ে নেওয়া যাবে কি না, সেটাও ভাবে রহিম মৃধা। মেয়েটাকে চোখের দেখা না দেখেই কথাবার্তায় এগিয়েছিল তারা। এমন সুন্দর মায়াভরা মুখটা দেখলে মেহের কিছু টাকা বাড়াতে গররাজি হবে না মনে হয়।

আসন্ন বিপুল অর্থ প্রাপ্তির ভাবনা রহিম মৃধার ভেতর বলক দেওয়া একধরনের উত্তেজনা তৈরি করে। পরিকল্পনামতো দৌলতদিয়ার পতিতাপল্লির খালা মেহেরের হাতে মেয়েটাকে তুলে দিয়ে ত্রিশ হাজারের থোকটা ট্যাঁকে গুঁজে সরে পড়তে হবে তাকে। টাকার থোকটা দ্রুত পাওয়ার ইচ্ছা রহিম মৃধার মধ্যে তীব্রভাবে চাগাড় দেয়। সে ভাবে, বাসটা আরও বেগে চলে না ক্যারে!

চেষ্টা করেও রহিম মৃধা তার ভেতরের অস্থিরতা ঢাকতে পারে না।

নাহার তৃণা: ইলিনয়, যুক্তরাষ্ট্র।