হংকং থেকে বিশ্ববাসী যা শিখতে পারে
জানুয়ারির শুরুর দিকে যখন শুনলাম চীনের উহানে এক নতুন ধরনের করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ছে, হংকং বা আর সবার মতো আমিও শঙ্কা বোধ করছিলাম। নভেম্বর বা ডিসেম্বরে এই ভাইরাস প্রথম উহানে দেখা দেয়। জানুয়ারি নাগাদ এটা মোটামুটি পরিষ্কার হয়ে যায় বিশ্বের কাছে, যে সার্সের মতো আরেকটা দুর্যোগ শুরু হতে যাচ্ছে।
শুরুতে চীনের বাইরে কেউ এটাকে গুরুত্ব না দিলেও, হংকং শুরু থেকেই এটা নিয়ে আতঙ্কিত ছিল। হওয়ার কারণও আছে। তিন দিকে সমুদ্রবেষ্টিত হংকংয়ের স্থলসীমার পুরোটাই চীনের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে। চীনের স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল হওয়ার কারণে প্রতিদিন লক্ষাধিক লোক হংকং আর গুয়াংদং প্রদেশের সীমান্ত অতিক্রম করে।
সার্সের মহামারি চীনের গুয়াংদং প্রদেশ থেকেই শুরু হয়েছিল। তারপর রোগটি পৃথিবীর ২৬টির মতো দেশে ছড়ায়। তবে মাত্র ৭ মিলিয়ন লোকের হংকং শহরে সার্সের ছোবল ছিল সবচেয়ে ভয়াবহ। প্রায় ৬ মাস ধরে চলা তাণ্ডব, ১৭ শতাংশ মৃত্যুহার, হংকংয়ের অর্থনীতি সে সময় অকল্পনীয় ক্ষতির মুখে পড়েছিল।
আমার বন্ধুদের কাছে শুনেছি সার্সের সময় তারা মাসের পর মাস অবরুদ্ধ জীবন যাপন করেছিল। কোভিড-১৯–এর আগমনের আগে থেকেই, এই শহরে যেদিকেই তাকানো যায়, সার্সের অভিজ্ঞতা চোখে পড়ে। মানুষ সেই ভয়াবহ সময় থেকে শিক্ষা নিয়েছে। পরিচ্ছন্নতার বাতিক এবং সামান্য সর্দি কাশিকেও অবহেলা না করা—এগুলো এদের রক্তে ঢুকে গেছে। বছরের যেকোনো সময়েই দেখা যাবে প্রচুর মানুষ মাস্ক পরে ঘুরছে, প্রতিটা ভবনের প্রবেশপথে রাখা থাকে জীবাণুনাশক, সেই সঙ্গে চলে সব বাণিজ্যক বা আবাসিক ভবনের সিঁড়ি, লিফট, দরজা নিয়ম করে প্রতি দুই ঘণ্টা পরপর ধোয়ামোছা। এ রকম একটা শহরে, যারা হাত পোড়ার পর শিক্ষাটা পুরোপুরি নিয়েছে, করোনাভাইরাস সম্পর্কে জানামাত্রই মানুষ তার প্রকোপ ঠেকাতে মরিয়া হয়ে ওঠে।
আমি আমার স্বামী-সন্তানসহ হংকংয়ের বাসিন্দা প্রায় আট বছর ধরে। সার্সের ইতিহাস জানি বলেই শুরু থেকেই ভীত ছিলাম। দেশ থেকে সবাই বলছিল, ‘চলে এসো’, কারণ আগে যেহেতু বাংলাদেশে এমন রোগের সংক্রমণ ঘটেনি, তাই সবাই ভাবছিল দেশে যাওয়াটাই বোধ হয় নিরাপদ। অনেক বাংলাদেশি চলেও গেলেন। কিন্তু আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম, যাব না। প্রথম দিকে বুঝতে পারছিলাম না ভুল করলাম কি না। সরকারও শুরুর দিকে ততটা তৎপর ছিল না, কারণ প্রায় ছয় মাস ধরে চলতে থাকা বিক্ষোভে তারা একটু পর্যুদস্তই ছিল। ভাইরাসের প্রথম রোগী শনাক্ত হওয়া শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সব দোকান থেকে মাস্ক ও স্যানিটাইজার গায়েব হলো। সেই সঙ্গে শুরু হলো গ্রোসারি শপের শেলফ খালি হয়ে যাওয়া। বেশ একটা আতঙ্কজনক জীবন তখন।
হংকংয়ের মানুষের মানসিক দৃঢ়তা এবং লড়াই করার স্পৃহা আসলেই প্রশংসা করার মতো। দ্রুত সবাই জোর দাবি জানায় চীনের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে সব প্রবেশপথ বন্ধের। স্থলবন্দর থেকে শুরু করে ফেরি, ফ্লাইট এবং ট্রেন সব বন্ধের দাবি জোরদার হতে থাকে। সরকার প্রথমে সিদ্বান্ত নিতে দেরি করলেও, যখন চিকিৎসক ও নার্সরাও আন্দোলনে যুক্ত হন, তখন তাঁরা দুটি ছাড়া বাকি সব সীমান্ত ক্রসিং বন্ধ করে দেয়। যাবতীয় বিনোদনের জায়গা, সিনেমা হল, ডিজনিল্যান্ডের মতো থিম পার্ক অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়। চীনা নববর্ষের ছুটির পর আর কোনো স্কুল খোলেনি। বিমানবন্দর আর অবশিষ্ট দুটি স্থলবন্দরে নিশ্ছিদ্র কড়াকড়ি শুরু হয়। ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে এসে সরকারি, বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠান বাসা থেকে কাজ করার জন্য কর্মীদের উৎসাহিত করা শুরু করে। মাস্ক আর নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের সরবরাহ মার্চ নাগাদ স্বাভাবিক হয়ে আসে।
মার্চ মাসের শেষের দিকে ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকা–ফেরত মানুষের ঢলে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দ্রুত বাড়তে থাকে। মাত্র ৩০০ রোগী থেকে দুই সপ্তাহের মধ্যে আক্রান্তের সংখ্যা হাজার ছাড়িয়ে যায়। সরকার তখন আরও এক দফা বিধিনিষেধ আরোপ করে। সব ক্লাব ও বার বন্ধ ঘোষণা করা হয়, প্রতিটি রেস্টুরেন্টে একেকটা টেবিলের পরে আরেকটা টেবিল খালি রাখা বাধ্যতামূলক করা হয়। এরই মাঝে সরকার পাল্লা দিয়ে বাড়ায় কোয়ারেন্টিন সেন্টারের সংখ্যা ও ধারণক্ষমতা।
হংকং বিশ্বের ব্যস্ততম ৫টি বিমানবন্দরের একটি। ব্যাংকিং আর বাণিজ্যের জন্য এটি বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম কেন্দ্র। কিন্তু অর্থনৈতিক ক্ষতির হুমকি মাথায় না রেখে প্রায় ৯০ শতাংশ যাত্রীবাহী ফ্লাইট বন্ধ করে দেওয়া হয়। যাঁরা এর মধ্যেও হংকংয়ে আসছেন, শতভাগ যাত্রীর করোনাভাইরাস পরীক্ষা হয়েছে। যাঁরা সুস্থ, তাঁদেরও ইলেকট্রনিক ট্র্যাকিং ব্রেসলেট পরে ১৪ দিনের বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টিনের ফল আমরা পেতে শুরু করি এপ্রিল থেকেই। সবার সর্বাত্মক প্রচেষ্টায় ২৯ এপ্রিল পর্যন্ত হংকংয়ে সর্বমোট আক্রান্তের সংখ্যা ১ হাজার ৩৭, মারা গেছেন ৪ জন। ২৬-২৯ এপ্রিল পরপর ৪ দিন কোনো নতুন রোগী ধরা পড়েনি।
বলে রাখা ভালো, অন্তত ১০ লাখ বাসিন্দা আছে, এ রকম শহরগুলোর মধ্যে হংকং পৃথিবীতে সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ। সরকারের সাহসী পদক্ষেপ অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার। কিন্তু আমার মনে হয়েছে জনগণের অবিশ্বাস্য রকমের সচেতনতার কারণেই হংকং এই ভাইরাসকে নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়েছে। আমরা সাত মিলিয়ন মানুষ প্রথম দিন থেকেই দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলাম, সরকারের প্রতিটা নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছি। এমনকি তার বাইরে গিয়েও পরিচ্ছন্নতার বাড়াবাড়ি করেছি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা পশ্চিমা মিডিয়ার কথায় কর্ণপাত না করে শতাভাগ হংকংবাসী মাস্ক পরছে। বাড়িঘর ও আশপাশের জায়গা তারা নিজেরাই পরিষ্কার রাখছে। সামান্য সর্দি হলেও বাড়ি থেকে বের হচ্ছে না। সত্যি বলতে, হংকং কখনোই কারফিউ বা পুরোপুরি লকডাউন জারি করেনি। তার দরকারও পড়েনি। মানুষের আন্তরিক প্রচেষ্টা, নিয়ম মেনে চলা আর অতীত থেকে শিক্ষা নেওয়াই হংকংকে সাহায্য করেছে এই ভাইরাসের রাশ টেনে ধরতে।
করোনাভাইরাসের অধ্যায় শেষ হয়নি। এখনো অনেক পথচলা বাকি, তবে হংকং থেকে বিশ্ববাসীর অনেক কিছুই শেখার আছে।